মানুষ না যন্ত্রমানব, কার হাতে ভবিষ্যত্ পৃথিবী?

সিনেমায় হরহামেশা দেখা মেলে এই সাইবর্গদের। এরা এমন একটি সত্তা, যার মধ্যে জৈবিক অংশের সঙ্গে যান্ত্রিক অংশের সমন্বয় ঘটেছে।
সিনেমায় হরহামেশা দেখা মেলে এই সাইবর্গদের। এরা এমন একটি সত্তা, যার মধ্যে জৈবিক অংশের সঙ্গে যান্ত্রিক অংশের সমন্বয় ঘটেছে।

আচ্ছা, তোমাদের কি ডিপ ব্লুর কথা মনে আছে? মনে না থাকলে বলছি। ডিপ ব্লু হলো দাবা খেলার উপযোগী যন্ত্রচালিত কম্পিউটারবিশেষ। ১৯৯৬ সালে যন্ত্রটি দাবার গ্র্যান্ডমাস্টার গ্যারি কাসপারভকে হারিয়ে দেয়। অথচ একবার কাসপারভের কাছে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, ২০০০ সালের আগে কম্পিউটার কি কোনো গ্র্যান্ড মাস্টারকে হারাতে পারবে? কখনো না। খুব দম্ভভরে সেদিন বলেছিলেন তিনি। 

গ্যারি কাসপারভের সঙ্গে ডিপ ব্লুর দাবা খেলার একটি মুহূর্ত। সেদিন বুদ্ধির খেলায় যন্ত্রের কাছে হেরে গিয়েছিল মানুষ।
গ্যারি কাসপারভের সঙ্গে ডিপ ব্লুর দাবা খেলার একটি মুহূর্ত। সেদিন বুদ্ধির খেলায় যন্ত্রের কাছে হেরে গিয়েছিল মানুষ।

এই দম্ভ কারপারভের একার নয়, আমাদের সবার। আমরা সব সময় দম্ভ করে বলি, বুদ্ধিতে মানুষের সমান আর কেউ নেই। কিন্তু বিজ্ঞান কল্পকাহিনির বই পড়ে কিংবা সিনেমায় দেখা যায় অন্য চিত্র। দেখা যায়, যন্ত্ররা বুদ্ধি ও শক্তিতে মানুষের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

ম্যাট্রিক্স সিনেমার কথাই ধরো। এ ছবিটি এমন এক সময়ের যখন পৃথিবীর শাসনক্ষমতা চলে গেছে যন্ত্রমানবদের হাতে। তারা কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে মানুষকে ১৯৯৯ সালে আটকে রেখেছে। কিন্তু মানুষ বুঝতেও পারে না তারা যন্ত্রমানবের হাতে বন্দী। অন্যদিকে দ্য টার্মিনেটর সিনেমার রোবটগুলো অতি উন্নত প্রজাতির। বুদ্ধিতে মানুষের চেয়ে কম নয়। এরা সাইবর্গ নামে পরিচিত। আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য এরা মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধও ঘোষণা করে। যারা মুহম্মদ জাফর ইকবালের বই নিয়মিত পড়ো, তাদের নিশ্চয়ই প্রমিথিউসের কথা মনে আছে। প্রমিথিউস হলো পৃথিবীর প্রথম মানবিক রোবট। একদিন সেও মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। আবার হুমায়ূন আহমেদের ইরিনা নামের বইটিতে আছে রোবটদের কথা। সেই বইয়ে নিষিদ্ধ শহরে ইরিনার সঙ্গে একটি এনারোবিক রোবটের দেখা হয়। একদিন রোবটটি নিজেকে মানুষের সমকক্ষ বলে দাবি করে বসে।

এ তো গেল কল্পকাহিনির কাল্পনিক জগতের কথা। তবে বাস্তবেও রোবট গবেষণা আর উন্নয়ন বেশ দ্রুতগতিতেই এগোচ্ছে। কোনো কোনো বিজ্ঞানী বলছেন, একুশ শতকের মধ্যে রোবটরা বুদ্ধিমত্তায় মানুষের সমান হয়ে যাবে। আরও আজব আজব কিছু কথাও বলছেন কোনো কোনো গবেষক বা প্রযুক্তিবিদ।

