মায়াস্বরী মানসুরা

বুড়ো গ্র্যানির চরিত্রটা বেশ মজার। গ্র্যানি দাবি করে, সে ছোট-বড় সবার গ্র্যানি। নাম ও চেহারা অনুযায়ী গ্র্যানি বুড়ো হলেও সে নিজেকে বেশ তরুণই মনে করে। নিজেকে কোনোভাবেই বুড়ো বলতে সে রাজি নয়। বয়স জিজ্ঞেস করলে গ্র্যানির সব সময় এক উত্তর, এসব নাকি জিজ্ঞেস করতে হয় না। কেউ তাকে বুড়ো বললে বেশ খেপে যায় সে। ব্যাপক ঝাড়ি শুরু করে দেয় তখনই।

গ্র্যানি হচ্ছে মানসুরার পাপেটের নাম। শহীদ বীর উত্তম লেফটেন্যান্ট আনোয়ার গার্লস কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে মানসুরা মুবাশ্বিরা। মানসুরা একজন ভেন্ট্রিলোকুইস্ট। যারা ভেন্ট্রিলোকুইজম করে, তাদের ভেন্ট্রিলোকুইস্ট বলা হয়। ভেন্ট্রিলোকুইজম ব্যাপারটা আগে তোমাদের বুঝিয়ে বলি। মঞ্চে পারফরম্যান্সের সময় ভেন্ট্রিলোকুইস্টের সঙ্গে থাকে পুতুল। ভেন্ট্রিলোকুইস্ট এমনভাবে নিজের কণ্ঠকে ব্যবহার করে কথা বলে যেন মনে হয়, তার সঙ্গে থাকা পুতুলের কণ্ঠ থেকে শব্দটি আসছে। একই সময়ে সঙ্গে থাকা পুতুলের শরীর নাড়ানোর কাজটিও করতে হয় ভেন্ট্রিলোকুইস্টকে। পুরো ব্যাপারটাকে বলে ভেন্ট্রিলোকুইজম। বাংলায় এর নাম মায়াস্বর। আর যারা ভেন্ট্রিলোকুইজম করে, তারা মায়াস্বরী।

গ্র্যানি ও মানসুরা

অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় ইউটিউব ঘাঁটতে ঘাঁটতে প্রথম ভেন্ট্রিলোকুইজম ব্যাপারটা আবিষ্কার করে মানসুরা। ডার্সি লিন নামের ভেন্ট্রিলোকুইস্ট এক মেয়েকে নিয়ে পুরো আমেরিকা মেতে ছিল সে সময়। মানসুরা এর আগেও একবার ভেন্ট্রিলোকুইজম সম্পর্কে পড়েছিল সত্যজিৎ রায়ের ভূতো বইয়ে। সেই থেকে মুখ বন্ধ করে কথা বলা শেখা শুরু। একা একা প্র্যাকটিস চলত আয়নার সামনে। পাপেট ছাড়া আয়নার সামনে মানসুরার মুখ বন্ধ করে কথা বলার চেষ্টা দেখে বাসার সবাই ভেবে নিলেন, এটা মানসুরার নতুন পাগলামির একটা।

ভেন্ট্রিলোকুইজমের ভূত মাথায় চাপার কিছুদিন পরই মানসুরার বাবার বিদেশ যাওয়ার সুযোগ এল। বাবার গলায় ঝুলে মানসুরার আবদার, ফেরার সময় ভেন্ট্রিলোকুইজমের পুতুল সঙ্গে নিয়ে ফিরতে হবে। মেয়ের কথামতে বাবা পুতুল সঙ্গে করেই ফিরলেন। নতুন পুতুল আসার পর বেশ কিছুদিন সেটা নিয়ে মানসুরার লাফালাফি চলল। তবে ভেন্ট্রিলোকুইজম ব্যাপারটা কিছুটা আয়ত্ত করার পর সে সময় আগ্রহ কিছুটা কমে যায় মানসুরার।

২০২০ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার পর লম্বা ছুটিতে বাসায় আটকে যায় মানসুরা। এ সময়ে ঘরে বসে গ্র্যানিকে নিয়ে ভিডিও বানানো শুরু করে সে। পুরোদমে স্ক্রিপ্টসহ ভেন্ট্রিলোকুইজম শুরু করে দেয় মানসুরা। ইউটিউব চ্যানেল খুলে সেখানে আপলোড দিতে থাকে ভিডিও। বিভিন্ন অনলাইন কনটেস্টে অংশ নেয়। কিন্তু মানসুরার ইচ্ছা ‘আমেরিকাস গট ট্যালেন্ট’–এর মতো কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার। আমেরিকাস গট ট্যালেন্টে অংশ নিতে না পারলেও কিছুদিন পরই ‘অনন্য প্রতিভা’ নামে এক রিয়েলিটি শোতে অংশ নেওয়ার সুযোগ পায় মানসুরা। গ্র্যানিকে সঙ্গে নিয়ে ভেন্ট্রিলোকুইজম করে বাছাইপর্ব ও মূল পর্ব পেরিয়ে মানসুরা হয়ে যায় চ্যাম্পিয়ন। জিতে নেয় পাঁচ লাখ টাকা!

