মিসিসিপি পারের লেখক

‘টম!’
কোনো উত্তর নেই।
‘টম!’
কোনো উত্তর নেই।
‘ছেলেটার হলো কী! টম!’
কোনো উত্তর নেই।

... ... ... ...

জানি, এটুকু শুনেই তোমরা সক্কলে সমস্বরে বলে উঠবে, ‘জানি জানি, এটা দ্য অ্যাডভেঞ্চার্স অব টম সয়্যার বইয়ের এক্কেবারে শুরু। এর পরপরই টমের পলি খালা ওকে চুরি করে জ্যাম খাওয়া অবস্থায় ধরে ফেলবেন।’ এক-আধটু বইপত্তর যারা পড়ে, দুনিয়াজুড়েই তাদের ‘অবশ্যপাঠ্য’ তালিকায় থাকে বইটি। লেখক মার্ক টোয়েন বিস্তর লিখেছেন, কিন্তু শুধু এই একটামাত্র বই লিখলেও তিনি অমর হয়ে থাকতেন। টম সয়্যার নামের এক কিশোরের নানান দস্যিপনার এক অনন্য আখ্যান ক্লাসিক এ বইটি। খালাকে ফাঁকি দেওয়া, স্কুলের শিক্ষককে নাকাল করা, অন্য ছেলেদের সঙ্গে হাতাহাতি, জলদস্যু সাজা, গুপ্তধনের সন্ধান—এমনতর নানা কাণ্ড ছড়িয়ে আছে বইটির পাতায় পাতায়। একবার পড়লে ভোলা অসম্ভব!

ছোটবেলায় মার্ক টোয়েনকে সব্বাই ডাকত ‘খুদে স্যাম’ বা ‘স্যামি’। নদীতীরের ছোট্ট শহর হ্যানিবলে কেটেছে তাঁর শিশুকাল। পরবর্তী সময়ে মার্ক টোয়েন লিখছেন, ‘যখন বাষ্পচালিত নৌযানগুলো একটা ছোট্ট ছেলের চোখের সামনে অবিরাম চলাচল করে, কিন্তু সে ওতে চড়তে পারছে না, তখন তার মনের অবস্থাটা কেমন হয়, সেটা কল্পনা করাও কঠিন।’ তো, মনের ভেতর তোলপাড় হচ্ছিল খুদে স্যামেরও। যখন তার বয়স নয়, তখন পারেভেরা একটা স্টিমারে লুকিয়ে লুকিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে পড়ল সে। গিয়ে ঢুকল ডেকের নিচে। স্টিমার মাঝনদীতে পৌঁছালে সে ডেকের নিচ থেকে বেরিয়ে দেখতে লাগল চারিধার। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলে, তড়িঘড়ি করে গিয়ে আবারও ডেকের তলায় সিঁধল খুদে স্যাম। কিন্তু ওর পা-জোড়া বেরিয়ে থাকল ডেকের বাইরে। এক খালাসির নজরে পড়তেই হিড়হিড় করে টেনে বের করা হলো ওই দুষ্টু খুদে স্যামকে! এহেন ঘটনার কোনো অভাব নেই খুদে স্যাম অর্থাৎ শিশু টোয়েনের জীবনে। অর্থাৎ বোঝাই যায়, নিজের জীবনের অনেকটুকু ছায়া চলে এসেছিল তাঁরই সৃষ্ট অমর চরিত্র টম সয়্যারের নানান দস্যিপনায়।

মার্ক টোয়েন যখন তরুণ

আমি ঘরকুনো মানুষ, জোরজবরদস্তি না করলে বিদেশবিভুঁই তো দূরের কথা, আমাকে ঘরের বাইরে বের করাটাই বড্ড কঠিন। সেই আমাকেও বছর কয় আগে মুখ চুন করে, অফিসের কাজে, সপ্তা দুইয়ের জন্য পাড়ি জমাতে হয়েছিল সেই সুদূর মার্কিন মুলুকে। ওই দেশে দেখার বস্তু অসংখ্য—কাজে কাজেই ফুরিয়ে গেছে সময়, দেখা হয়নি কিচ্ছু। কিন্তু ওই সব নিয়ে বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই আমার। শুধু দুটি ব্যাপারে একটু মন কেমন করেছিল আমার: এক. ওখানকার বিচিত্র সব বইয়ের দোকানগুলোকে মিস করব; আর আফসোস থাকবে—মিসিসিপি নদীটা দেখা হলো না বলে। কারণ, মিসিসিপি নদীর ধারেই কেটেছে মার্ক টোয়েনের শৈশব এবং টম সয়্যারের ঘটনাও ঘটেছিল ওই মিসিসিপি নদীর ধার ঘেঁষেই। তোমাদের বয়সে যখন আমি ঝিমধরা কোনো এক দুপুরে বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ছিলাম দ্য অ্যাডভেঞ্চার্স অব টম সয়্যার-এর কিশোরোপযোগী বাংলা অনুবাদ; তখন, এই ভুলোমনা আমারও, দিব্বি মনে আছে, মিসিসিপি নদীধারের ওই টম সয়্যার যেন হয়ে উঠেছিলাম আমি নিজেই। খুনে ইনজুন জো, বেকি নামের মেয়েটা—শুধু বইয়ের চরিত্র হয়ে থাকেনি আমার কাছে, হয়ে উঠেছিল রক্তমাংসের মানুষ। মিসিসিপির নদীর গন্ধ, ঢেউয়ের শব্দ, বাতাস—আমাকে ছুঁয়ে গিয়েছিল ঢাকার মালিবাগের ইটপাথরের দালানের ছোট্ট একটা ঘরেও। এমনকি, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তখন এই অধম আমি, বহুবার-বহুভাবে বাংলায় অনূদিত এই বই অনুবাদ করে ফেলি; সেও, ওই মোহগ্রস্ততা থেকেই! তাই, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে ওই দেশের বিখ্যাত বই-বিপণি ‘বারন্স অ্যান্ড নোবেল’ থেকে কিনেছিলাম মার্ক টোয়েনের চিঠি এবং ছোট ছোট লেখার অনবদ্য এক সংগ্রহ মার্ক টোয়েন’স নোটবুকস

