যুদ্ধের সাক্ষী যুদ্ধের ছবি

ভিয়েতনাম যুদ্ধে একজন সৈনিকের পরবর্তী গুলি ছোড়ার জন্য অপেক্ষা। ছবি : ফিলিপ জোনস গ্রিফিথস
ভিয়েতনাম যুদ্ধে একজন সৈনিকের পরবর্তী গুলি ছোড়ার জন্য অপেক্ষা। ছবি : ফিলিপ জোনস গ্রিফিথস

সমুদ্রের পাড়ে যুদ্ধ হচ্ছে। সবাই গেরিলা পজিশনে। কারও কারও শরীরের অঙ্গ আবার পড়ে আছে নানা জায়গায়। এত ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ভিন্ন একজন মানুষ যার হাতে বন্দুক নেই, কামান বা গ্রেনেড নেই, কিন্তু যুদ্ধের মধ্যে নিজের অবদান রেখে যাচ্ছেন। যুদ্ধের সময়কার এবং যুদ্ধ–পরবর্তী অবস্থার নানা ঘটনা আমরা দেখতে পারি তার কাছ থেকে। তিনি ওয়ার ফটোগ্রাফার বা যুদ্ধের আলোকচিত্রী। যুদ্ধের ছবি তোলা যার কাজ।


ফটোগ্রাফি চর্চার অনেক পরে শুরু হয় এই ওয়ার ফটোগ্রাফি বা যুদ্ধের আলোকচিত্র। ১৮৩৯ সালের ১৯ আগস্ট ফ্রান্স সরকার ফটোগ্রাফি চর্চা পুরো পৃথিবীর মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। তখন এক একটা ছবি তুলতে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা সময় লাগত। সাধারণত ল্যান্ডস্কেপ ছবি তোলার কাজে ক্যামেরা ব্যবহৃত হতো। পরে এই ল্যান্ডস্কেপ করার সময় যখন ছবিতে মানুষের উপস্থিতি পাওয়া যায়, তখন স্ট্রিট ফটোগ্রাফি শুরু হয়। যদিও প্রথম স্ট্রিট ফটোর এক্সপোজার সময় হয় কয়েক ঘণ্টা। আস্তে আস্তে এই বক্স ক্যামেরা দিয়ে, সময় নিয়ে নানা ধরনের ছবি তোলার চর্চা শুরু হয়। 

ডি-ডের সময়ে নরম্যান্ডি উপকূলে অবতরণের একটি বিখ্যাত ছবি ‘ইন্টো দ্য জস অব ডেথ’। ছবি : রবার্ট সার্জেন্ট
ডি-ডের সময়ে নরম্যান্ডি উপকূলে অবতরণের একটি বিখ্যাত ছবি ‘ইন্টো দ্য জস অব ডেথ’। ছবি : রবার্ট সার্জেন্ট



সভ্যতার শুরু থেকেই যুদ্ধ মানুষের জীবনের একটা বড় অংশ হিসেবে রয়েছে। ক্যামেরা হাতে পাওয়ার পর থেকে মানুষ নানা ধরনের ছবির গবেষণা করে যায়। যুদ্ধও এই গবেষণার বাইরে ছিল না। এই বক্স ক্যামেরায় ছবি তুলতে অনেক সময় লাগত, তাই কোনো অঞ্চলে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ধ্বংসাত্মক অঞ্চলের ছবি তোলা হতো। সেটাও একপ্রকার ল্যান্ডস্কেপই ছিল। ওয়ার ফটোগ্রাফির একটা বড় অংশ করা হয় শরণার্থী শিবির বা রিফিউজি ক্যাম্পে। বক্স ক্যামেরায় ক্যাম্পের মানুষের নানাবিধ পোর্ট্রেট করা হতো। পরে ক্যামেরার আকার ছোট হতে থাকে এবং ফটোগ্রাফির গতি বৃদ্ধি পায়। ওয়ার ফটোগ্রাফিতেও পরিবর্তন আসে। 

