মুগ্ধতার শুরু যেখানে

অনেক দিন পর কোনো বন দেখে মুগ্ধ হলাম। বিশাল গর্জনগাছগুলো এত মোটা যে দেখেই মনে হয়, এদের বয়স কয়েক শ বছর হবে। জঙ্গলের মাঝে মাঝে আবার ঠান্ডা বাতাসের খোলা জায়গা। এক পাশে রামুর বন, সেখানে সকাল-বিকেল হাতি ঘুরে বেড়ায়; অন্য পাশে জাতীয় উদ্যানে বনমোরগ, শূকর আর তেজি শিয়ালের আনাগোনা। বন পেরিয়ে অন্য পাশে গেলেই লবণচাষিদের দিগন্তবিস্তৃত লবণখেত, স্থানীয় মানুষদের ফলবাগান, ঠান্ডা পানির জলাশয়…।

যে জায়গার কথা বলছি, সেটার নাম মেধাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যান। এটা বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র প্রাকৃতিক গর্জনবাগান। ১৯৩১ ও ১৯৩৫ সালে এই বনকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কক্সবাজার থেকে মাত্র ৪২ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে অবস্থিত এই জাতীয় উদ্যানের রাস্তায় ঢুকে পড়ামাত্রই তোমরা বুঝে যাবে, এ এক অন্য দুনিয়া! পথের দুই পাশে আকাশসমান উঁচু উঁচু গর্জনগাছের সারি বিস্ময়ে নিস্তব্ধ করে দেবে যে কাউকে। একেকটা গাছ এত মোটা যে কয়েকজন মিলেও একে জড়িয়ে ধরা সম্ভব নয়, এগুলোকে বলা হয় মাদার ট্রি। এদের আসল বয়স যাঁরা বলতে পারবেন, তাঁদের কেউ আর বেঁচে নেই। কক্সবাজার বা চকরিয়া—যেকোনো জায়গা থেকে এই উদ্যানে এসেই টুক করে ঢুকে পড়া যায় শত বছরের সবুজে, একলহমায় হারিয়ে যাওয়া যায় ঘোর লাগা এক মায়াজালে। মাথা উঁচু করে যত দূর তাকানো সম্ভব, তালগাছের মতো লম্বা হয়ে সব কটি গর্জনগাছ মেঘ ছোঁয়ার জন্য ওপরের দিকে উঠে গেছে। সেই গাছের সারির ফাঁক দিয়ে ঠিকরে পড়ছে আকাশের সবটুকু নীল।

জঙ্গলের সবুজের ছোঁয়া মুগ্ধ হয় সবাই।

একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, ওই বিশাল গর্জনগাছের ডালে ডালে বানরের দল হেলেদুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর নিচে ছায়ার মধ্যে নিজেদের মিশিয়ে রেখেছে ধূর্ত বনবিড়াল। কপাল খারাপ থাকলে পুরো বনে ভূমিকম্প তুলে ছুটে আসবে হাতির পাল। একসময় এখানে নাকি মেছো বাঘও ছিল, কিন্তু এখন আর দেখা যায় না। রাতে ক্যাম্পিং করলে বা থাকলে মাঝেমধ্যেই হাতির দেখা মেলে আর তাঁবুর কাছে বেড়াতে আসে কৌতূহলী বানরের দল!

আমরা ক্যাম্পিং করিনি। তবে কিছুক্ষণের জন্য এই বনে হারিয়ে যাওয়ার লোভ সামলাতে পারিনি। রাস্তা থেকে বাঁ দিকে ঢুকে পড়তেই এক অপার্থিব সবুজ এসে গিলে ফেলল আমাদের। যেদিকে তাকাই শুধু সবুজ আর সবুজ, সে সবুজের আবার কত রং! কোথাও ঝলমলে সবুজ, কোথাও উজ্জ্বল সবুজ, কোথাও কালচে সবুজ, কোথাওবা একেবারে আয়েশি সবুজ। এক সবুজের এত রং আশপাশে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। হাঁটতে হাঁটতেই চোখের সামনে উদয় হলো শাপলা বিল! মোটামুটি অর্ধেক এলাকাজুড়ে আকাশের নীল গায়ে মেখে স্বচ্ছ পানিতে ফুটে আছে টকটকে শাপলা। সেগুলোকে টেক্কা দিয়ে বাকি জলাশয় দখল করে নিয়েছে সাদাটে একধরনের বুনো ফুল। সবকিছুকে দুলিয়ে দিয়ে একটা কী মাছ যেন পানি থেকে বের হয়ে এসে আমাদের দেখে গেল! এখানে একটু পরপরই হাতির মল পড়ে আছে। একটু কান পাতলেই শোনা যায় ঝিঁঝি পোকার ডাক, বনমোরগের ডানা ঝাপটানোর মিহি শব্দ কিংবা দূরের কোনো বানরের গাছ কাঁপিয়ে চলার শব্দ! জলাশয়ের পাশ ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতেই জঙ্গলের ভেতরে একটা মাচা দেখে বসে পড়লাম, অমনি হুড়মুড় করে দখিনা বাতাস ঝাঁপিয়ে পড়ল আমাদের বরণ করে নিতে। সবুজ, সতেজ ওই ঠান্ডা বাতাসে এক মিনিটের জন্য চোখ বন্ধ করে পাক্কা এক ঘণ্টা পর হুঁশ হলো। এই অসাধারণ সুন্দর পরিবেশ দুনিয়ার সবকিছুই ভুলিয়ে দিতে বাধ্য…।

