মৃত নভোযানদের গন্তব্য

গত মাসের শুরুর দিকে সারা বিশ্বে হইচই বেধে গেছে ভয়ানক এক বিষয় নিয়ে। ২০২২ সালে চালু হতে যাওয়া চীনের মহাকাশ স্টেশন তিয়াংগংয়ের জন্য বিশেষ যন্ত্রাংশ (মডিউল) পাঠাতে মহাকাশে পাঠানো হয় লং মার্চ ৫বি নামের রকেট। প্রায় ২৩ টন ওজনের মালামাল নিয়ে চীনের ওয়েনচ্যাং স্পেস লঞ্চ সেন্টার থেকে গত ২৯ এপ্রিল উৎক্ষেপণ করা হয় এটি। কিন্তু মাত্র ৩৫০ কিলোমিটার ওপরে যেতেই অস্বাভাবিকভাবে নিচে নেমে আসতে থাকে রকেটটি। বিশাল এই রকেটের নানা অংশ মহাকাশে বর্জ্য হিসেবে ছড়িয়ে পড়লেও বড় একটা অংশ ছুটে আসতে থাকে পৃথিবীর দিকে। অবশেষে সব আতঙ্কের অবসান ঘটিয়ে ৯ মে ভারত মহাসাগরে মালদ্বীপের কাছাকাছি ভূপাতিত হয় এটি।

যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এমন দুর্ঘটনা ঘটলেও মহাশূন্যে ছুটে চলা রকেট কিংবা অকেজো মহাকাশ স্টেশনের নানা যন্ত্রপাতি কাজ শেষে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হয়, যার বেশির ভাগই পুনর্ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। আবার অনেক ক্ষেত্রে রকেটে জ্বালানি সরবরাহের বুস্টার ট্যাংক ফিরে আসে পৃথিবীর বুকে। বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে ঘর্ষণের কারণে কিছুটা অংশ ধ্বংস হলেও, বেশ বড় একটা অংশ বর্জ্য হিসেবে থেকে যায়। মহাকাশ অভিযানের এমন সব বর্জ্য তাহলে কী হয়?

শেষ কয়েক দশকের এত এত মহাকাশ অভিযানের পৃথিবীতে ফেরত আসা আবর্জনাগুলোর জন্য বিজ্ঞানীরা বেছে নিয়েছেন নিরাপদ এক স্থান। প্রশান্ত মহাসাগরে জনবসতি থেকে প্রায় ১৪৫০ নটিক্যাল মাইল (প্রায় ২৬৮৫ কিলোমিটার) দূরের এটি অংশে ফেলা হয় এসব ধ্বংসাবশেষ। ১৯৯২ সালে সার্ভে ইঞ্জিনিয়ার হার্ভোজে লুকাটেলা জিয়ো লোকেশন স্যাটেলাইট ব্যবহার করে খুঁজে বের করেন সমুদ্রের এই অঞ্চল। বিজ্ঞানীরা এটির নাম দেন ‘পয়েন্ট নিমো’। লাতিন ভাষার এই নামের অর্থ ‘কেউ নেই’। ফ্রান্সের বিখ্যাত বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখক জুল ভার্নের টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগ আন্ডার দ্য সি–এর অন্যতম চরিত্র ছিল ক্যাপ্টেন নিমো। মহাকাশ থেকে ছুটে আসা কোনো যন্ত্রাংশের কারণে যেন মানুষের ক্ষতি না হয়, তাই এমন পন্থা অবলম্বন করেন বিজ্ঞানীরা। ৪৮ ডিগ্রি ৫২.৬ মিনিট দক্ষিণ অক্ষাংশ এবং ১২৩ ডিগ্রি ২৩.৬ মিনিট পশ্চিম দ্রাঘিমাংশে অবস্থান এই অঞ্চলের। জনবসতি থেকে বেশ দূরে হলেও এই অঞ্চলের ঠিক ওপরের আকাশেই অবস্থান করছে স্পেস স্টেশনগুলো, যা মাত্র ৪১৬ কিলোমিটার ওপরে। তাই পয়েন্ট নিমোতে কিছু ফেলতে হলে, স্পেস স্টেশন থেকে সেটা সরাসরি পৃথিবীর দিকে পাঠিয়ে দিলেই হয়।

পুরো এলাকায় এ পর্যন্ত ১৫০টির বেশি মহাকাশ অভিযানের রকেট বুস্টার কিংবা স্পেস স্টেশনের নানা যন্ত্রপাতি ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়ে আছে। তাই নাসা এই স্থানের নাম দিয়েছে ‘স্পেসক্রাফট সিমেট্রি’ অর্থাৎ মহাকাশযানের কবরস্থান।

ছোট ছোট স্যাটেলাইট কিংবা রকেটের বুস্টার নিয়ে তেমন সমস্যা না হলেও এ পর্যন্ত পয়েন্ট নিমোয় নেমে এসেছে গোটা স্পেস স্টেশনের ল্যাবরেটরি। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চীন মহাকাশে চালু করে তাদের তিয়াংগং-১ স্পেস স্টেশন। ওজনে প্রায় ৮.৫ টনের এই স্পেস স্টেশন প্রায় ৩৪ ফুট লম্বা। মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় চীনের স্পেস এজেন্সি এর ওপর নিয়ন্ত্রণ হারায়। নিয়ন্ত্রণ হারানোর পর পৃথিবীর দিকে প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসতে থাকে স্পেস স্টেশনের নানান অংশ। ২০১৮ সালে বিশাল এই ধ্বংসাবশেষ মিলিয়ে যায় পয়েন্টে নিমোতে। এভাবেই ২০০১ সালের ২৩ মার্চ নিমো পয়েন্টে মিশে যায় রাশিয়ার মির স্পেস স্টেশনও।

তবে শুধু পৃথিবীর বুকে মহাকাশযানদের শেষ গন্তব্যের ব্যবস্থা করলেই তো আর চলবে না। যেসব মহাকাশযান ইতিমধ্যে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার মতো দূরত্বের বাইরে চলে গেছে, সেসব বিকল হলে সমাহিত করা হয় বিশেষ কক্ষপথে। পৃথিবী থেকে ৩০০ কিলোমিটারের আশপাশের অঞ্চলের কক্ষপথগুলোয় চলাচল করে স্বাভাবিক মহাকাশযান, স্যাটেলাইট ও স্পেস স্টেশনগুলো। যখন এসবের কোনো একটি পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার জ্বালানি থাকে না, তখন সর্বশেষ জ্বালানি ব্যবহার করে এই অঞ্চলের বাইরে ‘অরবিট গ্রেভইয়ার্ড’ অর্থাৎ কক্ষপথের কবরস্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যেন এসবের সঙ্গে সক্রিয় মহাকাশযানগুলোর কোনো সংঘর্ষ না ঘটে।

এত ব্যবস্থা নিলেও মহাকাশ গবেষণার এই বর্জ্য নিয়ে কিন্তু বেশ চিন্তিত বিজ্ঞানীরা। কেননা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন দেশ মহাকাশে তাদের নিজস্ব মহাকাশযান কিংবা স্যাটেলাইট পাঠাচ্ছে। সেসব বিকল হয়ে বাড়িয়ে চলেছে বর্জ্যের পরিমাণ। তাই ভবিষ্যতে এই বর্জ্য অপসারণের পরিকল্পনা করছেন গবেষকেরা।

তথ্যসূত্র: মেন্টাল ফ্লস, বিবিসি আর্থ, স্পেস ডট কম, বিজনেস ইনসাইডার