মায়াদ্বীপের কুহকিনী

সে হাজার হাজার বছর আগের কথা। গ্রিস দেশ আর তার পাশের সাগরদ্বীপে সেকালে ঘটত আশ্চর্য সব ঘটনা। কাল্পনিক দৈত্য-দানো আর দেব–দেবীরা কত যে আজব ঘটনা ঘটাত! তেমন এক আজব ঘটনার কথাই আমরা শুনব এখন।

সুরের জাদুকর অরফিউস

সেকালের গ্রিসদেশে একদল মানুষের নাম ছিল অরগোনট। তারা দূরদূরান্তে অভিযান চালিয়ে সোনালি ভেড়ার চামড়া জোগাড় করত। একবার তারা জাহাজে চেপে সমুদ্রপথে একটা দ্বীপের কাছ দিয়ে যাচ্ছিল। দ্বীপটির নাম ছিল সাইরেনিয়া। সেখানে বাস করত সাইরেনরা। সাইরেনরা সংখ্যায় কতজন ছিল, তা নিয়ে একাধিক মত রয়েছে। কেউ বলছে তারা ছিল দুইজনা, আবার কেউ বলছে তারা ছিল পাঁচজনা। কেউ আবার তিনজনার কথাও বলেছে। অবশ্য তারা সবাই যে ছিল নদীদেবতা একিলেপাসের মেয়ে, সে ব্যাপারে মোটামুটিভাবে একমত সবাই। যারা বলে, সাইরেন ছিল তিনজনা, তারা সেই তিনজনের নামও জানিয়েছে। সেই নামগুলো ছিল আগলোপি, পেসিনো ও থেলজিওপিয়া। অবশ্য অন্য কিছু নামও পাওয়া যায়। অনেকের মতে, এরা ছিল মৎস্যকুমারী। তাদের দেহের নিচের অংশ ছিল মাছেদের মতো, আর ওপরের অংশ ছিল মেয়েদের মতো। অন্য মতে, সাইরেনদের দেহের ওপরের অংশ মেয়েদের মতো হলেও নিচের অংশ ছিল পাখির মতো। তো যা–ই হোক, দেখতে তারা ছিল অপূর্ব সুন্দরী। আর সৌন্দর্যকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল তাদের সুর। তাদের সুরের মধ্যে এমন জাদু ছিল যে একবার কেউ সেই সুর শুনতে পেলে অর্থাৎ কোনোরকমে তার কানে সুর পৌঁছাতে পারলে সে মাতাল হয়ে উঠত। দিগ্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সে তখন ছুটত সাইরেনদের দিকে। জাহাজ ঘুরিয়ে নাবিকেরা সাইরেনদের দ্বীপে ছুটত বটে, কিন্তু সাইরেনদের কাছে পৌঁছাতে আর পারত না। জাহাজ ভেঙে ডুবে যেত সমুদ্রে। কারও কারও মতে মানুষ কাছাকাছি হতেই সাইরেনেরা তাদের ধরে খেয়ে ফেলত। এভাবেই সাইরেনেরা আসলে মোহময় সুর তুলে মানুষকে মৃত্যুর দিকেই টানত।