শহীদ বীর উত্তম লেফটেন্যান্ট আনোয়ার গার্লস কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে মানসুরা

পাল্টে যায় মানসুরার জগৎ। শখের বশে শুরু করা ভেন্ট্রিলোকুইজম দিয়ে রিয়েলিটি শোর চ্যাম্পিয়ন বনে যাওয়াটা মানসুরার জন্য ছিল অবিশ্বাস্য। মানসুরা মনে করে, গ্র্যানি চরিত্রটার জন্যই সে ভেন্ট্রিলোকুইজম করে এত আনন্দ পায়। গ্র্যানির চরিত্রের আইডিয়া কীভাবে মাথায় এল? মানসুরা বলে, ‘আমাদের দাদু–নানু যারা আছে, তাদের আমরা কেউ কেউ অ্যাভয়েড করি। ব্যাপারটা আমার ভালো লাগে না। তাই গ্র্যানির চরিত্রটা এমন। গ্র্যানি সব সময় কুল থাকতে চায়। নিজের বয়সে দাঁড়িয়ে থেকেই বিপরীত চরিত্রের ব্যাপারটা রিপ্রেজেন্ট করে গ্র্যানি।’

মানসুরার আরও যত গুণ

‘আমার সবকিছুর প্রতি অনেক বেশি আগ্রহ। নতুন যা দেখি, সেটাই আমার চেষ্টা করতে ইচ্ছা করে। কিছুদিন করার পর সেটা যদি ভালো লাগে, তাহলে সেটা করি। ভালো না লাগলে সেটা করি না’—মানসুরার এই আগ্রহের কারণে ওর আছে আরও অনেক গুণ। মানসুরা গান গায়, নাচে, ছবি আঁকে।

লোকনৃত্যে জেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন মানসুরা হরহামেশা পুরস্কার জেতে বিভিন্ন অলিম্পিয়াডে। মাঝেমধ্যে টেলিভিশনের পর্দায় নাচতে দেখা যায় মানসুরাকে। মানসুরার নতুন শখ হারমোনিকা। ইদানীং হারমোনিকা শেখার চেষ্টা চলছে।

মাঝেমধ্যে টেলিভিশনের পর্দায় নাচতে দেখা যায় মানসুরাকে

পড়ালেখাতেও কিন্তু বেশ ভালো মানসুরা। জেএসসি ও এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া মানসুরার নাম কলেজের অন্যান্য পরীক্ষার রেজাল্টের সময় সামনের দিকেই থাকে সব সময়। স্কুলে পড়ার সময় পুরো স্কুলের ক্যাপ্টেন মানসুরা এখন কলেজে এসে কলেজ ক্যাপ্টেন। ছোট থেকেই মা-বাবা ও বড় ভাইকে বই পড়তে দেখছে মানসুরা। তাই বইয়ের প্রতিও বেশ আগ্রহ তার। বইয়ের প্রতি ভালোবাসা থেকে গত বছর মানসুরা যোগ দেয় ঢাকা কিশোর আলো বুক ক্লাবে। এত কিছুর মধ্যে মানসুরা সবচেয়ে বেশি আনন্দ পায় কী করে? মানসুরার সোজা উত্তর, ‘আমার কাজে মা–বাবা যতক্ষণ খুশি থাকে, ততক্ষণ আমার সবকিছুতেই আনন্দ লাগে।’

মানসুরার আইডল ১৭ বছর বয়সী আমেরিকান ভেন্ট্রিলোকুইস্ট ডার্সি লিন। ডার্সি লিন আমেরিকায় বিভিন্ন এতিমখানা ও বাচ্চাদের হাসপাতালে গিয়ে ফ্রিতে ভেন্ট্রিলোকুইজম পারফর্ম করে। সেই সঙ্গে সেখানকার বাচ্চাদের দিয়ে আসে পাপেট। আমেরিকাস গট ট্যালেন্টজয়ী ডার্সি লিন তার জেতা বেশির ভাগ অর্থ এভাবেই ব্যয় করেছে। মানসুরা চায় ডার্সি লিনের মতো করে সুবিধাবঞ্চিত ও এতিম শিশুদের পাশে দাঁড়াতে ও সবার মধ্যে আনন্দ ছড়িয়ে দিতে।