মানিক একাই ১০০

অলংকরণ: মেহেদী হক

মানিকবাবু গল্প লেখেন, সেই গল্পের ছবি আঁকেন, চিত্রনাট্য লেখেন, সিনেমা বানান, যখন দরকার পড়ে সেই সিনেমার সঙ্গে সুর–সংগীত ইত্যাদিও জুড়ে দেন, সিনেমায় কে কী পরবে, কোন আসবাবের রং কী হবে সবই তাঁর খেরো খাতায় ড্রাফট করে বুঝিয়ে দেন সবাইকে। তিনি আসলে কী কী করতে পারতেন, তা লেখার চেয়ে কী করতেন না, তা লিখতে বরং কলমের কালি (বা কি–বোর্ডে টাইপিং) কম খরচ হবে। যারা বুঝে ফেলেছে তারা তো ফেলেছেই, আর যারা একটু সন্দেহে আছে তাদের জন্য বলি, এই ‘মানিক’ হলো সত্যজিৎ রায়ের ডাকনাম। যাঁকে বলা হয় বাংলা রেনেসাঁর শেষ ব্যক্তি। এ রকম বহুমুখী প্রতিভা শুধু বাংলাতেই নয় যেকোনো দেশেই বিরল। তাঁর ১০০তম জন্মজয়ন্তীতে চাইলে তাঁর ১০০ রকম কাজ নিয়ে দুই শর ওপর বই লিখে ফেলা যায়, তবে আজকে এখানে আমরা শুধু তাঁর আঁকা নিয়েই কথা বলব।

সত্যজিৎ রায় জন্ম নিয়েছিলেন আরেক মহাপ্রতিভাধর ছড়াকার ও সাহিত্যিক সুকুমার রায়ের ঘরে। এবং সত্যজিতের দাদা যে আরেক অসাধারণ গল্পকার ও আঁকিয়ে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, তা নিশ্চই আলাদা করে বলে দিতে হবে না। এইটুকু জানার পরেই অনেকের মনে হতে পারে, উপেন্দ্রকিশোরের নাতি আর সুকুমার রায়ের ছেলে হলে কিছু যে ঘটে জুটবেই তাতে আর আশ্চর্যের কী? আশ্চর্যের এই যে তাঁর দাদা বা বাবা কেউই এত রকম বহুমুখী কাজ করে যাননি, বা বলা যেতে পারে হয়তো সুযোগও পাননি। তবে আমরা আজকে সত্যজিৎ রায়ের যে জিনিসটা নিয়ে আড্ডাটা দিতে চাই সেটাতে কিন্তু তাঁর বাবা বা দাদা কেউই কম যাননি। বরং শিশুসাহিত্যে আঁকা কীভাবে আরও দারুণ করা যায়, তা ভাবতে ভাবতে রীতিমতো একটা ছাপাখানা দিয়ে বসেন দাদা উপেন্দ্র, এবং কীভাবে কাঠখোট্টা সাদা–কালো থেকে বের হয়ে কিছুটা আলোছায়া দিয়ে হালকা থেকে গাঢ় বা গাঢ় থেকে হালকা করে ছাপানো যায়, তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করে নতুন ছাপার পদ্ধতিও আবিষ্কার করেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। এবং আঁকাআঁকি নিয়ে কোনোরকম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই দাদা ও বাবা এসব অসাধারণ কাজ করে গেছেন। সুতরাং রীতিমতো আর্ট নিয়ে বিশ্বভারতীতে পড়াশোনা করা সত্যজিত রায় যে তাঁদের চেয়ে আরও পেশাদারি কাজ করবেন, সেটা তো অনেকটা স্বাভাবিক।

বিজ্ঞাপন সংস্থার জন্যে সত্যজিত রায়ের আঁকা।

তবে সত্যজিৎ রায়ের বিশ্বভারতীতে আর্ট নিয়ে পড়াশোনা কিন্তু এক কথায় হয়নি। সাধারণত দেখা যায় ছেলেমেয়েরা আর্ট নিয়ে পড়তে চায় আর বাবা-মা চান অন্য কিছু। এখানে বরং একটু অন্য রকম। সত্যজিৎ রায়ের মা বরং চেয়েছিলেন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠানে পড়ুক। সত্যজিৎ ওদিকে কলকাতা ছেড়ে সেই সুদূর শান্তিনিকেতনে যাওয়ার কথা শুনে গড়িমসি করেছিলেন। যদিও পরে রাজি হয়ে যে খুব ঠকেননি, তা তাঁর পরের জীবনের দিকে তাকালেই দেখা যায়। একাধিক স্থানে তিনি তাঁর বাংলার প্রতি নতুন করে জন্মানো আবেগের জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন বিশ্বভারতীকেই। সেখানে তাঁর শিক্ষক নন্দলাল বসু এবং বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায়কে আজীবন শিল্পাচার্য মেনেছেন। শেষ বয়সে অন্ধ হয়ে যাওয়া গুরু বিনোদকে নিয়ে তৈরি করেছিলেন inner eye নামের তথ্যচিত্র। পরে আমাদের এই বাংলার সহজ সাধারণ কাদামাটির আর্টকে যে তিনি দারুণ সব সিনেমায় তুলে এনেছিলেন তারও ভিত্তি কিন্তু সেই শান্তিনিকেতনেই ঘটেছে বলা যায়।

