মানুষের মূল্য কত?

  • পথের হদিস পথই জানে, মনের কথা মত্ত

    মানুষ বড় শস্তা, কেটে, ছড়িয়ে দিলে পারত।

    - শক্তি চট্টোপাধ্যায়

একজন মানুষের মূল্য কত? এই প্রশ্নটি কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মাথায় আসে। ভিন্ন প্রসঙ্গে পত্রপত্রিকায়ও উঠে আসে কথাটি। একই প্রশ্নের অনেক রূপের মতো বিভিন্ন প্রসঙ্গে, নানাভাবে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে। কিন্তু ব্যঙ্গার্থে নয়, একজন বৈজ্ঞানিকের চোখে এ প্রশ্নটির একটি সুনির্দিষ্ট অর্থ আছে। প্রশ্নটা এমন:

একটি পূর্ণাঙ্গ মানবদেহ তৈরির জন্য যেসব রাসায়নিক পদার্থ দরকার, তার দাম কত?

বিজ্ঞানী বিল ব্রাইসন তাঁর দ্য বডি বইতে লিখেছেন, ছোটবেলায় এক শিক্ষকের কাছে শুনেছিলেন, এসব রাসায়নিক নাকি মাত্র ৫ ডলারে কিনে ফেলা যায়! তবে সংখ্যাটা পুরোপুরি মনে করতে পারেননি তিনি। তাঁর মতে, এটা প্রায় ৩ ডলারও হতে পারে, আবার ১৩ ডলারও হতে পারে! ব্যাংকে এখন ডলারপ্রতি প্রায় ৮৫ টাকা ধরা হয়। সেই হিসাবে ১৩ ডলার মানে ১ হাজার ১০৫ টাকা।

কথা হলো, আসলেই কি মানবদেহের দাম এত কম? এত সস্তা? আসুন, বিজ্ঞানের চোখে পুরো ব্যাপারটা একটু ঘেঁটে দেখা যাক!

২০১৩ সালের কথা। কেমব্রিজ সায়েন্স ফেস্টিভ্যালে সেবার প্রধান অথিতি হয়ে এসেছিলেন অভিনেতা বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ। টিভির জগতে যিনি ‘শার্লক’ সিরিজের জন্য অসম্ভব জনপ্রিয়, তাঁকে যুক্তরাজ্যে আরেকটি কারণে দারুণ সম্মান দেওয়া হয়। এ মানুষটি এখনো সময় পেলেই মঞ্চে অভিনয় করেন। শেক্‌সপিয়ারের হ্যামলেট–এর মতো মহান নাটকেও কাজ করেছেন তিনি।

রয়্যাল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রি (RSC) ভাবল, হিসাবটা তাহলে এই গুনিনকে নিয়েই করা যাক। এখানে বলে নেওয়া দরকার, রয়্যাল সোসাইটি প্রতিটা পদার্থের সবচেয়ে খাঁটি, নির্ভেজাল রূপ ধরে হিসাব করেছে। টাকা বাঁচানোর জন্য ভেজাল কোনো পদার্থ পুরে দিতে চায়নি।

তো, আরএসসির হিসাবে, একজন মানুষকে তৈরি করতে ৫৯টা পদার্থ দরকার। এর ছয়টা হলো কার্বন, অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস। এই ছয়টার নাম আলাদা করে বলার কারণ, এরা আমাদের দেহের ৯৯ দশমিক ১ শতাংশ তৈরি করে ফেলে! হ্যাঁ, বাকি ৫৩টা পদার্থ মিলে তৈরি করে মাত্র শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ।

আর এই ৫৩টির বেশির ভাগই কেমন অদ্ভুত। যেমন মলিবডেনাম, ভ্যানাডিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, কপার বা তামা, এমনকি টিনও আছে আমাদের দেহে, ভাবা যায়? এদের কোনো কোনোটার পরিমাণ এতই কম যে এদের পার্টস পার মিলিয়ন (মানে, প্রতি মিলিয়নে কতটি) বা পার্টস পার বিলিয়নে হিসাব করতে হয়। যেমন প্রতি ৯৯৯,৯৯৯,৯৯৯* ১/২টি পরমাণুতে মাত্র ২০টি কোবাল্ট এবং ৩০টি ক্রোমিয়াম পরমাণু থাকে। কেউ যদি ভাবেন, শুধু ২০টা পরমাণুর জন্য এত ঝামেলা করার দরকারটা কী, তাহলেই সেরেছে! এসব অতিসামান্য পরিমাণ পদার্থের অসীম গুরুত্বের সবকিছু আমরা এখনো বের করতে পারিনি। কিন্তু যতটুকু পেরেছি, তা থেকে জানি, এগুলো ছাড়া মানবদেহের হিসাব করতে গেলে ঝামেলা আছে।