মার্ক টোয়েনের শৈশবের দিনগুলো যে শুধু আনন্দময় ছিল এমন নয়; কঠিন বাস্তবতা আর নির্মমতার সাক্ষী হতে হয় তাঁকে শৈশবেই। নয় বছর বয়সে স্থানীয় এক লোকের হাতে খুন হন এক খামারি, দশ বছর বয়সে দেখেন এক শেতাঙ্গ লৌহদণ্ড দিয়ে হত্যা করছে এক ক্রীতদাসকে। হয়তো এরই ধারাবাহিকতায়, অবচেতন মনের তাগিদেই, দ্য অ্যাডভেঞ্চার্স অব টম সয়্যার-এর এক অন্যতম চরিত্র হাকলবেরি ফিনকে নিয়ে মার্ক টোয়েন লেখেন অমর গ্রন্থ দ্য অ্যাডভেঞ্চার্স অব হাকলবেরি ফিন। বাড়ি থেকে পালানো হাকলবেরির সঙ্গে পথে দেখা হয় পলাতক কালো ক্রীতদাস জিমের। জরাজীর্ণ এক ভেলায় চেপে মিসিসিপি নদীতে শুরু হয় তাঁদের যাত্রা। দুর্গম ওই পথে ঘটে নানা রোমাঞ্চকর সব ঘটনা। তবে বইটি শুধু অ্যাডভেঞ্চারের নয়; এর রয়েছে ঐতিহাসিক মূল্য। একসময় খোদ যুক্তরাষ্ট্রে কেনাবেচা হতো মানুষ, দাস হিসেবে। এটাই ক্রীতদাসপ্রথা। এই ক্রীতদাসদের ওপর চালানো হতো অমানুষিক অত্যাচার। এই বইয়ে সেই প্রথার ব্যাপারে রীতিমতো বিরুদ্ধাচরণ করেছেন মার্ক টোয়েন। ফলে, সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের অনেক রাজ্যে নিষিদ্ধ করা হয় এই বই। কিন্তু আজ পর্যন্ত এতটুকু ম্লান হয়নি বইটির আবেদন ও গুরুত্ব। শুধু টম সয়্যার কিংবা হাকলবেরি ফিনই নয়, মার্ক টোয়েনের বাকি সাহিত্যকীর্তিরও সমাদর দুনিয়াজুড়ে; বিশ্বের প্রধান সব কটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর বই, বেরিয়েছে অসংখ্য সংস্করণ। হয়েছে চলচ্চিত্রায়ণ। নোবেলজয়ী সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের মতো অনেকেরই মত যে মার্কিন আধুনিক সাহিত্যের সূত্রপাত এই বইটির হাত ধরেই। বলা হয়ে থাকে, মার্ক টোয়েনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি এই বই।

জগদ্বিখ্যাত এই লেখকের আসল নাম স্যামুয়েল ক্লিমেন্স লংহর্ন। ১৮৩৫ সালের ৩০ নভেম্বর তাঁর জন্ম। ছাপাখানার কর্মী, স্টিমবোটের চালক, নেভাদার দুর্গম অঞ্চলে খনি-অভিযাত্রী, সাংবাদিকতা—এমন নানা পেশার বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাঁর লেখাকে করেছে সমৃদ্ধ। ছোটগল্প ‘দ্য নটোরিয়াস জাম্পিং ফ্রগ অব ক্যালভেরাস কাউন্টি’ দিয়ে তাঁর জয়যাত্রার সূচনা। তাঁর সহজ-সরল ও সরস লেখাগুলো টানে চুম্বকের মতো, পড়তে হয় তরতরিয়ে। মার্কিন কথ্য ভাষাকে নিখুঁতভাবে প্রথমবারের মতো সাহিত্যে ব্যবহারের কৃতিত্বটুকু মার্ক টোয়েনের। লেখার ভেতর মজার মজার নানা দৃশ্যকল্প রচনায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার।

