মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

ছবি: খালেদ সরকার

শিশুপার্ক, ওয়ান্ডারল্যান্ড ঘুরতে ঘুরতে আমি তখন ক্লান্ত, এমন এক সময় বাবার হাত ধরে প্রথম গিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। তখন সেগুনবাগিচার একটি গলিতে দোতলা বাড়ির ছোট্ট পরিসরের সেই জাদুঘর। ঢুকতেই চোখে পড়ত শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. ফজলে রাব্বীর গাড়ি। গাড়ি বারান্দা পেরোলে গ্যালারি শুরু। ইতিহাস পরিক্রমা মেনে প্রাগৈতিহাসিক বাংলার ইতিহাস, ইংরেজবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতিচিহ্নসহ মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষ্য বহনকারী নানা নিদর্শন দিয়ে সাজানো গ্যালারিগুলো। তখনই মনে হয়েছিল, ইশ্, আরেকটু বড় কেন হলো না জাদুঘরটা? অবশেষে কাটল অপেক্ষার প্রহর, নতুন ভবনে আর বড় পরিসরে শুরু হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কার্যক্রম। নতুন ভবনে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের যাত্রা শুরুর আগেই জেনেছিলাম সারা দেশ থেকে জাদুঘরের জন্য আবারও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন সংগ্রহ করা হচ্ছে। তাই এই জাদুঘরের নতুন ঠিকানা যে আরও বড় পরিসরের কিছু হতে যাচ্ছে, সেটা জানাই ছিল। জাদুঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ে কালো মার্বেলে ঘেরা জলাধারের মাঝখানে প্রজ্বলিত শিখা অম্লান। শিখাটি জাদুঘরের উদ্বোধনীর দিন পায়ে হেঁটে পুরোনো ভবন থেকে আগারগাঁওয়ে নতুন ভবনে এনেছেন এভারেস্টজয়ী নিশাত মজুমদারের নেতৃত্বে ৭১ জন মুক্তিযোদ্ধা ও নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিদের একটি দল। শিখা অম্লানের সামনে দাঁড়িয়ে ওপরের দিকে তাকালে চোখে পড়ে এক টুকরা নীল আকাশ। বাঁ দিকের করিডর ধরে এগোলে দেখা মেলে মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহূত একটি যুদ্ধবিমানের। এরপর দেখা যায় মানচিত্রসমেত জাতীয় পতাকার প্রতিকৃতির সামনে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার চমৎকার একটি ভাস্কর্য। এই করিডরের কাচে লিখে রাখা হয়েছে জাদুঘরের প্রতীকী ইট স্থাপনকারী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নাম।

নয়তলা ভবনের গ্যালারিগুলো শুরু হয়েছে চারতলা থেকে। প্রথম গ্যালারির নাম ‘আমাদের ঐতিহ্য আমাদের সংগ্রাম’। এতে রয়েছে বাংলাদেশের প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত কালপর্বের নানা নিদর্শন। পাল আমল, সেন আমল, ইংরেজ আমল থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন ও বাঙালি সংস্কৃতির নানা স্মৃতিচিহ্নের দেখা মিলবে এতে।

ছবি: খালেদ সরকার

দ্বিতীয় গ্যালারিতে একদিকে তারিখ পরিক্রমা মেনে ১৯৭১ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু করে মার্চের ঘটনাবলি তুলে ধরা হয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণের ছবি-সম্পর্কিত পেপার কাটিং নিয়ে সাজানো একটি অংশে সারাক্ষণই প্রদর্শিত হচ্ছে কালজয়ী ওই ভাষণের ভিডিও। চাইলেই সামনে রাখা বেঞ্চে বসে তা দেখতে পারে দর্শনার্থীরা। একটি নির্দিষ্ট অংশে আলো-আঁধারির খেলায় তুলে ধরা হয়েছে কালরাত্রির ভয়াবহতা। ছবি ও স্থাপত্যশৈলীর দুর্দান্ত সংমিশ্রণ নৃশংসতার রূপ যথাযথভাবে তুলে ধরেছে গ্যালারির এই অংশে। মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় প্রবাসী সরকার গঠনের নানা পর্ব স্মৃতিচিহ্নের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া বাঙালিদের শরণার্থী হিসেবে ভারতে যাত্রা, সেখানে আশ্রয় গ্রহণ, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ে যাওয়াসহ নানা ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্নের মাধ্যমে।

‘আমাদের যুদ্ধ, আমাদের মিত্র’ শিরোনামের তৃতীয় গ্যালারিতে মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের নানা ঘটনা, রাজাকারদের তৎপরতা, মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলের ভূমিকা উঠে এসেছে। এখানে রাখা হয়েছে ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য শহীদ আজাদ, শহীদ রুমীর ছবি ও ব্যবহৃত জিনিসপত্র। শহীদজননী জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি পড়ে বেড়ে ওঠা মানুষগুলোকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও থেমে যেতে হয় গ্যালারির এক অংশে। এ ছাড়া রাজাকার, আলবদর, আলশামসের দুষ্কর্মের প্রমাণস্বরূপ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পত্রিকার কাটিংও আছে এই গ্যালারিতে। জর্জ হ্যারিসনের কনসার্টের পোস্টার, যুদ্ধকালীন প্রবাসী বাঙালিদের সহায়তার নানা নিদর্শনও এতে রয়েছে।

ছবি: খালেদ সরকার

পরবর্তী গ্যালারির শিরোনাম ‘আমাদের জয়’। একদিকে সম্মুখযুদ্ধের সাহসিকতা, যৌথ বাহিনীর অভিযান এবং বিভিন্ন এলাকা মুক্ত করার উল্লাস ধ্বনিত হয়েছে গ্যালারির এক অংশে। অন্যদিকে রয়েছে বুদ্ধিজীবী হত্যার নৃশংসতা বোঝাতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ছবি, ব্যবহূত জিনিসপত্র ও বধ্যভূমির ভয়াবহতার ছবি। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ দিয়ে সাজানো হচ্ছে শেষ গ্যালারির শেষ অংশ।

শুধু বাছাই করা নিদর্শন গ্যালারিতে প্রদর্শন করা হয়েছে, যাতে মুক্তিযুদ্ধের পুরো ঘটনা ফুটে ওঠে। অন্যগুলো সংরক্ষিত থাকবে জাদুঘরের আর্কাইভে। এ ছাড়া আরও দুটি অস্থায়ী গ্যালারি রয়েছে বিশেষ দিবসে প্রদর্শনের জন্য। নতুন ভবনের ব্যবহারযোগ্য আয়তনের পরিমাণ ১ লাখ ৮৫ হাজার বর্গফুট। তবে পরিসরের চেয়ে বড় কথা, ইতিহাসের শোক ও গৌরবের এক অসাধারণ মেলবন্ধন এই জাদুঘর। গ্রীষ্মকালে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এবং শীতকালে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এই জাদুঘর ঘুরে দেখা যাবে।

(কিশোর আলোর জানুয়ারি ২০১৫ সংখ্যায় প্রকাশিত)