জাপানের তৈরি রোবট আসিমো
জাপানের তৈরি রোবট আসিমো

সে কথাগুলো বলার আগে, চলো রোবট গবেষণার ভবিষ্যত্ গতিপথ দেখে আসি একটু। শুরু করি বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী মিশিও কাকুর একটি অভিজ্ঞতা দিয়ে। মিশিও কাকু তখন ডিসকভারির জন্য একটি অনুষ্ঠান বানাচ্ছিলেন। সে সময়ে তাঁর সঙ্গে আসিমো নামের এক রোবটের দেখা হয়। সেই দেখা হওয়ার কথা তিনি লিখে রেখেছেন তাঁর ফিজিকস অব দ্য ফিউচার বইয়ে। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘তার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, আমি যেন কোনো মানুষের সঙ্গেই হাত মেলাচ্ছি। তার হাত ধরে যখন হাত ঝাঁকাই, সেও প্রত্যুত্তরে আমার হাত ধরে ঝাঁকায়। তারপর যখন জুস খেতে চাইলাম, তখন সে ঘুরে মানুষের মতো করেই খাবার টেবিলের দিকে গেল। তা ছাড়া যখন সে কথা বলে, তখন তাকে মেশিন বলে মনে হয় না। এমনকি সে আমার চেয়েও ভালো নাচতে পারে।’

এ থেকে বোঝা যায়, যন্ত্রের অগ্রগতি হচ্ছে দ্রুতগতিতে। কিন্তু সিনেমায় দেখা রোবটের পর্যায়ে যেতে এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। ডিপ ব্লুর কথাই ধরো। খেলায় বিজয়ী হলেও সে প্রেস কনফারেন্সে গিয়ে সাক্ষাত্কার দিতে পারেনি। আবার দাবা খেলার বাইরে যেকোনো কাজে সে কিন্তু পুরোই গোল্লা পাবে। তাই দাবা বুদ্ধির খেলা হলেও ডিপ ব্লু কিন্তু বুদ্ধিমানের তকমা পায়নি এখনো।

আইবো নামের এই কুকুর রোবট মালিকের ডাকে সাড়া দিতে পারে।
আইবো নামের এই কুকুর রোবট মালিকের ডাকে সাড়া দিতে পারে।

মানুষের বুদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে কম্পিউটার বা রোবটের একটা প্রতিবন্ধকতা হলো, মানুষ প্যাটার্ন দেখে বুঝতে পারে। আবার উপস্থিত বুদ্ধির প্রয়োগ করতে পারে মানুষ, যা যন্ত্রের পক্ষে এখনো সম্ভব হয়ে ওঠেনি। মানুষের তুলনায় রোবটের দেখার ক্ষমতা বেশি হলেও সে আসলে কী দেখছে সেটাই বুঝতে পারে না। উদাহরণ দিয়ে বলি, যখন কোনো রোবট ঘরের ভেতরে হাঁটে, তখন সে আসলে কোন চেয়ার দেখতে পায় না। সে আসলে দেখে নানা সাইজের বিন্দু। সেই বিন্দুগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করে এগুলো যে আসলে চেয়ার-টেবিল, সেটা বুঝতে অনেক সময় লাগে। অন্যদিকে, আমরা ঘরে ঢোকার মুহূর্তের মধ্যে চিনে নিতে পারি কোনটা চেয়ার, কোনটা টেবিল, আবার কোনটা আলনা। আবার রোবটের কমন সেন্সের বালাই নেই। তাই আমাদের চেয়ে ভালো শোনার ক্ষমতা থাকলেও তারা বুঝতে পারে না, কী শুনছে। এই দুটি বিষয় রোবটের চেয়ে মানুষকে অনেক এগিয়ে রেখেছে।

কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে রোবট কি এই প্রতিবন্ধকতাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারবে না? কী মনে হয় তোমার? আচ্ছা উত্তর দেওয়ার আগে চলো রোবট সার্জনের সঙ্গে দেখা করে আসি। সেই সার্জনের একটা নামও আছে—দ্য ভিঞ্চি রোবট। আগে তার একটি অসুবিধা ছিল, হাত ভাঁজ করতে পারত না। ফলে চিকিত্সা করতে অসুবিধা হতো। কিন্তু সেই সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। ২০০৬ সালেই দ্য ভিঞ্চি রোবট ৪৮ হাজার সার্জারি চিকিত্সা সম্পন্ন করেছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এভাবে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে রোবটরা মানবিক অনুভূতিসম্পন্ন হয়ে উঠবে। যেমনটা দেখানো হয়েছে স্টারট্রেক: দ্য নেক্সট জেনারেশন সিনেমায়। সেই সিনেমার ডেটা নামের রোবটটি তার প্রভুর হাস্যরস বোঝার চেষ্টা করে। যদিও অনেক কল্পবিজ্ঞান লেখক মনে করেন, যন্ত্রমানবেরা মানুষের চেয়ে স্মার্ট হলেও তারা কখনো কাঁদতে পারবে না। কল্পবিজ্ঞান লেখকদের দাবি অবশ্য উড়িয়ে দিয়েছেন মিশিও কাকু। কারণ, সাম্প্রতিক সময়ে বিজ্ঞানীরা মানবিক অনুভব কী, কেমন, তা বোঝার চেষ্টা করছেন। উদাহরণ হিসেবে আইবো নামের কুকুর রোবটটির কথা বলা যায়। এই রোবট অনেক কিছু অনুভব করতে পারে। যেমন ধরো, তার মালিক ডাকছে। সে দৌড়ে আসবে। মালিকের পায়ের কাছে এসে লেজ নাড়াবে। কিন্তু আইবোর দৌড় ওই পর্যন্তই। যদিও বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভবিষ্যতে এমন রোবট কুকুর, বিড়াল, পাখি আসবে, যারা শিশুদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে উঠবে।

