মহাবৃক্ষের সন্ধানে

‘প্রকৃতি স্নেহের আঁচল বিছিয়ে রাখে বটের তলে।’ কথাটা আমার নয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের, আমাদের জাতীয় সংগীতেই বলেছেন। আর সেই বটতলায় অলস সময় কাটাতে আসেন গ্রামের বুড়ো বাবুরা। বটতলার বাবুরাই নিরীহ গোবেচরা গুপির ‘সুখ্যেত’ করে পরামর্শ দেন, যেন রাজদরবারের আশপাশে গিয়ে রাগভৈরবী গায় গুপি! তাতে নাকি রাজার সভাগায়কের তকমাটা পেয়ে যেতে পারে ‘কাককণ্ঠ’ গোপীনাথ গায়েন। গুপি বোঝেনি বটতলার বাবুদের সেই তামাশা। সাতসকালে বিশ্বলোচন শর্মার মতো গিয়ে গান ধরে রাজবাড়ির পুকুরঘাটে বসে। ফলস্বরূপ গাধার পিঠে চড়িয়ে তাকে গ্রামের বাইরে বের করে দেওয়া হয়। গুপি গাইন বাঘা বাইন সিনেমায় সত্যজিত্ বটতলার যে দৃশ্যটা দেখিয়েছেন, সেটাতে আবহমান গ্রামবাংলারই ছবি ফুটে উঠেছে। এ দেশে এমন কোনো গ্রামের উদাহরণ তুমি দিতে পারবে না, যেখানে একটা বটগাছ নেই।

বটগাছ, মহাবৃক্ষ। সেই বটতলায় যুগে যুগে বুড়ো বাবুরা বসে একটু কূটচাল চালবেন, একটু হাসি-তামাশা করবেন, গুপির মতো নিরীহ গায়েনকে পাকে ফেলবেন, প্রয়োজনে অন্যের দুঃখে সমব্যথীও হবেন, আবার গ্রামের বিচার-সালিসও সেখানে হবে, হবে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন—এই হলো এ দেশের বটতলার চিরন্তন দৃশ্য।

এই মহাবৃক্ষটাই পৃথিবীর সবচেয়ে দৈত্যাকার, সবচেয়ে দীর্ঘজীবী উদ্ভিদের একটি। অনেক জীববিজ্ঞানীই দাবি করেন, বটগাছ নাকি কেটে না ফেললে কখনোই মরে না। কথাটা প্রমাণ করার জন্য হয় মানুষকে আজীবন বেঁচে থাকতে হবে, নইলে হাজার বছরের পুরোনো কোনো গাছকে টিকে থাকতে হবে। সারা বাংলা ঘুরে তুমি হাজার বছরের পুরোনো গাছের দেখা পাবে না। তবে কয়েক শ বছরের পুরোনো গাছ তো পেতে পারো। একটা নয়, অনেক। অন্তত দুটো মহাবৃক্ষের দেখা পাবে বাংলাদেশে। সে দুটো যদি দেখতে চাও, তো যেতে হবে ঝিনাইদহ জেলায়। একটা কালীগঞ্জ উপজেলার সুইতলা মল্লিকপুরে, আরেকটা মহেশপুর উপজেলায় এশিয়ার সবচেয়ে বড় কৃষি খামার দত্তনগর ফার্মে।

আমার নিজের বাড়ি ঝিনাইদহ জেলায়। দত্তনগরের গাছটির কাছ থেকে মাত্র আট কিলোমিটার দূরে। তবু এত দিন সেটা দেখার সৌভাগ্য হয়নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন না—আমরা হিমালয় দেখি, সমুদ্র দেখি, পাহাড় দেখি, তার জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি টাকাও খরচ করি, অথচ ঘরের পাশে ধানের শিষের শিশির বিন্দুর খোঁজ রাখি না। আমার অবস্থাটাও তেমন। তবে পণ করেছিলাম, এবার যাবই যাব। ঈদের ছুটিতে এক বন্ধুর মোটরসাইকেলে চড়ে চলে গেলাম দত্তনগরে বটতলায়।

দত্তনগর ফার্মটা বিশাল। সরকারের উত্পাদিত চালের বিরাট একটা অংশ জোগান দেয় এই ফার্মটা। তা ছাড়া বিএডিসি যে বীজ উত্পন্ন করে বিভিন্ন ফসলের, তার প্রায় সবটুকুর জোগান এখান থেকেই আসে।

দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। সবুজে পরিপূর্ণ। বহু দূরে কয়েকটা গ্রাম চোখে পড়ে। আর নারকেল বাগান। এই ফার্মের ভেতর দিয়েই বাস-ট্রাক চলার বড় রাস্তা। ছোটবেলায় দেখেছি, শত শত গরু-মহিষের পাল চরাতে বেরিয়েছে ফার্মের রাখালেরা।

বটগাছটা ঠিক রাস্তার ধারে নয়, মাঠের বেশ ভেতরে। এদিকটায় বাগান আছে, আছে কৃষি কর্মকর্তাদের থাকার জন্য উঁচুতলা ভবনও। সেসবের আড়ালেই রাস্তা থেকে কখনো দেখা যায় না গাছটাকে। মাইলখানেক মেঠোপথে চলার পরই দূর থেকে লোকের সমাগম চোখে পড়ল। সঙ্গে মেলার হইচই তো আছেই। তবে আমার বেশি আকর্ষণ ছিল মেলাটাকে ছাউনি দিয়ে রাখা বটগাছের ওপরে। কাছে গিয়ে দেখি, ওরে বাবা, এ তো গাছ নয়, আস্ত একটা বটের বাগান! ৩০-৩২টা গাছ। কিন্তু কোনোটাই আলাদা নয়। একটা যেন আরেকটার হাত ধরাধরি করে আছে।

