মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর: ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বই

ঢাকার সেগুনবাগিচায় অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সম্মুখভাগ

ক্লাসে সিরাজ স্যার একটা অদ্ভুত কথা বলেছেন আজ। পৃথিবীর যে ইতিহাস লেখা হয়েছে, তার বেশির ভাগই নাকি শুধু রাজাদের কথা। সাধারণ মানুষের কথা বলা হয়েছে খুব কম। বিষয়টি নিয়ে ক্লাস সেভেনের শৌনক একটু ভেবেছে। তাহলে কি শুধু রাজারাই বাস করত অতীতে? আর কেউ ছিল না?

বিকেলের মৃদু আলো ঘরে ঢুকেছে। শীতও পড়েছে একটু। হালকা একটা সোয়েটার গায়ে দিয়ে শৌনক গিয়ে ইজিচেয়ারে বসল বারান্দায়। ঠিক এ সময় দোরঘণ্টি বেজে উঠল। দেয়ালঘড়িতে বিকেল সাড়ে চারটা। মা-বাবা কারও আসার কথা নয়! একটু অবাক হয়েই দরজা খুলল শৌনক।

‘বাবা! তুমি!’

‘হুম। আমিই তো। আমাকে দেখে মেজাজ খারাপ হলো?’

‘কেন তা হবে?’

‘আমি যদি এখন তোকে নিয়ে অঙ্ক করতে বসি!’

‘দূর দূর, তোমাকে আমার চেনা আছে। এই বিকেলে তুমি অঙ্ক করাতে বসাবে, এটা হতেই পারে না। বরং চলো ওই বারান্দায় গিয়ে একটু বসি।’

টাইমস সাময়িকীর প্রচ্ছদে বাংলাদেশের বিজয়

শৌনক সিরাজ স্যারের বলা কথাটা বাবাকে জানায়। শুনে বাবা বলল, ‘তোর স্যার ঠিকই বলেছেন। কিন্তু জানিস, সাধারণ মানুষেরাই যুগে যুগে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। তাদেরই রক্তে লেখা হয়েছে ইতিহাস। তবে, নেতৃত্ব যাঁরা দেন, তাঁদের কথাই লেখা হয় বেশি।’

‘তাহলে নূর হোসেন?’ আলতো করে জিজ্ঞেস করে শৌনক।

‘ঠিক বলেছিস! মাঝে মাঝে বিশাল সব মানুষদের ছাড়িয়ে যায় সাধারণ মানুষ। নূর হোসেন সে রকমই একজন। সেই রকমই মাস্টারদা সূর্যসেন, সেই রকমই ক্ষুদিরাম! সেই রকমই নানা সাহেব, ফকির মজনু শাহ!’

শৌনকের খুব ভালো লাগে। বলে, ‘আর আমাদের মুক্তিযুদ্ধ!’

জাদুঘরে ভাষা আন্দোলনের নানা ছবি ও তথ্য সাজানো আছে সুন্দর করে

‘হ্যাঁ, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। ৩০ লাখ মানুষের রক্ত ঝরেছে। এদের কেউই রাজা ছিল না বুঝলি!’

কথা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে কী যেন মনে হয় বাবার। হাতঘড়ি দেখে বলে, ‘চল ওঠ।’

‘মানে! কোথায় যাবে?’

‘ওঠ তো। জামাকাপড় পাল্টে নে। যাব মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। আজ শনিবার। খোলা আছে। রোববার বন্ধ।’

‘মা এসে তো চটবে। সন্ধ্যায় পড়তে হবে না?’

‘একদিন সন্ধ্যায় পড়াশোনা না করলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। ফোনে বলে দেব তোর মাকে। চল, বেরিয়ে পড়ি।’

সেগুনবাগিচার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে প্রথম যখন এসেছিল শৌনক, তখন একেবারেই ছোট। ঢুকতেই একাত্তরের শহীদ ডা. ফজলে রাব্বির গাড়িটি ওর দৃষ্টি কেড়ে নেয়। প্রজ্বলিত আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে ও ভেতরে ঢোকার প্রস্ত্ততি নেয়। বাবা কেন এখানে নিয়ে এল, তা বুঝতে একটুও ভুল হয় না শৌনকের। এই জাদুঘরে ঢোকা মানেই বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া।

প্রাগৈতিহাসিক কালের ফসিল দিয়েই তো শুরু। এরপর পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের রেপ্লিকা দেখতে দেখতে শৌনক জিজ্ঞেস করে, ‘অতীশ দীপঙ্কর কি খুব বড় মানুষ ছিলেন, বাবা?’