জিনিসপত্র তো হলো, এবার তাহলে হিসাব শুরু করে দেওয়া যাক। প্রথমেই বলতে হবে অক্সিজেনের কথা। আমাদের শরীরের ৬১ শতাংশই হলো অক্সিজেন-বর্ণ, গন্ধহীন এক গ্যাস। এখন কথা হলো, গ্যাসের পুতুল আকাশে না উড়ে মাটিতে হাঁটে কীভাবে? আসলে অক্সিজেন মূলত হাইড্রোজেনের সঙ্গে যুক্ত থাকে। আর এই হাইড্রোজেন শরীরের ১০ শতাংশ জায়গা দখল করে আছে। হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন মিলে তৈরি করে পানি, এ কথা আমরা প্রায় সবাই জানি। কখনো ভেজা কাপড়ে হাঁটলে বা পানিভর্তি বালতি টানতে গেলে বোঝা যায়, পানি কত ভারী। প্রকৃতির সবচেয়ে হালকা দুটো জিনিস একসঙ্গে হয়ে সবচেয়ে ভারী জিনিসগুলোর একটা তৈরি করে, কেমন অদ্ভুত না?

যা–ই হোক, এই ৬১ শতাংশ অক্সিজেন কিনতে আপনার লাগবে মাত্র ১৪ ডলার, মানে ১ হাজার ২০০ টাকার মতো। আর বাকি ১০ শতাংশ হাইড্রোজেন পড়বে ২৬ ডলার, মানে ২ হাজার ২০০ টাকার মতো। তবে সে জন্য অবশ্য আপনাকে বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচের মতো লম্বা হতে হবে। খাটো হলে এই টাকা আরও কমে যাবে। আবার কাম্বারব্যাচের চেয়ে প্রস্থে মুটিয়ে গেলে, ওদিক থেকে উশুল হয়ে যাবে সেটা!

আরও পড়ুন

তারপর আছে নাইট্রোজেন, ২ দশমিক ৬ শতাংশ। এর দাম পড়বে মাত্র ৪০ সেন্ট বা ৩৫ টাকার মতো। সস্তা, না? কিন্তু সস্তার কারবার এখানেই শেষ।

আমাদের দেহে এক কার্বনই আছে ৩০ পাউন্ড বা ১৩ দশমিক ৬ কেজির মতো। ডলারেই এর দাম আসে ৬৯ হাজার ৫৫০ ডলার! আর বাংলাদেশি টাকায়? ৫৮ লাখ ৯৮ হাজার ৪৩০ টাকার মতো! (এবার নিজেকে কিছুটা দামি মনে হচ্ছে, নাকি?) ক্যালসিয়াম, ফসফরাস আর পটাসিয়ামের খুব সামান্য পরিমাণ লাগবে আমাদের। কিন্তু সেটুকুর দামই হবে ৭৩ হাজার ৮০০ ডলার। অর্থাৎ ৬২ লাখ ৩৬ হাজার ১০০ টাকা। বাকি যা লাগবে, সেগুলোর প্রতি গ্রামের দাম আরও বেশি। আমাদের সৌভাগ্য, ওগুলোর কেবল মাইক্রোস্কোপিক পরিমাণ লাগবে, বেশি লাগবে না।

এটা বেশ সহজলভ্য। গমের রুটি, বাদাম এবং বিভিন্ন মাছেও এটি থাকে। কিন্তু সহজলভ্য বলেই অতিরিক্ত সেলেনিয়াম খাওয়া যাবে না। অতিরিক্ত সেলেনিয়াম যকৃতের জন্য ক্ষতিকর।

যেমন থোরিয়াম। এর প্রতি গ্রামের দাম ২ লাখ ৫৩ হাজার ৫০০ টাকা বা ৩ হাজার ডলার। কিন্তু আমাদের দেহের কেবল ০.০০০০০০১ অংশ থোরিয়াম। এটুকু মাত্র ৩৩ সেন্ট বা ২৮ টাকাতেই পাওয়া যাবে। একইভাবে প্রয়োজনীয় টিনের দাম পড়বে কেবল ৬ সেন্ট বা ৫ টাকায় এবং জিরকোনিয়াম ও নায়োবিয়াম পড়বে ৩ সেন্ট বা আড়াই টাকা করে। ০.০০০০০০০০৭ শতাংশ সামারিয়ামের দামই ধরার দরকার নেই। সে জন্য আরএসসির দাম হিসাব করেছে ০ টাকা।