অসাধারণ এই পরিবেশ দুনিয়ার সব ভুলিয়ে দিতে বাধ্য।

সব মিলিয়ে জায়গাটা সুন্দর। এখানে ট্যুরিজম বিস্তার করতে বন বিভাগ থেকে ‘ট্রি অ্যাডভেঞ্চার’ নামে একটি প্রকল্প চালু করা হয়েছিল, সঙ্গে ছিল রাতে বনে থাকার জন্য তাঁবু ভাড়া নেওয়ার ব্যবস্থা আর যাবতীয় আয়োজন। ট্রি অ্যাডভেঞ্চারের মাধ্যমে বিশাল গর্জনগাছের মধ্য দিয়ে কাঠের আর দড়ির রোপওয়ে দিয়ে বানানো হয়েছিল বনে চলাচলের রাস্তা। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে যে কেউ গাছের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে জঙ্গল ঘুরতে পারত। তবে যত্নের অভাবে কাঠ, রশি—সব পচে, গাছে ঝোলানো সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এখন পর্যটকদের উৎসাহে ভাটা পড়েছে। তাতে করে কিন্তু এ জঙ্গলের হুট করে মন ভালো করে দেওয়া সৌন্দর্যে এক ফোঁটাও ভাটা পড়েনি, উল্টো পড়ন্ত বিকেলে নীলচে আকাশের মায়াবী আলোয় শতবর্ষী সবুজ গর্জনগাছগুলোকে দেখে মাত্রাহীনভাবে বেড়েছে মুগ্ধতা। এত নিরেট ঘন বন খুব একটা দেখা যায় না ইদানীং। ২০০৪ সালে বন বিভাগ এই বনকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে। মূলত গর্জনগাছের জন্য বিখ্যাত হলেও গর্জনের পাশাপাশি এই বনে তেলসুর, বৈলাম, গামার ও চাপালিশগাছও রয়েছে। কেউ যদি শুধু গাছ দেখে বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলিয়ে ফেলতে চায়, তাহলে তাকে এই উদ্যানে আসতে হবে। সারা দিন ঘুরলেও ওই চোয়াল আর বন্ধ হবে না। উল্টো সন্ধ্যা হলেই হাঁ করা মুখে কয়েক শ জোনাকি ঢুকে পড়তে পারে।

শেষ বিকেলে সবুজে চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া গর্জনের জঙ্গল যখন পেছনে ফেলে রাস্তায় নামলাম, তখন হুট করেই মনে হলো, এখানে একটা রাত থাকা উচিত। শিয়াল, হাতি আর জোনাকির সঙ্গে দেখা হোক বা না হোক। এখানকার শতবর্ষী অতিকায় গর্জনগাছগুলোর সঙ্গে তো কথা বলা যাবে। এত বছর পেরিয়েও তাদের এমন রূপসী সবুজ হয়ে থাকতে পারার গোপন রহস্য তো শুনতে পারা যাবে…। জলসবুজের কোল ডিঙিয়ে এই স্থলসবুজের পরশ একটা এলাকাকে কীভাবে মোহনীয় করে তুলেছে, সেটা এখানে না এলে বোঝার কোনো উপায় নেই। সুন্দরী বাংলাদেশের আরও একটা সুন্দরের পালক এই মেধাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যান। এখানে শেষ বলে কিছু নেই। শুধুই শুরু বিস্ময়, প্রশান্তি, অ্যাডভেঞ্চার, চমক, মৌনতা ও মুগ্ধতার।