‘হ্যাঁ। তা তো বটেই। না হলে এখানে তাঁর মূর্তি থাকবে কেন? আমি কিন্তু তাঁর সম্পর্কে কিছু বলব না। পড়ে নিস নিজেই।’

ব্রিটিশ শাসনের ওপর কত না ছবি! কত না তথ্যের বাহার! শৌনক এখানে খঁুজে পায় ক্ষুদিরামকে, মাস্টারদাকে। ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামীদের নামের তালিকা দেখে ওর বুক থেকে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। 

তার পরই তো পাকিস্তানি আমল। পাকিস্তান জন্মের ইতিহাস। ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট সরকার, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা। এরপর উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান! আর তাতে নেতাদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের ছবি।

বাবা আঙুল তুলে দেখায়, ‘দেখতে পাচ্ছিস, এটা আসাদ। আর ওই যে মতিউর। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের শহীদ।’

শৌনকের মনে একটি জাতির জন্ম-পরিচয় আকার পেতে থাকে। শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে জ্বলে ওঠার মানে বুঝতে থাকে ও।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানেই ব্যবহৃত কোট
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানেই ব্যবহৃত কোট

এরপর ছবিতে ছবিতে সত্তরের প্লাবন, নির্বাচন। শৌনক ছবিগুলোর কাছে স্থির হয়। ছবিগুলোর যেন প্রাণ আছে। ফ্রেম ছেড়ে বেরিয়ে নেমে আসতে চায় রাজপথে! একাত্তর এল বিভীষিকা নিয়ে! সারি সারি অস্ত্র! ব্যবহৃত বুলেট। চকিতে একটি কাচের বাক্সের দিকে চোখ চলে যায় শৌনকের। এতগুলো মাথার খুলি! এত হাড়!

এই মানুষগুলোই একসময় স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছে!

এক একটি কাচের বাক্সে শহীদদের ব্যবহার করা পোশাক, ডায়েরি, চশমাসহ আরও কত কী! আর প্রবাসে বাংলাদেশ সরকারের নথিপত্র।

মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকার

বঙ্গবন্ধুর ছবি। সেক্টর কমান্ডারদের মানচিত্র। বুদ্ধিজীবী হত্যা। নিয়াজির আত্মসমর্পণ। কী নেই সেখানে! বিজয় দিবসে এসে যেন শেষ হয় এই ভ্রমণ। একটি টেলিস্ক্রিনে চলতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা নিয়ে চলচ্চিত্র...

জাদুঘর থেকে বের হয়ে রং চা খেতে খেতে হঠাৎ শৌনক ভাবে, আরে! এই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরটাই তো ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বই। এখানে এলে এই দেশের ইতিহাস জানার পথে কিছুই তো আর বাকি থাকে না!

বিজয় দিবসের পত্রিকা

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর: কিছু তথ্য

  • ১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ সেগুনবাগিচার এই বাড়িতে জাদুঘরটি চালু হয়।

  • গ্রীষ্মকালে শনিবার থেকে সোমবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে।

  • শীতকালে শনিবার থেকে সোমবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে।

  • রোববার বন্ধ।

  • টিকেটের দাম ৫ টাকা। ৫ বছরের ছোট শিশুরা ঢুকতে পারবে বিনামূল্যে।

  • জাদুঘর ভবনটি তিনতলা। তবে প্রদর্শনী চলে ১ম ও ২য় তলায়।

  • নিচতলায় আছে ৫টি প্রদর্শনী ঘর।

  • দোতলায় আছে ৪টি।

  • জাদুঘরের ৩য় তলায় রয়েছে পাঠাগার। এখানে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ৩ হাজার বই আছে।

  • জাদুঘরের রয়েছে ভ্রাম্যমাণ বাস। এটিকে ভ্রাম্যমান জাদুঘর বলা যেতে পারে।