মাটিচাপা গুপ্তধন-রহস্য

প্রাচীনকালের কোনো এক সময়ে মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল একগাদা সোনা আর রুপা। সম্প্রতি এক কৃষকের জমিতে সেই গুপ্তধন খুঁজে পাওয়া গেছে, যার মূল্য কোটি কোটি টাকা। ন্যাট জিও কিডস অবলম্বনে সেই গুপ্তধনের খবর জানাচ্ছেন আবুল বাসার।

বিপ! বিপ! মেটাল ডিটেক্টরে কাঙ্ক্ষিত যান্ত্রিক আওয়াজ কানে যেতেই লোকটি হঠাৎ থেমে গেলেন। ব্রিটেনের অনেক জায়গাতেই আগের দিনের মানুষের জিনিসপত্র লুকিয়ে রাখা আছে। সেসব মানিকের খানিক খুঁজে পেতেই তন্নতন্ন করে অনুসন্ধান চালাচ্ছেন তিনি।

ভাগ্য সুপ্রসন্ন তাঁর। জমির মাটি খুঁড়ে একটি-দুটি নয়, সাড়ে তিন হাজারের বেশি সোনা আর রুপার খণ্ড পেয়েছিলেন তিনি। প্রায় এক হাজার ৩০০ বছর আগে, প্রাচীন কোনো যোদ্ধা এসব গুপ্তধন মাটির তলে লুকিয়ে রেখেছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রত্নতত্ত্ববিদেরা সেখান থেকে পেলেন তলোয়ারের হাতল, হেলমেটের কিছু ভাঙা টুকরা আর কারুকাজ করা ঢাল। গুপ্তধনগুলোর মূল্য ৬০ লাখ মার্কিন ডলারের বেশি।

এই সোনার ঘোড়ার কাজ কী ছিল, সে ব্যাপারে এখনো অন্ধকারে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা। তবে এতে অ্যাংলো-স্যাক্সন যুগের কারিগরদের শিল্পকর্মের সূক্ষ্মতার প্রমাণ পাওয়া যায়।

রহস্যময় মানুষেরা

প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গেছে, গুপ্তধনগুলো ছিল প্রাচীন অ্যাংলো-স্যাক্সনদের। সেই ৪১০ সালে এই অ্যাংলো-স্যাক্সনরা দলবলে জার্মানি থেকে ইংল্যান্ডে এসে ঘাঁটি গেড়েছিল। এই ফাঁকে ছোট্ট করে বলে রাখি, ইংল্যান্ড শব্দের অর্থ অ্যাংলোদের দেশ। ইতিহাস বলে, অ্যাংলো-স্যাক্সনরা প্রায় সব সময়ই যুদ্ধে লিপ্ত থাকত। প্রতিবেশীদের সঙ্গে নানান স্বার্থসংশ্লিষ্ট কারণে তো যুদ্ধ লাগতই, এমনকি নিজেরা নিজেরাও যুদ্ধ করতে কার্পণ্য করত না তারা। এভাবেই তারা প্রায় ১০৬৬ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ড শাসন করেছিল। এরপর ফরাসিরা (ইতিহাসে যারা নর্মান নামে পরিচিত) অ্যাংলো-স্যাক্সনদের ইংল্যান্ড থেকে তাড়িয়ে দেয়।

যাহোক, সপ্তম শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে অ্যাংলো-স্যাক্সনদের ভেতর সবচেয়ে শক্তিশালী রাজা ছিলেন পেন্ডা অব মার্সিয়া। মাটির নিচে পাওয়া এসব সোনা-রুপার মালিক এই রাজা বলেই মনে করছেন কয়েকজন প্রত্নতাত্ত্বিক। এ দলে আছেন প্রত্নতত্ত্ববিদ কেভিন লেহি। গুপ্তধনগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর কেভিনের ধারণা, এগুলো যুদ্ধ জয়ের পর, লুণ্ঠন করা প্রত্নও হতে পারে। কিংবা সেগুলো রাজার নিজেরই সম্পদ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সঠিক যে কোনটি, তা কেউ জানে না।