মজার ব্যাপার হলো সত্যজিৎ রায় লিখে ইন্টারনেটে খোঁজ করলে আমরা কিন্তু তাঁর নামের পাশে দেখি ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা, কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে তিনি শুরু থেকে তা ছিলেন না, কিন্তু এই দুইয়ের মধ্যে একটা আশ্চর্য যোগ ছিল। শান্তিনিকেতন থেকে পাস করেই সত্যজিৎ যোগ দিয়েছিলেন এক ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন নির্মাতা কোম্পানিতে, নাম ডি জে কিমার। এবং আশ্চর্য হলেও সত্যি যে সেই বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করতে করতেই একটা কাজের সূত্রে হাতে এসে পড়েছিল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী। তার একটা অংশ নিয়ে হলো একটা বই আম আঁটির ভেঁপু আর সেই বইয়ে অপু আর দুর্গাকে আঁকতে গিয়েই নাকি তাঁর মাথায় পথের পাঁচালী সিনেমাটা বানানোর পরিকল্পনা আসে!

আর সেই সঙ্গে অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল আঁকাআঁকি করতে করতে যে বিশ্বভারতীতে শেখা আঁকিবুঁকির কায়দাকানুন দিনে দিনে তিনি আরও শাণিয়ে নিচ্ছিলেন, তা ভালোই বোঝা যায়। যেকোনো ছোট কাজেরও তিনি যে তিনটা জিনিস সব সময় সর্বোচ্চ মনোযোগে করতেন তার একটা হলো ‘ডিটেইল’। আমরা এই বিজ্ঞাপনের আঁকাটাই যদি ভালোমতো লক্ষ করি তবে অবাক হয়ে যাব কত ধাপে কত রকম করেই না তিনি ডিটেইল ধরার চেষ্টা করেছেন। আর তাঁর কাজের দ্বিতীয় যেই ব্যাপারটা একবারে চোখে পরে সেটা হলো—নিপাট পরিচ্ছন্নতা। মানে ঠিক যতটুকু না হলেই না। একটাও অপ্রয়োজনীয় লাইন নেই কোথাও। ঠিক যেটুকুতে তিনি চাইছেন দর্শকের মনোযোগটা পড়ুক সেটুকুই ফোকাস করছেন নিখুঁত একটা কম্পোজিশনে। আর তিন নম্বরটা হলো ‘স্টাইল’। এ রকম সর্বব্যাপী স্টাইল নিয়ে গবেষণা করা কোনো আঁকিয়ে বাংলায় তো বটেই পৃথিবীতেও বিরল। তিনি যেন কখনোই এক স্টাইল দুইবার করবেন না বলে পণ করেছিলেন। যখন যেই গল্প বা দৃশ্য যেই ধরনের স্টাইল চায় তিনি সেটাকেই খুঁজে বের করে আঁকতেন। যেমন সেই যে বললাম আম আঁটির ভেঁপু বইটা। সেটার প্রচ্ছদ যদি আমরা দেখি। কী অনায়াসে আদুরে একটা কম্পোজিশন। জটিল পশ্চিমা পারসপেক্টিভ (মানে সমান্তরাল রেখা যে রকম দূরে গিয়ে এক বিন্দুতে বিলীন হচ্ছে এমন দৃষ্টবিভ্রমের মারকাট কৌশলী আঁকা) বাদ দিয়ে তিনি এখানে একেবারেই আমাদের নকশিকাঁথার যে সাদামাটা ধরনের কাজ করা হয় সে রকম একটা স্টাইলে গেলেন। সেখানে বাংলার আবহমান আদরমাখা রূপটা ধরতেই যেন কোথাও কোনো তীক্ষ্ণ কোনা নেই। সবই আঁকাবাঁকা গোলাকার রেখায় করা। এমনকি বাংলায় লেটারিংটাও একেবারে যেন আঁকার অংশ এভাবেই ডিজাইন করা। রঙেও অসম্ভব পরিমিতিবোধ। এখান একটা ব্যাপার কিন্তু আমাদের মাথায় রাখা উচিত যে সত্যজিতের আঁকা যা-ই আমরা এখন দেখি তা কিন্তু হাতে–কলমেই আঁকা। তখন ডিজিটাল বলে কোনো শব্দ ছিল না। তার মানে যেকোনো কিছু চাইলেই হুটহাট করে করে ফেলা যেত না। যথেষ্ট সময় নিয়ে চিন্তাভাবনা করে কাজ করতে হতো। আর প্রথাগত যেসব ইলাস্ট্রেশন ছিল তার সঙ্গে মিলিয়ে সত্যজিৎ পশ্চিমা ক্ষুরধার একটা আঁকার ধরন আশ্চর্য দক্ষতায় মেলাতে পারতেন।

