মাস্টার অব দ্য ওয়ার্ল্ড

এক অর্থে আমার জীবনের সব আবিষ্কারের মহাপরিচালক ছিলেন তিনি।
সাইমন লেক, প্রথম আধুনিক সাবমেরিনের নকশাকার
উনি যা কল্পনা করেছেন, আমি সেটাকে রূপ দিয়েছি মাত্র।
ইগর সিকরস্কি, প্রথম সফল হেলিকপ্টার নকশাকার
একেবারে অতি বাস্তবিক অর্থে তিনিই হলেন মহাকাশের যুগের পথিকৃত।
ফ্রাঙ্ক বোরম্যান, অ্যাপোলো-৮ মহাকাশযানের নভোচারী
তিনিই আমাকে এই অভিযানে বের হওয়ার সাহস জুগিয়েছেন।
রিচার্ড ই. বের্ড, আকাশপথে প্রথম দক্ষিণ মেরু বিজয়ী
আমার জন্মের কয়েক ডজন বছর আগে তিনি মারা গেছেন। কিন্তু আমার ক্যারিয়ারজুড়েই তাঁর প্রভাব ছিল। যে পাঁচজন মানুষকে দেখার ইচ্ছা আমার পূরণ হলো না, তাঁর একজন তিনি।
আর্থার সি ক্লার্ক, সায়েন্স ফিকশন গ্র্যান্ডমাস্টার
আমরা সবাই, সত্যি বলছি, সবাই কোনো না-কোনো অর্থে তাঁর সন্তান
রে ব্র্যাডবেরি, সায়েন্স ফিকশন লেখক

কে? কে এই মহামানব! কে এই বিজ্ঞানী, যিনি বিজ্ঞানীকে সাবমেরিন-হেলিকপ্টার বানাতে শেখান? কে এই অভিযাত্রী, যিনি মহাকাশ আর মেরু জয়ে সাহস জোগান অভিযাত্রীদের? কে এই লেখক, যিনি সর্বকালের সেরা লেখকদের লেখা শেখান!

বিশ্বাস করো আর না-ই করো, তিনি নিজে বিজ্ঞানী নন। তিনি অভিযাত্রীও নন। তিনি ‘সামান্য’ একজন লেখক। তা-ও আজ থেকে ১০৮ বছর আগে পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া এক পুরোনো, সেকেলে লেখক। কিন্তু বুঝতেই পারছ, এই শত বছর পুরোনো লেখকের লেখার এমনই দাপট যে পরবর্তীকালের বিজ্ঞানী, অভিযাত্রী থেকে শুরু করে লেখকদের অনুপ্রেরণা ও পথপ্রদর্শক হয়ে আছেন। হ্যাঁ, তিনি তোমাদের প্রিয় লেখক জুলস গ্যাব্রিয়েল ভার্ন; জুল ভার্ন!

তাঁর ‘অবিশ্বাস্য অভিযাত্রা’ সিরিজের উপন্যাসগুলো নিশ্চয়ই তোমরা পড়ে ফেলেছ। এসব অভিযান উপন্যাসে জুল ভার্ন যদি একটু আবিষ্কার না করতেন, একটুও নতুন কিছু না-ও বলতেন; তা-ও আমাদের সারা পৃথিবীর মতো মেনে নিতে হতো যে তিনি কিশোর সাহিত্যের একজন গ্র্যান্ডমাস্টার।

কিন্তু এই অভিযানময় সাহিত্যগুলো আমাদের শুধু সাহিত্য ছাপিয়ে আধুনিক বিজ্ঞান, দর্শন আর আবিষ্কারেরও অসাধারণ এক গবেষণাগার হয়ে উঠেছে। সেই ‘বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ’ দিয়ে শুরু হয়েছিল জুল ভার্নের এই অভিযান-উপন্যাসমালা। এরপর নাইজারের বাঁকে, সাগরতলে, মিস্টেরিয়াস আইল্যান্ড থেকে শুরু করে গুনে গুনে ৬২টি উপন্যাস লিখেছেন তিনি এই ‘অবিশ্বাস্য অভিযাত্রা’ সিরিজে।

আর প্রতিটি উপন্যাসই পরবর্তীকালে বিজ্ঞানীদের চমকে দিয়েছে। কারণ, একটার পর একটা তখনো আলোর মুখ না দেখা যন্ত্রপাতি, জগত্, তত্ত্ব স্রেফ কল্পনায় আবিষ্কার করে গেছেন এই মহান ফরাসি সাহিত্যিক। ওপরে যাঁদের উদ্ধৃতি দিয়েছি, তাঁদের কথা তো জানলেই। এ ছাড়া জেনে অবাক হতে পারো যে এডুইন হাবলের মতো জ্যোতির্বিজ্ঞানী বা ইউরি গ্যাগারিনের মতো মহাকাশচারীরও জীবনের প্রধান অনুপ্রেরণা ছিলেন এই জুল ভার্ন।