মধ্যযুগে প্রাচ্যের ভারতবর্ষ, চীন আর আরব দেশগুলো জ্ঞান-বিজ্ঞানে বেশ এগিয়ে থাকলেও ইউরোপে তখন চলছিল ঘোর অন্ধকার যুগ বা ‘ডার্ক এজ’। এই মধ্যযুগেরই মানুষ ছিল অ্যাংলো-স্যাক্সনরা। এ সময়টায় ইউরোপে শিল্প বা সংস্কৃতিতেও তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা নেই বলেই সবার বিশ্বাস। কিন্তু এসব গুপ্তধন দেখে, একটা বিষয় অন্তত নিশ্চিত হওয়া গেছে যে অ্যাংলো-স্যাক্সনদের সময়কালের শিল্পদক্ষতা একেবারে ফেলনা ছিল না।

গুপ্তধন-রহস্য

ইতিহাসে অ্যাংলো-স্যাক্সনদের হিংস্র যোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সে কারণে নিজেদের যুদ্ধাস্ত্র নিয়েও যথেষ্ট সচেতন ছিল তারা। আবিষ্কৃত এসব গুপ্তধনের ধাতব অস্ত্রগুলোর বিভিন্ন হাতের কাজ দেখে বোঝা যায়, তারা শিল্পীও ছিল। কারণ, সেকালের কারিগরেরা কোনোরকম আতশ কাচ ছাড়াই যুদ্ধাস্ত্রগুলোতে ছোট্ট ছোট্ট অনেক কারুকাজ করেছে। এর কিছু কিছু উপাদান বহু দূরদেশ থেকে আনা হয়েছিল। গার্নেট নামের গাঢ় লাল রঙের প্রত্ন ভারত থেকে, আর সোনাগুলো এসেছিল তুরস্ক থেকে।

তবে এখনো সব প্রশ্নের উত্তর পাননি প্রত্নতত্ত্ববিদেরা। তাঁরা এখনো জানেন না গুপ্তধনের মধ্যে শুধু অস্ত্রের ভাঙা টুকরাই কেন পাওয়া গেছে। এসবের মধ্যে নারীদের কোনো জিনিস কেন নেই? গুপ্তধনগুলো কি নিরাপদে রাখার জন্য নাকি কোনো যুদ্ধে বিজয়ের স্মারক হিসেবে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিল? মাটিচাপা দেওয়ার পর সেগুলো তুলে নিতে কেউ আর ফিরে আসেনি কেন?

গুপ্তধন খোঁজার যন্ত্রপাতি

বর্তমানে গবেষকেরা প্রাচীন গুপ্তধন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। সেগুলো হচ্ছে—

কম্পিউটার: সোনা আর রুপার খণ্ডগুলো কম্পিউটারে স্ক্যান করা হয়, যাতে গবেষকেরা সেগুলো বিশ্লেষণ করতে পারেন।

এক্স-রে ফ্লুরোসেন্স: এক্স-রের মাধ্যমে শক্তি তরঙ্গ তৈরি হয়, যা দিয়ে গবেষকেরা তাৎক্ষণিকভাবে জানতে পারেন কোন নির্দিষ্ট গুপ্তধন কোন উপাদানে তৈরি।

ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ: এই শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে যেকোনো বস্তুকে অনেক গুণ বড় করে দেখা যায়। গুপ্তধন পরিষ্কার করে ইলেকট্রনিকস মাইক্রোস্কোপের নিচে রাখা হয়। এর সঙ্গে যুক্ত থাকে ভিডিও ক্যামেরা। যার মাধ্যমে গবেষকেরা অনেক সূক্ষ্ম আর গুপ্ত জিনিস দেখতে পান।