সত্যজিৎ রায়ের ইলাস্ট্রেশন দেখতে গেলে এই এত সব কিছু বাদেও শেষ পর্যন্ত আমাদের চোখ যেখানে এসে থামে, তা হলো তাঁর অনবদ্য কম্পোজিশন সেন্স। যেমন গোরস্তানে সাবধান নামে ফেলুদার বইটায় মহাদেব চৌধুরীর মুখোমুখি ফেলুদা—এটা তিনি যেভাবে এঁকেছেন, সেটা দেখা যেতে পারে। পুরো মনোযোগ অবশ্যই মহাদেব চৌধুরীর মুখে পড়তে হবে। কিন্তু তার বিপরীতে ফেলুদা কী ভাবছেন মানে তার কী অভিব্যক্তি তা–ও তো আসা চাই। ফলে মহাদেব চৌধুরী যেদিকে বসেছেন সেদিকের দেয়ালে আঁকা হলো একটা আয়না আর সেটার মধ্যে দেখা যাচ্ছে ফেলুদাকে। আমরা পরে কিন্তু তাঁর সিনেমায়ও এই রকম অনবদ্য শট দেখি।

এই ছবিটাতে আরও লক্ষণীয় যে আলোছায়া মিলিয়ে কী অসাধারণ একটা আবহ তৈরি হয়েছে শুধু কলমের ক্রিস ক্রস হ্যাচ (আড়াআড়ি দাবার ছকের মতো করে কলমে যে শেডটা টানা হয়) লাইনে। এবং চারপাশের স্পেসটাকে ধরতে কোনো বর্ডার টানা হয়নি চারদিকে।

আবার ফেলুদাতে ফিরে এসে যদি সোনার কেল্লার এই ড্রয়িংটি দেখি তবে আরেকবার অবাক হতে হয়। জায়গাটা মরুভূমি, তার মানে চোখ ঝলসানো একটা রোদের ব্যাপার আছে। অর্থাৎ সেখানে কখনোই হালকা টোনের কোনো ছায়া পাওয়া যাবে না, দিনের বেলা অন্তত না। তাই চলে এল একবারে বাইনারি আলোছায়া। মানে ছায়া মানে কুচকুচে কালো আর আলো মানে কিছুই নেই। এমনকি কোথাও যেন আউটলাইনও দেওয়ার প্রয়োজন নেই। সেই সঙ্গে সামনে বড় করে ধরা একটা নাগরা জুতা ঠিক পেছনেই আবার ফেলুদার হাতেও ধরা নাগরা জুতো দুইয়ে মিলে বুঝিয়ে দেয় দুটো জুতোর মাঝে বেশ খানিকটা দূরত্ব আছে। কারণ, আমাদের মাথা তো জানে যে দুটো জুতো একই সাইজের জুতো। এটা সহজে দূরত্ব বোঝানোর একটা কৌশল। আবার সব বস্তুর ডিরেকশন বাঁ দিকে। পেছনে জটায়ুসহ (হ্যাঁ সোনার কেল্লায় জটায়ু দেখতে এমনই ছিলেন) । আর তার মধ্যে শুধু ফেলুদা ডান দিকে মুখ ঘুরিয়ে আছেন তাই চাই বা না চাই সব মনোযোগ চট করে ফেলুদার মুখেই পড়বে।