অরগোনটদের নেতা জেসন

সেই মায়াবিনী সাইরেনদের মায়াদ্বীপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল অরগোনটদের দল। তাদের নেতার নাম ছিল জেসন। তখন দেবী আফ্রোদিতির মনে দলের মানুষদের প্রতি খুব মায়া হলো। কারণ, তিনি জানতেন, সাইরেনরা সুরের মায়ায় ফেলে মানুষগুলোকে মেরেই ফেলবে। লোকগুলোকে উদ্ধারের একটা উপায়ও উদ্ভাবন করলেন তিনি। বেছে নিলেন অরফিউসকে। এই অরফিউস কিন্তু সাধারণ কেউ ছিলেন না। তিনি ছিলেন সুরের জাদুকর। দেবতারা ছাড়া মানুষের মধ্যে কেউ এত সুন্দর সুর তুলতে পারত না। যদিও তিনি মানুষ ছিলেন, কিন্তু তাঁর বাবা ছিলেন দেবতা অ্যাপোলো। মা ক্যালিউপ ও বোনদের সঙ্গে মর্ত্যেই কেটেছে তাঁর দিন। যদিও তিনি বড় হয়েছেন পিম্পলিয়ায়, কিন্তু দেবতা বাবার ভালোবাসা ঠিকই পেয়েছিলেন। বাবাই তাঁকে শিখিয়েছিলেন বিশেষ এক বাদ্যযন্ত্র বাজাতে। বাদ্যযন্ত্রটির নাম ছিল লাইর। সেটি ছিল একধরনের বাঁশি। সে বাঁশিতে তিনি এমন সুর তুলতে পারতেন যে তা শোনার নেশা পেয়ে বসত মানুষকে। একেবারে মাতাল করে তুলত সেই সুর। তো সাইরেনিয়ার পাশ দিয়ে জেসনদের জাহাজ যাওয়ার সময় অরফিউসকে সুর তোলার আদেশ দিলেন দেবী আফ্রোদিতি। আদেশ পেয়ে অরফিউসও সুর তুলল লাইরে। সাইরেনরাও তাদের সুর তুলল। কিন্তু সাইরেনদের সুরকে ছাপিয়ে গেল অরফিউসের সুর। জাহাজের সবাই অরফিউসের সুরই শুনতে পেল, কাউকেই সাইরেনদের সুর টানতে পারল না। তবে একজন ছিল ব্যতিক্রম। সে তখন ব্যস্ত ছিল পাল তোলার কাজে। তাই সাইরেনদের সুর সে শুনে ফেলেছিল। আর শুনতেই ওই দ্বীপে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠল সে। জাহাজ থেকে লাফিয়ে পড়ল সমুদ্রে। আফ্রোদিতি বুঝতে পারলেন যে লোকটির নিশ্চিত মৃত্যু হতে চলেছে। তিনি তখন উদ্ধার করলেন লোকটিকে। ফলে দলের সবাই প্রাণে বেঁচে গেল। দেবীর সাহায্য না পেলে সাইরেনদের হাত থেকে এ দফায় রক্ষা পেত না তারা কেউই।

আফ্রোদিতি

তবে একবার সাইরেনরা সত্যি সত্যিই হার মানল মানুষের বুদ্ধির কাছে। সেই ঘটনার বর্ণনা আছে হোমারের ওডিসিতে। সে ঘটনাই বলছি এবার।

ট্রয়ের যুদ্ধ শেষে অনেক বিপদের পর ওদিসিউস যখন ফিরছিলেন জাহাজে চেপে, তখন তাঁর জাহাজ এল সাইরেনিয়ার কাছে। বুদ্ধিমান ওদিসিউস সাইরেনদের হাত থেকে রক্ষার এক উপায় বের করলেন। তিনি সব নাবিকের কান মোম দিয়ে বন্ধ করে দিলেন। ফলে সাইরেনদের সুরের আওয়াজ তাদের কানে পৌঁছনোর কোনো আশঙ্কাই থাকল না। ওদিসিউসের খুব ইচ্ছা হলো সাইরেনদের সুর শোনার। কিন্তু এই সুর শুনতে গিয়ে যাতে জীবন চলে না যায়, সে ব্যাপারেও সতর্ক ছিলেন তিনি। তাই তিনি নিজেকে কষে বাঁধলেন জাহাজের মাস্তুলের সঙ্গে। ওদিকে জাহাজভর্তি মানুষ দেখে সাইরেনের দল মন-প্রাণ ঢেলে দিয়ে সুর তুলল। নাবিকেরা কানে মোম থাকায় কেউ শুনতেই পেল না সেই হৃদয় মাতাল করা সুর। কিন্তু ওদিসিউস শুনতে পেলেন সবকিছু। তিনি অস্থির হয়ে গেলেন সাইরেনদের দ্বীপে যাওয়ার জন্য। কিন্তু বাঁধন থাকায় যেতে পারলেন না। এভাবেই বুদ্ধির জোরে তিনি পেরিয়ে গেলেন সাইরেনদের দ্বীপ। রক্ষা পেলেন নিজে এবং রক্ষা পেল সব নাবিক।

এই ঘটনায় সাইরেনরা খুবই অপমানিত বোধ করল। দুর্বল মানুষের কাছে হেরে গিয়ে তারা ভীষণ লজ্জাও পেল। লজ্জায়-অপমানে সাইরেনরা সমুদ্রে ডুবে মরল। তারপর সাগরশিলা হয়ে গেল। পাথর হয়ে ঘুমিয়ে রইল কুহকিনীরা যুগ-যুগান্তরের জন্য ।

এই পুরাণকাহিনির শিক্ষা: মন্দ কাজ চিরকাল চলতে পারে না।