জানোই তো, বটগাছের ঝুরি থাকে। ঝুরি আসলে একধরনের শিকড়। এগুলো গাছের বড় বড় ডাল থেকে নেমে আসে মাটিতে। তখন কিন্তু এগুলো দড়ির মতো চিকন প্যাকাটি। তারপর যত দিন যায়, নেমে আসা সেই ঝুরি মাটির গভীরে ঢুকে পড়ে। পানি আর পুষ্টি নিয়ে ফুলেফেঁপে ওঠে। কালক্রমে ফুলেফেঁপে ওঠা সেই ঝুরিই পরিণত হয় আরেকটি কাণ্ডে। কাণ্ডের ওপর থেকে ডালপালা গজায়, একসময় সেটাও পরিণত হয় বড় বৃক্ষে। তাই বলে মা গাছটির সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ হয়ে যায় না। যে ডাল থেকে ঝুরি নেমেছিল, সেই ডালটা তখনো সংযোগ রেখে চলে গাছের দুই অংশের সঙ্গে। তখন দূর থেকে দেখলে মনে হয়, হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে দুটো বিরাট গাছ।

এখন বটগাছটাকে যদি কেউ কেটে না ফেলে, দু-পঞ্চাশ বছর যদি সময় পায়, তখন ঝুরি সংখ্যায় বাড়ে, দিন দিন কাণ্ডের সংখ্যাও বাড়ে। পুরোনো সেই বটগাছটিই একগাদা ছেলেপুলে নিয়ে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে থাকে বিশাল জায়গা দখল করে।

বটতলায় গিয়ে মুগ্ধতা আরও বাড়ল। এটাই কি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গাছ? গুগলে সার্চ দাও। এই গাছের নাম তুমি পাবে না। পাবে কালীগঞ্জের সুইতলা-মল্লিকপুরের গাছটির কথা। ঝিনাইদহ জেলা পরিষদের ওয়েবসাইট থেকে শুরু করে দেশের অনেক জাতীয় দৈনিক কিংবা নিউজ পোর্টালের ফিচারও পাবে। সেসব ফিচারের একটা তথ্য তোমার চোখ কপালে উঠিয়ে দিতে পারে, গাছটা নাকি এশিয়ারই বৃহত্তম। তবে চোখ কপাল থেকে নামিয়ে রাখাই ভালো। কারণ, তথ্যটা ঠিক নয়। আশির দশকে নাকি জরিপ করেছিল বিবিসি, সেই জরিপেই নাকি এই স্বীকৃতি পেয়েছিল গাছটা।

মল্লিকপুরের বটতলাতেও গেলাম। হতাশই হলাম কিছুটা। চারপাশে দেয়াল দিয়ে ঘেরা। প্রাচীন একটা ভাব আছে। কিন্তু ওইটুকুই! বড় গাছের আসল যে বৈশিষ্ট্য, সেটা যেন হারিয়ে ফেলেছে গাছটা। দত্তনগরের বটগাছে যেমন প্রতিটি কাণ্ডের সংযোগ আছে, সেটা নেই মল্লিকপুরের গাছে। বয়সের ভারে সংযোগ-শাখাগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। গাছটার বয়স ২৫০ থেকে ৩০০ বছর বলেই মনে করেন স্থানীয় মানুষ। গাছটির একটা ইতিহাসও লেখা আছে দেয়ালের মোজাইকের ফলকে। দেখলেই বোঝা যায়, বয়সে এটা দত্তনগরের চেয়ে বড়। কিন্তু আকারে? দত্তনগরের গাছটির আকার ২ একর আর মল্লিকপুরেরটা ২ দশমিক ০৮ একর। সামান্য বেশি। আর তাতেই দেশের বড় বটগাছের তকমাটা পেয়ে যাচ্ছে মল্লিকপুরের গাছটিই। তবে কি এশিয়ারও সেরা? কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেনে আরেকটা বটগাছ আছে, সেটার আয়তন প্রায় ৪ দশমিক ৭ একর। নাম গ্রেট বেনিয়ান। ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে আছে ৫ একরজুড়ে আরেকটি গাছ। এশিয়ার অন্য দেশগুলো বিবেচনায় আনলে আমাদের এই গাছ দুটি ছোটই। গুগল ঘেঁটে পাওয়া নানা ওয়েবসাইটের তথ্য সে কথাই বলছে। তবে এশিয়ার বৃহত্তম না হোক, বাংলাদেশের বৃহত্তম গাছ এ দুটিই, তাতে সন্দেহ নেই।

মল্লিকপুরের গাছটার জন্ম নিয়ে একটা গল্প চালু আছে এই এলাকায়। এখানে নাকি একসময় কুমোরেরা বাস করত। তাদের একটা ইঁদারা ছিল। সেই ইঁদারার ইটের ফাঁকে জন্ম নেয় ছোট্ট একটি চারা। সেটাই আজ কালের ব্যবধানে মহাবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। দেখে এসো গাছ দুটো। উপভোগ করো মহাবৃক্ষের বিশালতা।

আগের সেই রূপ না থাকলেও মল্লিকপুরের বটগাছটি এখনও সবচেয়ে বড়