যে চমক আমার আজও কাটেনি

টোল প্লাজায় টোল দিয়ে চলে যাচ্ছে গাড়িগুলো

শহর হিসেবে নিউ অরলিন্স খুবই ইন্টারেস্টিং। মস্ত বড় অজগর সাপের মতো মিসিসিপি নদী শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। দাস ব্যবসার যুগে আফ্রিকার নানা দেশ থেকে জাহাজে করে কালোদের নিয়ে আসা হতো এই মিসিসিপি নদী দিয়েই। ফলে শহরটায় এখনো কালোদেরই প্রাধান্য। তবে এখন তারা জানে, কীভাবে জীবনকে উপভোগ করতে হয়। কাজের ফাঁকে গান, বৈচিত্র্যময় খাবার আর বারো মাসে অন্তত ২৪টা উৎসব নিয়ে সারাক্ষণ মেতে থাকে তারা। এখানকার গানপাগল কালোদের হাত ধরেই বিখ্যাত জ্যাজ–সংগীতের উৎপত্তি হয়েছিল একসময়। তাদের মধ্যে বিখ্যাত জ্যাজশিল্পী লুই আর্মস্ট্রংয়ের নাম তোমরা অনেকেই শুনে থাকবে।

একসময় ফরাসিরা এ অঞ্চল শাসন করত বলে শহরের একটা বড় এলাকার দালানকোঠা ফরাসি স্থাপত্যরীতিতে তৈরি, যেটা ‘ফ্রেঞ্চ কলোনি’ নামে পরিচিত। এই শহরে আমি ছিলাম প্রায় এক বছরের মতো। সারা দিনের কাজ শেষে আমার রুটিন ছিল বিকেলবেলা এখানকার ইউনিভার্সিটির মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলে ফ্রেঞ্চ কলোনির পুরোনো বইয়ের দোকানে ঢুঁ মেরে বাসায় ফেরা। একদিন বইয়ের দোকানে বাচ্চাদের জন্য লেখা একটা বই আমার পৃথিবী দেখার চোখ মোটামুটি খুলে দিল। বইটা আকারে-প্রকারে খুবই ছোট, ২০ কি ২৫ পৃষ্ঠার হবে। বইয়ের বিষয়বস্তু কীভাবে নিজের সামান্য একটু চেষ্টাতেই পৃথিবীর এবং মানুষের উপকার করা যায়। সেই বই থেকেই আমি শিখেছি জঙ্গল বা বাগানের মধ্য দিয়ে হাঁটতে গেলে কেন গাছের পাতা বা ফুল ছিঁড়তে নেই (ব্যাখ্যাটা এ রকম, দিনে পৃথিবীতে এক লাখ লোক জঙ্গলে বেড়াতে গিয়ে একটা করে পাতা ছিঁড়লেও এক লাখ পাতা ছেঁড়া হয়, মানে এক লাখ পাতার উৎপাদন করা অক্সিজেন আমরা কম পাব), কেন মাইক্রোবিডসযুক্ত টুথপেস্ট ব্যবহার করা উচিত নয় (মাইক্রোবিডস হলো রঙিন প্লাস্টিকের দানা, যেগুলো টুথপেস্ট, ফেসওয়াশ ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হয়, এরপর বেসিনের পানির সঙ্গে মিশে সোজা নদী বা সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। মাছ বা সামুদ্রিক প্রাণী সেসব দানাদার প্লাস্টিক খাবার মনে করে খেয়ে মারা যায়)। এমন নানা উদাহরণের পাশাপাশি কিছু উদাহরণ ছিল, কীভাবে খুব অল্প চেষ্টাতেই মানুষের উপকার করা যায়, মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলা যায়...যার মধ্যে আগে প্রবেশ করলে পরেরজনের জন্য দরজা ধরে রাখা, মানুষকে ধন্যবাদ দিতে শেখা, লিফটের দরজা ধরা...। দোকানে দাঁড়িয়ে সেই বইটা পড়তে গিয়ে আমার এক বছর আগের একটা ঘটনা মনে পড়ল।

আমি তখন যুক্তরাষ্ট্রের স্যান ফ্রান্সিসকোর পাশেই বার্কলি নামের ছোট্ট একটা শহরে থাকি। এই শহরের ইউসি বার্কলি পৃথিবীখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি। কোনো কারণে বার্কলি থেকে স্যান ফ্রান্সিসকো যেতে হলে ‘বে ব্রিজ’ নামক এক বিশাল ব্রিজ পেরোতে হয়। স্যান ফ্রান্সিসকোর গোল্ডেন গেট ব্রিজের মতো এই বে ব্রিজও প্রচণ্ড ব্যস্ত সেতু। আমার ধারণা, দিনে লাখখানেকের মতো গাড়ি পার হয় সেটা দিয়ে। তো সেখানে টোল দিতে হয় পাঁচ ডলার। সেটা ক্যাশেও দেওয়া যায়, আবার আগে থেকে কার্ড কিনে ড্যাশবোর্ডে লাগিয়ে রেখে, না থেমে অটো সিস্টেমেও দেওয়া যায়।