সাবমেরি আবিষ্কারের অনেক আগেই জুল ভার্ন লিখে গেছেন সাবমেরিনের গল্প

এত সব কথা এক পাশে রেখে শুধু একটা কথা বললেই মনে হয় বিজ্ঞানে জুল ভার্নের অবদানটা পরিষ্কার হয়। আধুনিক বিশ্বের অন্তত ১৫-১৬টি যন্ত্র আবিষ্কার বা উন্নয়নের সঙ্গে জুল ভার্নের নাম জড়িয়ে আছে। এগুলো হলো—হেলিকপ্টার, শীতাতপনিয়ন্ত্রণযন্ত্র, উড়োজাহাজ, বুলেট ট্রেন, অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং, মহাকাশযাত্রা, আকাশচুম্বী দালান, টেলিভিশন, সবাক চলচ্চিত্র, শব্দের চেয়ে দ্রুত গতির সাবমেরিন, কম্পিউটার, গাইডেড মিসাইল, যোগাযোগ নেটওয়ার্ক, ক্যালকুলেটর!

অবশ্য স্রেফ এসব যন্ত্রপাতির ব্যাপার দিয়ে জুল ভার্নকে বোঝা যাবে না। সে চেষ্টাও আমাদের করা ঠিক হবে না। কারণ, আমরা তো আর বিজ্ঞান পড়তে বসিনি, আমরা জুল ভার্নের অসাধারণ সব গল্প পড়ব বলে ঠিক করেছি।

এই যেমন ধরো, আশি দিনে বিশ্বভ্রমণ। কী হলো ঘটনাটা? ফিলিয়াস ফগ নামে লন্ডনের এক ভদ্রলোক স্রেফ পত্রিকায় পড়ে বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে বসলেন, সেই ঊনবিংশ শতাব্দীতে তিনি আশি দিনে পৃথিবীটা এক চক্কর দিয়ে আসতে পারবেন!

আরে ভাই, এটা কি আজকের বোয়িং-টোয়িংয়ের যুগ নাকি! তখন বাহন বলতে ট্রেন আর জাহাজ। ফিলিয়াস ফগ ওই জাহাজ-ট্রেন ভরসা করেই ভৃত্য পাসপার্তুকে নিয়ে পৃথিবী ঘুরতে বেরিয়ে পড়লেন। আবিষ্কার করলেন, পত্রিকায় লিখলেও বেশির ভাগ জায়গায় আসলে রাস্তাই নেই। তার পরও জীবন-মরণ করে ফগ পৃথিবী চক্কর দিয়ে এলেন—৮০ নয়, ৭৯ দিনে! আর এই ৭৯ দিনের টান টান গল্পই হলো এই উপন্যাস। কখনো দস্যুদের সঙ্গে লড়াই, কখনো সতীদাহ থেকে নারীকে বাঁচানোর যুদ্ধ; কত কী যে ঘটনা!

আবার ধরো সাগরতলে বা টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি! একবার শোনা গেল, সমুদ্রে কী একটা অদ্ভুত বিকটাকার প্রাণী দেখা যাচ্ছে। তার পেছনে ছুটতে গিয়ে সাংবাদিক এক ভদ্রলোক পড়লেন এক সাবমেরিনের খপ্পরে। সেখানেই আবিষ্কার হলো যে নটিলাস নামে বিদ্যুচ্চালিত সর্বাধুনিক এক সাবমেরিন নিয়ে ক্যাপ্টেন নিমো ঘুরে বেড়াচ্ছেন সাগরের তল ধরে। এই ক্যাপ্টেন নিমো হলেন এক সাবেক ভারতীয় যুবরাজ। তিনি ভারতীয়দের স্বাধীনতাসংগ্রামের টাকা জোগাড় করেন।

ক্যাপ্টেন নিমোর সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে তুমি পাবে সাগরতলের অপরূপ বর্ণনা, পাবে তিমি বা হাঙরের সঙ্গে লড়াই, পাবে বিশাল হীরার সন্ধান। আবার মিস্টেরিয়াস আইল্যান্ড উপন্যাসে একদল বিজ্ঞানী যখন এক দ্বীপে আটকে যাবেন, তাঁরা নিজেদের জ্ঞান দিয়ে গড়ে তুলবেন এক সভ্যতা। আর সেখানেও শেষরক্ষা হয়ে আসবেন সেই ক্যাপ্টেন নিমো।

আরেকটা বইয়ের কথা বলি—দ্য বারজাক মিশন (এটা জুল ভার্ন শেষ করে যেতে পারেননি)! এই বইয়ে আফ্রিকার গহিনের কয়েকটি দেশকে স্বাধীনতা দেওয়া হবে কি না, তা দেখতে কয়েকজন ফরাসি জননেতা চলেছেন অরণ্যের ভেতরে। সেখানে একের পর এক আফ্রিকার গহিনের বর্ণনা পাবে তুমি, পাবে গা শিউরে ওঠা কাহিনি। প্রায় একই রকম আফ্রিকার ইতিবাচক বর্ণনা পাবে বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ বইয়ে।

এত কিছু পড়ার পর একটা কথা বিশ্বাস করতে তুমি বাধ্য—জুল ভার্ন বিজ্ঞানী, সৈনিক বা অভিযাত্রী না হতে পারেন; নিশ্চয় খুব ভ্রমণপিয়াসু মানুষ ছিলেন। আফ্রিকা, ভারত, দুই মেরু অঞ্চল, মরুভূমির যে অসাধারণ বর্ণনা দিয়েছেন তিনি; নিশ্চয়ই এসব ঘুরে ঘুরে দেখেছেন।

ঘোড়ার ডিম!