আর শুধু চমৎকার কম্পোজিশনই নয়। তাঁর যেকোনো ইলাস্ট্রেশন মানেই যেন গল্পের ভেতরে গল্প। শঙ্কুর ‘মরুরহস্য’ গল্পে দেখা যায় বিজ্ঞানী বন্ধুকে খুঁজতে খুঁজতে সাহারা মরুভূমিতে চলে এসেছেন শঙ্কু, আর পথে কুড়িয়ে পেলেন একটা বন্দুক। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মূল ফোকাসটা শঙ্কুর ওপরে, ফলে একই ছবির মধ্যে হলেও তাঁর অঙ্কনরীতিটা একটু আলাদা। চাঁদিতে তীব্র রোদ বলে এমনকি সেটা সম্পূর্ণ লাইন দিয়ে আঁকাও হয়নি। আর বন্দুক যে উনি নিজে গুলি করার জন্য হাতে নেননি তা তার ধরার ভঙ্গিটাই বলে দিচ্ছে। তার বাঁ হাতে উল্টো করে কুঁদোটা ধরা, অর্থাৎ পরীক্ষা করা হচ্ছে, আর পেছনে একঝাঁক শকুন বুঝিয়ে দিচ্ছে সদ্যই এখানে কোনো জানোয়ারের মৃত্যু ঘটেছে। যা সম্ভবত এই বন্দুকেই, আর ঠিক পেছনে বন্ধুর মুখভঙ্গি এখানে অত গুরুত্বপূর্ণ না বলে তাকে একেবারে কড়া ছায়ায় রেখে দেওয়া হয়েছে। আর একেবারে শেষে যে পেছনে দুজনের দিকে চোখ যাবে তাতেই বোঝা যাবে একেবারে একা একা তারা জায়গাটা খুঁজে বের করেননি, স্থানীয় মানুষদের সাহায্য নিয়েছেন এবং তারা কিছুটা অনিচ্ছায় তাদের এখানে এনেছেন ও ভয় পাচ্ছেন, যে কারণে দূরে দাঁড়িয়ে। তার মানে একটা ছোট ইলাস্ট্রেশনে আসলে কী পরিমাণ আইডিয়া। সত্যজিতের কাজ আমরা যতি দেখব ততই বুঝতে শুরু করব আঁকাআঁকি ব্যাপারটা শুধু দক্ষতায় যতটা নয়, চিন্তায় আরও বেশি।

আবার যখন যেখানে যা প্রয়োজন সেভাবে এক নিমেষে ভোজবাজির মতো স্টাইল পাল্টে ফেলাও যেন ছিল তাঁর কাছে একটা ছেলেখেলা, যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহজ পাঠ বইয়ে নন্দলাল বসু যে রকম লিনোকাট (কাঠের ছাপচিত্র) স্টাইলে এঁকেছিলেন আমরা তাঁর ছাত্র সত্যজিৎকেও দেখি আম আঁটির ভেঁপুতে সে রকম একটা স্টাইলে আঁকতে। মুষলধারার বৃষ্টির যে দৃশ্য পরে সবাই পথের পাঁচালীতে দেখেছে তারই প্রথম ইলাস্ট্রেশনে ছিল এ রকম একটা প্রাচীন কাঠের ব্লক ধরনের স্টাইলে।

বা দুই রঙে করা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষীরের পুতুল–এর এই আঁকাটা যদি দেখি তাহলেও ওই ধরনের একটা মায়াময় ছোঁয়া টের পাওয়া যায়।

মাধ্যমের যতই সীমাবদ্ধতা থাকুক না কেন ঠিক সেই অনুযায়ী সত্যজিৎ এমন একটা স্টাইল বের করতেন, যা দেখে মনে হতে বাধ্য যে এই মাধ্যমে এটাই করার কথা ছিল। ছোটদের পত্রিকা সন্দেশ–এর বেশ কিছু প্রচ্ছদ দেখলে সে কথাই মনে হয়। ছোটদের পত্রিকা কিন্তু চাইলেও সব রং ব্যবহার করা যাচ্ছে না, কিন্তু তার মধ্যে থেকেও কী দারুণ সব ডিজাইন করে ফেলতেন অনায়াসে। অনেক ক্ষেত্রেই কাগজের সাদা জায়গাটাকেও একটা সাদা রং হিসেবে ধরে ডিজাইন করতেন। আর একেবারেই মিনিমাম কিছু দৃঢ় মোটা লাইনে মূল বিষয়টাকে ধরতেন। আর ফেলুদা বা শঙ্কুতে যেমন একেবারে রিয়েলিস্টিক অ্যানাটমি মেনে সিরিয়াস ধরনের ছবি আঁকতেন এ রকম ছোটদের পত্রিকায় কিন্তু সেটা হতো না। সেখানে ঠিকই বেছে নিতে কার্টুনের মতো করে আঁকার স্টাইল। সন্দেশ–এর এই প্রচ্ছদগুলো তো আছেই আবার যদি আমরা ‘প্রোফেসর শঙ্কু’র প্রথম বইয়ের প্রচ্ছদটা দেখি তখন দেখতে পাব একেবারেই ছোটদের জন্য কার্টুন স্টাইলে আঁকা। কারণ, এই প্রথম বইটা কিন্তু একেবারেই শিশুদের জন্য আঁকা ছিল। তার মানে গল্পের ধরন বুঝে নিয়েই তিনি তাঁর স্টাইল ঠিক করতেন। কতটা দক্ষ ও দারুণ ডিজাইনার হলে এটা সম্ভব তা ভাবলে অবাক হতে হয়। এর বাইরে তাঁর বাংলায় করা ক্যালিগ্রাফির কথা শুরু করলে তো আর কথাই নেই, সে সম্পূর্ণ আরেক জগৎ। বাংলা ক্যালিগ্রাফিকেও তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন অন্য উচ্চতায়। তাঁর সিনেমার পোস্টার ও ডিজাইন করতেন নিজেই সেখানে একেকবার ক্যালিগ্রাফি নিয়ে একেক রকম পরীক্ষা–নিরীক্ষা করেছেন, বাংলা ক্যালিগ্রাফি নিয়ে যারা কাজ করতে চায় তাদের অবশ্যই সত্যজিৎ রায়ের কাজগুলো দেখা উচিত।