অমর এই লেখকের সব বই পড়িনি আমি। যে কটা পড়েছি, তার মধ্যে টম সয়্যার আর হাকলবেরি ফিন তো বটেই, ভুলতে পারি না দ্য প্রিন্স অ্যান্ড দ্য পপার, আ কানেটিকাট ইয়াঙ্কি ইন কিং আর্থার’স কোর্ট, পুডনহেড উইলসন। এ ছাড়া তাঁর লেখা ৪৩টি ছোটগল্পের সব কটিই পড়েছি; মুক্তোদানার মতো ঝলমলে সব গল্প। ও হ্যাঁ, বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম যে টম সয়্যারকে নিয়ে আরও দুটি ছোট ছোট বই আছে তাঁর—টম সয়্যার আব্রড ও টম সয়্যার ডিটেক্টিভ; ভারি মজার দুখানা বই।

গল্প-উপন্যাস শুধু নয়, বুদ্ধিদীপ্ত রস রচনার কারণেও তিনি হয়ে ওঠেন সবার প্রিয়। তৎকালীন স্যান্ডউইচ আইল্যান্ড, যাকে এখন আমরা হাওয়াই দ্বীপ হিসেবে চিনি, সেই দ্বীপকে কেন্দ্র করে লেখা ভ্রমণ রচনা তাঁর নিজেকে তো বটেই; ওই দ্বীপটিকেও করে তোলে খ্যাতনামা। শুধু লেখনীতে নয়, তীক্ষ্ণ রসবোধ ও অসামান্য বুদ্ধির দীপ্তি তাঁকে সভাকক্ষের বক্তা হিসেবে তুমুল জনপ্রিয় করে তোলে। সুবক্তা হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল ঈর্ষণীয়, প্রায়ই নানা সভায় লোকে তাঁকে দাওয়াত দিত তাঁর কথা শুনতে। বলা হয়, উনিশ শতকের শেষভাগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচে জনপ্রিয় ব্যক্তি, যাঁর ছবি তোলা হয়েছিল সবচেয়ে বেশি, যিনি যেখানেই যেতেন, পেতেন তুমুল সংবর্ধনা—তিনি এই মার্ক টোয়েন।

তবে, ব্যক্তিজীবনে নানান বেদনা ছিল সরস রচনার জন্য দুনিয়াজোড়া খ্যাতিমান এই মানুষটির। তাঁর সন্তানদের মধ্যে এক ছেলে আর দুই মেয়ে অকালে মারা যায়। আর মধ্যম মেয়ের সঙ্গে বাবা টোয়েনের কেন যেন কখনোই রচনা হয়নি সুসম্পর্ক। এসব বেদনায় তাঁর শেষ জীবনটি সুখের হয়নি; তীব্র মানসিক যাতনা তাঁকে কুরে কুরে ক্ষয় করছিল প্রতিনিয়ত। টোয়েনের জন্মসালে (১৮৩৫) পৃথিবীর কাছে এসেছিল বিখ্যাত হ্যালির ধূমকেতু; টোয়েন লিখেছিলেন: ‘আমি এসেছি হ্যালির সঙ্গে। আবার যখন বহু বছর পর এই ধূমকেতু পৃথিবীর কাছে আসবে, আমি আশা করি তখন আমার বিদায় ঘটবে।’ সত্যিই তা–ই হলো। পঁচাত্তর বছর পর যখন হ্যালির ধূমকেতু আবার পৃথিবীর কাছে, তখন, ১৯১০ সালের ২১ এপ্রিল পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নেন মহান এই লেখক। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার ১৯১০ সালের ২২ এপ্রিল সংবাদে লেখা হয়েছে: ‘গতকাল সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে মারা গেছেন মার্ক টোয়েন। শোকে ক্ষয়ে যাওয়া এক মানুষ বিদায় নিলেন...তিনি বুঝতে পারছিলেন যে তাঁর কথা অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তাই পেনসিল টেনে লিখেছিলেন—আমার চশমাটা আমাকে দাও। এটাই ছিল তাঁর শেষ কথা।’

কেমন মন ভার হয়ে উঠছে, তাই না? রসিক এই লেখকের সম্বন্ধে লেখার এহেন সমাপ্তি কি ঠিক? নাহ, বরং মার্ক টোয়েনের জীবনে ঘটে যাওয়া অসংখ্য মজার ঘটনার মধ্যে একটি দিয়ে শেষ করি এই লেখা। শোকে নয়, বুদ্ধিদীপ্ত আনন্দের মধ্যেই আমরা বরং উদ্‌যাপন করি মহান এই লেখকের স্মরণ-আয়োজন!

সমাধিস্থলের চারদিকে দেয়াল তোলার জন্য এলাকাবাসী চাঁদা তুলছিল। ওই এলাকায় বাস করতেন মার্ক টোয়েন। তাঁর কাছে চাঁদা চাওয়া হলে তিনি তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে বললেন, ‘সমাধিস্থলে দেয়াল তোলার তো কোনো প্রয়োজন দেখি না। কারণ, যারা ওখানে থাকে, তাদের বাইরে বেরিয়ে আসার ক্ষমতা নেই। আর যারা বাইরে থাকে, তাদেরও ওখানে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে আছে বলে মনে হয় না।’