কুয়েতের মরুভূমিতে আগুন। ছবি : সেবাস্তিয়াও সালগাদো
কুয়েতের মরুভূমিতে আগুন। ছবি : সেবাস্তিয়াও সালগাদো



যুদ্ধের মধ্যে ছবি তুলতে ফটোগ্রাফারকে বিভিন্ন জিনিসের প্রতি খেয়াল রাখতে হয়। শুরুর দিকে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ছবি তোলা হতো বলে ফটোগ্রাফারের নিজের সুরক্ষার ব্যাপারে অন্য কারও সাহায্য নেওয়ার প্রয়োজন হতো না। সময়ের পরিবর্তনে ক্যামেরা ছোট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফটোগ্রাফারকে যুদ্ধক্ষেত্রে অংশ নেওয়ার জন্য যেকোনো পক্ষের এমবেডেড হয়ে যেতে হয়। অর্থাৎ ওই ফটোগ্রাফার সৈনিক দলের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যান। এমবেডেড হয়ে ছবি তোলার সুবিধা এবং অসুবিধা দুটোই আছে। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো নিজের সুরক্ষা। এমবেডেড ফটোগ্রাফার যে দলের হয়ে আসেন, সেই দল তার সর্বোচ্চ সুরক্ষা নিশ্চিত করে। আবার সমস্যা হলো, এমবেডেড ফটোগ্রাফার সব জাগায় ছবি তুলতে পারেন না। আবার তুলতে পারলেও সব ছবি প্রকাশ করতে পারেন না। কারণ, যে দলের হয়ে তিনি আসেন সেই দল তার তোলা ছবি নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখে। মাঝেমধ্য ছবি তোলার স্থানও নির্ধারণ করে দেয় তারা। ফলে নিরপেক্ষ ছবি তোলা বা নিরপেক্ষ ছবি প্রকাশ করা অনেক কঠিন হয়ে যায়। প্রতিটি দলই যে নিজেদের সেরা দেখানোর জন্য কাজ করে যায়। 

অনুগত সৈনিকের মৃত্যু। ছবি : রাবর্ট ক্যাপা
অনুগত সৈনিকের মৃত্যু। ছবি : রাবর্ট ক্যাপা



এমবেডেড হওয়া ছাড়াও ফটোগ্রাফার অ্যাসাইনমেন্ট করার জন্য নিজ দায়িত্বে ছবি তুলতে যান। সেখানে সুরক্ষার ব্যাপারটা নিশ্চিত থাকে না। 

ভিয়েতনাম যুদ্ধে আহত সৈনিকের প্রাথমিক সেবা। ছবি : ফিলিপ জোনস গ্রিফিথস
ভিয়েতনাম যুদ্ধে আহত সৈনিকের প্রাথমিক সেবা। ছবি : ফিলিপ জোনস গ্রিফিথস



যুদ্ধের মধ্যে এখনো বেশির ভাগ ছবি রিফিউজি ক্যাম্পে তোলা হয় যুদ্ধের নির্মমতা দেখানোর জন্য। আবার ঠিক এই যুদ্ধের ছবি ব্যবহার করে মাঝেমধ্যে ভুল তথ্য ছড়ানো হয়ে থাকে। ওয়ার ফটোগ্রাফির শুরুতে ল্যান্ডস্কেপ থেকে শুরু করে এখন যোদ্ধাদের কাজের ছবি দেখতে পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে আমরা বিভিন্ন ফটোগ্রাফারের কাজের মধ্যেও পার্থক্য দেখতে পাই। অনেক ফটোগ্রাফার যুদ্ধ শেষে নায়ক হয়, আবার অনেকে খলনায়ক। কিন্তু দিন শেষে সবার মনের মধ্যেই যুদ্ধের একটা দাগ থেকে যায়, যা পরবর্তী সময়ে তাদের কাজের মধ্যে বড় প্রভাব ফেলে।


সূত্র : স্লাইটলি আউট অব ফোকাস - রবার্ট ক্যাপা ও ভিয়েতনাম ইনক - ফিলিপ জোনস গ্রিফিথস