সত্যজিতের আঁকার আরেকটা বিশেষত্ব নিয়ে কথা বলে লেখাটার ইতি টানা যাক, সেটা হলো ব্লকিং। মানে সামনে একটা বড় কোনো বিষয়বস্তু এনে প্রথমেই কম্পোজিশন ব্লক করে ফেলা। যেমন ‘বারীন ভৌমিকের ব্যারাম’ গল্পে বাতিকগ্রস্ত বারীনবাবুকে উনি এভাবে সামনে এনে কম্পোজিশন ব্লক করে আঁকলেন, এখানেও সেই বর্ডার না দিয়ে ছেড়ে দেওয়া, যাতে হাঁপ ধরে না যায়, আবার একটা ঢেউখেলানো লাইনে বারীনবাবুর চুলটা আঁকলেন, যা কিছুটা চোখের ইলিউশন উসকে দিচ্ছে ও বলে দিচ্ছে লোকটা ঠিক স্বাভাবিক না। ওদিকে পেছনে একেবারে সিলুয়েট করে আঁকা আরেক লোক, যাকে দেখে বোঝার উপায় নেই কী তার মুখভঙ্গি, ভালো না খারাপ, সৎ না অসৎ। এবং সেটাই যেন সামনের বারীনবাবুর চোখেমুখে ভীতি। অনবদ্য স্টাইল আর কম্পোজিশন।

কাছাকাছি কম্পোজিশন আমরা বেশ অনেক জায়গাতেই দেখি তাঁর কাজে। যেমন নিচের কাজে কিন্তু আলোর উল্টো দিকে স্বভাবতই মাথা দুটো কুচকুচে কালো হওয়ার কথা, কিন্তু দুইয়ের মাঝে পার্থক্য করতেই যেন এ রকম ডিজাইনের সিদ্ধান্ত। এবং এখানেও সেই কম্পোজিশন ব্লক করে করা কাজ।

যা–ই হোক, সত্যজিৎ রায়ের কাজ নিয়ে কথা বলতে গেলে দিন–রাত চলে যাবে এবং যতই আমরা কজের মধ্যে ঢুকব ততই আরও আনন্দ পাব আর বিস্মিত হব। আঁকাআঁকি বা ডিজাইন নিয়ে কাজ করতে চাইলে সত্যজিৎ রায়ের কাছে আমাদের ফিরে আসতেই হবে বারবার। আরও অনেক কিছুই বলার ছিল, রীতিমতো একটা বড় বইও লিখে ফেলা যায় তাঁর এই আঁকাআঁকি নিয়ে এবং দারুণ খবর হলো এ রকম একটা বই কিন্তু আছে! সেটা লিখেছেন ভারতের আরেক দিকপাল কার্টুনিস্ট ও ইলাস্ট্রেটর দেবাশীষ দেব। সেই বইয়ের নাম রং তুলির সত্যজিৎ। যারা আঁকাআঁকি নিয়ে একটু হলেও আগ্রহী তাদের আমি বলব এই বইটা যেন অবশ্যই অবশ্যই পড়ে। আমার এই লেখার অনেকটাই সেই বইয়ের মারফতে পাওয়া, তাই এখানে তা লিখে দিলাম।