৫৯টি পদার্থের মধ্যে ২৪টি পদার্থ আসলে আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর বাকিগুলো নিয়ে এখনো বিজ্ঞানীদের পরিষ্কার ধারণা নেই। এদের কিছু আমাদের জন্য ভালো, আর কিছু ভালো হতে পারে বলে মনে হলেও এদের কাজটা আসলে কী, সেটা এখনো আমাদের অজানাই রয়ে গেছে। আবার কিছু আছে ভালোও না, ক্ষতিকরও না। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, কিছু ক্ষতিকর পদার্থও আমাদের দেহে স্বাভাবিকভাবে পাওয়া যায়। যেমন ক্যাডমিয়াম। ০.১ শতাংশ ক্যাডমিয়াম থাকে আমাদের দেহে, কিন্তু এটা খুবই বিষাক্ত। আমাদের আসলে এটা কোনো দরকারই নেই। কথা হলো, আমরা তো সেধে সেধে ক্যাডমিয়াম খাই না, তাহলে এই জিনিস আসে কীভাবে? মাটি থেকে উদ্ভিদ এটা টেনে নেয়। আমরা যখন উদ্ভিদ খাই, তখনই সেটা আমাদের দেহে প্রবেশ করে। দেখা গেছে, উত্তর আমেরিকার মানুষেরা প্রতিদিন ৮০ মাইক্রোগ্রাম করে এই বিষাক্ত ক্যাডমিয়াম খায়।

এরপর আছে সেলেনিয়াম। আগেই বলেছি, বিজ্ঞানীরা এখনো অনেকগুলো পদার্থের কাজের ব্যাপারে তেমন কিছুই জানতে পারেননি। সেলেনিয়াম এর একটা আদর্শ উদাহরণ হতে পারত। দেহের যেকোনো জায়গা থেকে একটা কোষ বের করে নিয়ে, ভেতরে উঁকি দিলেই দেখা যাবে, ওতে অন্তত মিলিয়নখানেক বা আরও বেশিসংখ্যক সেলেনিয়াম পরমাণু আছে। একটু আগে পারত বলেছি, কারণ, সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, আমাদের দেহের দুটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ এনজাইম এই সেলেনিয়ামই তৈরি করে। আর দেহে সেলেনিয়ামের ঘাটতি হলে দেখা দিতে পারে আর্থ্রাইটিস, অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা, হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ, এমনকি ক্যানসারও হতে পারে। কাজেই দেহ বানাতে গেলে কিছুটা সেলেনিয়াম রাখা ভালো।

এটা বেশ সহজলভ্য। গমের রুটি, বাদাম এবং বিভিন্ন মাছেও এটি থাকে। কিন্তু সহজলভ্য বলেই অতিরিক্ত সেলেনিয়াম খাওয়া যাবে না। অতিরিক্ত সেলেনিয়াম যকৃতের জন্য ক্ষতিকর।

এই সবকিছু নিয়ে বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচকে ছাঁচ হিসেবে ব্যবহার করলে, আরএসসির হিসাব অনুযায়ী খরচ পড়বে প্রায় ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫৭৮ ডলার। অর্থাৎ প্রায় ১৩,৩৬৩,৯৫০ (এক কোটি তেত্রিশ লাখ তেষট্টি হাজার সাড়ে নয় শ) টাকা মাত্র!

ঘটনা এখানেই শেষ নয়। মানবদেহ বানানোর পেছনে আপনার কিন্তু শ্রমিক খরচ, আয়কর ইত্যাদিও পড়বে। সেসব হিসাব করলে মোট খরচ দাঁড়াবে ৩০০,০০০ ডলার। বাংলাদেশি টাকায় আর না বলি!

এই টাকাটা আসলে মানবদেহের যথার্থ মূল্য নয়। কারণ, আপনি যত টাকাই দেন, যত যত্ন করেই পদার্থগুলো একত্র করেন, মানুষ আপনি বানাতে পারবেন না। পৃথিবীখ্যাত মেধাবী সব মানুষকেও যদি আপনি একসঙ্গে এই প্রজেক্টে নামিয়ে দেন, তারপরও সেটা সম্ভব নয়। (অন্তত এখন পর্যন্ত। ক্লোনিংয়ের কথা এখানে বলা হচ্ছে না, প্রয়োজনীয় পদার্থগুলো জুড়ে দিয়ে মানুষ বানানোর কথা বলা হচ্ছে।)

আমাদের ব্যাপারে এটাই সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার। মানবদেহে যেসব পদার্থ আছে, এগুলো আপনি মাটির নিচে, কিংবা এর কোনো কোনোটা ময়লার স্তূপেও খুঁজে পাবেন। আপনি যে পদার্থগুলো দিয়ে তৈরি, এই মুহূর্তে আপনার দেহে যেসব পদার্থ আছে, এদের বিশেষত্বটা তাহলে কী? এদের বিশেষত্ব একটাই, এই পদার্থগুলো মিলে আপনাকে তৈরি করেছে।

সে জন্যই মানুষ জীবনের কোনো দাম হয় না।

তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া; দ্য বডি, বিল ব্রাইসন

আরও পড়ুন