জুল ভার্ন ছিলেন নির্ভেজাল ঘরকুনো মানুষ। ১৮৫০ সালে ফ্রান্সে জন্ম, ১৯০৫ সালে সে দেশেই মৃত্যু। এর মধ্যে মাতৃভূমি ফ্রান্সের বাইরে শুধু ইউরোপের কটি দেশ ঘুরেছেন। তাঁর বেশির ভাগই নিতান্ত দায় ঠেকে। কোনো দেশে গেলেও চুপচাপ ঘরে থাকতেই পছন্দ করতেন। ঘোরাঘুরিটা তাঁর ধাতে ছিল না।

তাহলে! তাহলে কী করে এই অসামান্য সব ভ্রমণকাহিনি আর বিভিন্ন দেশের নিখুঁত বর্ণনা লিখে গেছেন? কী করে ভারতে না এসে কাশীর ঘাটের খুঁটিনাটি লেখেন তিনি, কীভাবে আফ্রিকায় না গিয়ে নাইজারের বর্ণনা লেখেন!

জুল ভার্নই এর উত্তর দিয়ে গেছেন। সোজা ভাষায় বলেছেন, ‘ম্যাপ ব্যাপারটার প্রতি আমার একটা ভালোবাসা আছে। লোকে ম্যাপ দেখে, আর আমি যেন ম্যাপ পড়তেই পছন্দ করি।’

এই ম্যাপ ভালোবাসার সঙ্গে জুল ভার্ন আরেকটা কাজ করতেন—পড়তেন; আসলে বলা ভালো ভ্রমণবর্ণনা, অভিযাত্রীদের ব্যাপারে পত্রিকায় বের হওয়া রিপোর্ট একেবারে পড়ে হজম করে ফেলতেন। সে সময় কোনো পত্রিকায় কোনো অভিযান নিয়ে ছোট একটা খবর বের হলেও সেটা নাকি জুল ভার্ন পরম যত্ন নিয়ে বারবার পড়তেন।

আহ। জুল ভার্নের এই ম্যাপ ভালোবাসা, এই বিজ্ঞানের প্রতি টান, এই অভিযানপ্রিয়তা, এই পড়ার নেশা! ভাগ্যিস এসব ছিল। ছিল বলেই আইনের ছাত্র, আইন পেশা ছেড়ে চলে এলেন এই বিশ্বজয়ের নেশায়। আর সেই নেশায় বিশ্ব এমনই বুঁদ হয়ে গেল যে বিশ্ব রেকর্ডই হয়ে গেল। কেমন বিশ্ব রেকর্ড?

ও আচ্ছা, শুরুর সে কথাই তো বলা হয়নি এখনো। ১৯৬৯ সালের পর থেকে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের পর পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় সবচেয়ে বেশি অনুবাদ হয়েছে এই জুল ভার্নের বই। অবশ্য কেউ কেউ বলেন, জুল ভার্নই সবচেয়ে বেশি অনুবাদ হয়েছে দুনিয়াজুড়ে।

সে বিতর্ক থাক। বাংলায় যে ঢের অনুবাদ হয়েছে, তা নিশ্চয়ই জানো। আমাদের প্রিয় সেবা প্রকাশনী থেকে প্রিয় সব অনুবাদকেরা একটু সংক্ষিপ্ত করে হলেও জুল ভার্নের অনেকগুলো বই দারুণ অনুবাদ করেছেন। সব বই অবশ্য সেবা থেকে অনুবাদ হয়নি। কোনো সমস্যা নেই। বাজারে একটা ভারতীয় সংকলন পাওয়া যায়। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় জুল ভার্নের সব অভিযান অনুবাদ করে ফেলেছেন। সেগুলো পড়তে পারো।

তোমাদের জন্য আরেকটা খবর আছে। বিশ্বে অন্তত আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল বা প্রতিষ্ঠান সরাসরি জুল ভার্ন বিষয়েই কোর্স খুলে বসে আছে; স্রেফ তোমার ভর্তি হওয়ার অপেক্ষা। আর অন্য কোনো বিষয়েও উচ্চতর পড়াশোনা শেষ করে জুল ভার্ন নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ তো আছেই।

তাহলে কোনটা করছ তোমরা? একটু জানিও তো। তারপর তোমার কাছ থেকে বুঝে নেব জুল ভার্ন কীভাবে ‘মাস্টার অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ হলেন!