টার্মিনেটর সিনেমায় আবার ফিরে যাই। সেখানে স্কাইনেট নামের কম্পিউটার প্রোগ্রাম দেখানো হয়। একদিন এই প্রোগ্রাম আত্মসচেতন হয়ে ওঠে। প্রোগ্রাম দেখভালের দায়িত্ব যাদের হাতে ছিল, তারা অবাক হয়। তারা চেষ্টা করে সেটা বন্ধ করার। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। স্কাইনেট পারমাণবিক বোমা মেরে মানবজাতিকে ধ্বংসের চেষ্টা করে। তাই প্রশ্ন ওঠে, মানুষের হাতে তৈরি যন্ত্র যদি মানুষের চেয়ে স্মার্ট হয়, কিংবা আত্মসচেতন হয়ে ওঠে, তবে কী হবে? বিজ্ঞানীরাও এটা নিয়ে বিতর্ক করছেন। কিন্তু কোনো কূলকিনারা হয়নি। কিছু কিছু গবেষক বলছেন, আমাদের তৈরি রোবটগুলোও বিবর্তনের ধারা অনুসরণ করবে। আজ তারা তেলাপোকার থেকে স্মার্ট হলে আগামীকাল ইঁদুর, বিড়াল, কুকুর, বানরের চেয়ে স্মার্ট হবে। এভাবে একদিন মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে। তবে সময় লাগবে অনেক। যদিও এই গবেষকেরা বিশ্বাস করেন, বুদ্ধিমত্তায়ও রোবটরা মানুষকে ছাড়িয়ে যাবে একদিন। এদিকে কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা করেন এমন বিজ্ঞানীদের মধ্যে এ নিয়ে দ্বিধাবিভক্তি রয়েছে।

দ্য ভিঞ্চি নামে পরিচিত এই রোবট ২০০৬ সালে ৪৮ হাজার সার্জারি চিকিত্সা করেছে।
দ্য ভিঞ্চি নামে পরিচিত এই রোবট ২০০৬ সালে ৪৮ হাজার সার্জারি চিকিত্সা করেছে।

কম্পিউটার বিজ্ঞানী রে কুর্জওয়েল ২০০৫ সালে সিঙ্গুলারিটি অব নিয়ার নামে একটি বই প্রকাশ করেন। সিঙ্গুলারিটি হলো এমন একটি সময়কাল, যখন যন্ত্রমানবেরা বুদ্ধিমত্তার দিক দিয়ে মানুষকে ছাড়িয়ে যাবে। সেই বইয়ে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, ২০১৯ সালের মধ্যে মাত্র এক হাজার ডলারে এমন কম্পিউটার পাওয়া যাবে, যার ক্ষমতা মানুষের মস্তিষ্কের মতোই হবে। ২০২৯ সালের মধ্যে পাওয়া যাবে মানুষের মস্তিষ্কের চেয়ে এক হাজার গুণ বেশি ক্ষমতার কম্পিউটার, যার মূল্য হবে মাত্র হাজার ডলার। আর ২০৪৫ সালের মধ্যে মাত্র এক হাজার ডলারে পাওয়া যাবে, মানুষের মস্তিষ্কের চেয়ে কোটি কোটি গুণ বেশি যার ক্ষমতার কম্পিউটার।

না, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বিজ্ঞানীরা বলছেন, যন্ত্রমানবেরা মানুষের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে না। যদি তাদের মধ্যে কখনো ধ্বংসাত্মক প্রবণতা দেখা দেয়, মানুষ চাইলে তখন তাদের নিষ্ক্রিয় করতে পারবে। কারণ, যন্ত্রমানবদের শরীরে এমন এক চিপ দেওয়া থাকবে, হুকুম দেওয়ামাত্রই রোবটদের নিষ্ক্রিয় করে দেবে। অথবা এমন ধরনের শিকারি রোবট বানাবে, যাদের কাজ হবে পথভ্রষ্ট রোবটদের ধ্বংস করা। শিকারি রোবটগুলো হবে আরও শক্তিশালী, দ্রুতগতিসম্পন্ন। পুরো রোবোটিক সিস্টেমের দুর্বল দিকগুলো সম্পর্কে এদের জানা থাকবে। যেমনটা দেখা গেছে ব্লেড রানার সিনেমায়। তাই বলা যায়, শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর রাজত্ব মানুষের হাতেই থাকবে।

তথ্য সূত্র: ফিজিকস অব দ্য ফিউচার: মিশিও কাকু