ড্রাইভ ইনে গাড়িতে বসেই খাবার অর্ডার, বিল পরিশোধ করে ফেলা যায়

যারা নিয়মিতই সেই সেতু পার হয়, তারা অটো সিস্টেমের কার্ড কিনে ফেলে সময় বাঁচাতে। স্যান ফ্রান্সিসকোতে পার্কিং প্রায় পাওয়া যায় না বলে আমি গাড়ির বদলে সাধারণত মেট্রোরেল বা বাসে চড়ি। সেদিন কী কারণে যেন গাড়ি ড্রাইভ করেই ব্রিজ পার হচ্ছি। টোল বুথের কাছে এসে গাড়ির গ্লাস নামিয়ে কালেক্টর মেয়েটার দিকে পাঁচ ডলার বাড়িয়ে ধরতেই সে বলল, ‘তোমার টাকা দিতে হবে না, আগের গাড়ি তোমার টাকা দিয়ে দিয়েছে’...বলে সে সামনের ব্যারিকেড খুলে দিল। আমি বুঝলাম না সে কী বলতে চাইছে, টাকা দিতে হবে না কেন? সামনের বোর্ডে জ্বলজ্বল করে লেখা টোল পাঁচ ডলার। আমি তখনো তার দিকে নোট ধরে রেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি বলে সে এবার গলা উঁচিয়ে থেমে থেমে বলল, ‘তোমাকে টাকা দিতে হবে না, তুমি যাও। তোমার আগের গাড়ি তোমার টাকা দিয়ে দিয়েছে।’ আমি বললাম, ‘কিন্তু আগের গাড়িতে তো আমার পরিচিত কেউ নেই, কেন টাকা দেবে?’ সে বলল, ‘ডাজন্ট ম্যাটার। তোমার টোলের টাকা পেয়ে গেছি, তুমি যাও।’ আমি মাথাভর্তি বিস্ময় নিয়ে টাকাটা পকেটে ঢুকিয়ে ব্রিজ পার হয়ে গেলাম।

এর কয়েক মাস পরের ঘটনা। সকালবেলায় গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছি এক বন্ধুর বাসায় যাব বলে। ঘুম কাটাতে একটা কফির দোকানের ড্রাইভ ইনে ঢুকে পড়লাম কফি কিনব বলে। (ড্রাইভ ইন ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করি, গাড়িতে বসে থেকেই দোকানের অডিও সিস্টেমের সামনে খাবার অর্ডার দিয়ে গাড়িতে বসেই পরবর্তী দুটি উইন্ডোর প্রথমটা দিয়ে বিল পরিশোধ এবং পরের উইন্ডো দিয়ে খাবার নিয়ে আবার গাড়ি চালিয়ে চলে যাওয়া যায়)।

সেই দোকানে কফি এবং আরও কিছু অর্ডার দিলাম। বিল এল প্রায় ১৫ ডলারের মতো। বিল দিতে গিয়ে উইন্ডোর মেয়েটা জানাল, ‘তোমার বিল সামনের গাড়িটা দিয়ে দিয়েছে, তোমাকে বিল দিতে হবে না।’ আমি আবারও আগের মতোই বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘কিন্তু মানে কেন?’ সেও যথারীতি বলল, ‘সে তো আমি জানি না। তার সঙ্গে কথা বলতে পারো।’ আমি গাড়ি থেকে নামতে নামতেই আগের জন গাড়ি চালিয়ে চলে গেল। আবারও মাথাভর্তি বিস্ময় নিয়ে কফির কাপে চুমুক দিলাম আমি।

বিখ্যাত জ্যাজশিল্পী লুই আর্মস্ট্রং

ব্যাপারটা আমার মাথায় ভয়াবহভাবে ঢুকে গেল এবার। ঘটনাটা কী? আমার টাকা আমেরিকানরা দিয়ে দিচ্ছে কেন? আমাকে দেখতে কী কপর্দকহীন লাগে? ব্যাপারটা নিয়ে সেদিনই এক আমেরিকানের সঙ্গে কথা বললাম। সে হেসে বলল, ‘এটা আমেরিকানদের একটা মজার বিষয়। কেউ যদি খুব খুশি থাকে, আনন্দের সংবাদ পায়, অন্যের জন্য ভালো কিছু করতে চায়, অন্য একজন অপরিচিত মানুষকে খুশি করতে চায়, বিস্মিত করতে চায় তখন টোল প্লাজা, ড্রাইভ ইনে এমন কাজ করে। পরেরজনের বিল দিয়ে তাকে চমকে দেয়।’

...সেই চমক আমার এখনো কাটেনি।

দানবীর কথাটা শুনলেই হাজী মুহম্মদ মুহসীনের কথা মাথায় আসে আমাদের। মনে হয় মানুষের উপকার করতে হলে, দান করতে হলে বুঝি অনেক অনেক টাকাপয়সা থাকতে হয়। ব্যাপারটা যে মোটেই সত্যি না, সেটা একটু ভাবলেই বোঝা যায়। নিজের সামর্থ্য দিয়েই মানুষকে খুশি করা একদমই কঠিন কোনো কাজ নয়। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বলি, এই যেমন ধর তুমি দুপুরের কাঠফাটা রোদে যে রিকশা করে যাচ্ছ, সেই রিকশাওয়ালার দিকে একটু তাকিয়ে দেখো, ঘেমে–নেয়ে একাকার তিনি। তুমি যদি তোমার ব্যাগে রাখা পানির বোতলটা তার দিকে বাড়িয়ে ধর, তিনি কী যে খুশি হবেন, একবার ভেবে দেখেছ?

কোনো পরিস্থিতিতে কেউ তোমার জন্য কী করল তুমি খুশি হতে সেটা ভেবে, তুমিই যদি সেই কাজটা অন্যের জন্য করা শুরু করো, দেখবে আমাদের চারপাশটা কী সুন্দর হয়ে ওঠে দিন দিন।