রবিঠাকুরের স্মৃতির কাছে

রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়ে, গান শুনে মুগ্ধ হয়েছি। তবু নিজ জেলার পাশের জেলায় রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি দেখতে না যাওয়ায় তাঁর প্রতি মুগ্ধতায় যেন এক অপূর্ণতা ছিল। তাই এসএসসি পরীক্ষার পর একটু অবসর পেতেই কয়েকজন বন্ধু মিলে চলে গেলাম তাঁর স্মৃতির স্পর্শ নিতে।

ঝিনাইদহ থেকে বাসে উঠে গেলাম কুষ্টিয়ার আলাউদ্দিন মোড় পর্যন্ত। সেখানে বাস থেকে নেমে খাওয়ার ব্যবস্থা করার পালা। খোঁজাখুঁজি করে সেখানে ভালোমানের খাবারের হোটেল একটাই পাওয়া গেল। তাদের বলে রাখলাম দুপুরে আমাদের খাবার রাখতে। এবার ঠিক করতে হবে আমরা ভ্যানে না সিএনজি অটোরিকশায় যাব কুঠিবাড়ি পর্যন্ত। দেখা গেল, আমাদের ভ্যানেও যাওয়ার ইচ্ছা; সিএনজিতেও যাওয়ার ইচ্ছা। সময়ের কথা ভেবে উঠে পড়লাম সিএনজি অটোরিকশায়। দুই দিকে ফসলের খেত, গাছপালা। গ্রামের এমন দৃশ্য অনেক দিন দেখিনি আমরা। যাত্রাপথের এই অংশটুকুই ছিল সবচেয়ে সুন্দর। দেড় মাস ধরে খাতা আর বই দেখতে দেখতে ক্লান্ত চোখ সবুজ দেখে একটু স্বস্তি পেল। আর মনের মুগ্ধতা লিখে প্রকাশের মতো না।

গন্তব্যে পৌঁছে নামলাম অটোরিকশা থেকে। বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখি, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সেই প্যাগোডাসদৃশ কুঠিবাড়ি, যেখানে আমরা কবিগুরুর স্পর্শ খুঁজতে এসেছি। কুঠিবাড়িটি ৩০ বিঘা জমিজুড়ে রয়েছে। এর চারদিকে ঢেউখেলানো সীমানাপ্রাচীর দেওয়া। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮০৭ সালে বৃহত্তর রাজশাহী জেলার পতিসর ও পাবনার শাহজাদপুরের জমিদার হন। এই জমিদারির সূত্র ধরেই ১৮৮৯ সালে তাঁর দৌহিত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহে আসেন। এই কুঠিবাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের প্রায় দুই দশক কাটিয়েছেন, রচনা করেছেন সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালী, কথা ও কাহিনী, ক্ষণিকা, নৈবেদ্য ও খেয়া কাব্যগ্রন্থের বেশির ভাগ কবিতা। লিখেছেন পদ্মাপর্বের গল্প, নাটক, উপন্যাস আরও নানান সাহিত্য।

টিকিট কেটে আমরা ঢুকে পড়লাম ভেতরে। আমরা বেশ সকাল সকালই গিয়েছিলাম, পিকনিক করতে আসা মানুষ তখনো এসে পৌঁছায়নি। তাই প্রায় ফাঁকা কুঠিবাড়ি খুব ভালোভাবেই ঘুরে দেখতে পেরেছি আমরা। ভেতরে ঢুকে প্রথমে গেলাম রবিঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত দিঘির কাছে। দিঘির চারদিকে সারি করে প্রচুর গাছ লাগানো। সেখানে বাঁধানো ঘাটে বসলাম কিছুক্ষণ, ছবি তুললাম। এই পরিবেশে যাত্রাপথের ক্লান্তি চলে গেল নিমেষেই। এখানে রাখা আছে কবির পদ্মাবোটের আদলে বানানো একটি বজরা। বজরায় চড়েই তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন পদ্মার বুকে, সৃষ্টি করেছেন নানা অমর রচনা। দিঘির পাশেই ছিল একটি বকুলগাছ, যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি। চারদিকে প্রচুর গাছপালা, সেসবের মাঝে কয়েকটা গাছ দেখলাম রবীন্দ্রনাথের সময়ের। ঘুরতে ঘুরতে আরেকটা পুকুরও দেখতে পেলাম। সেটার অবশ্য ঘাট নেই।

চারদিকটা ঘোরা শেষে ঢুকলাম মূল ভবনে। এটি দুই বিঘা জমির ওপর একটি তিনতলা ভবন। নিচতলা ও দোতলায় আটটি করে ঘর আর তৃতীয় তলায় কবিগুরুর লেখার ঘর। এ ঘর থেকে একসময় পদ্মা নদী ও গড়াই নদ দেখা যেত। নিচতলা ও দোতলার ১৬টি ঘরেই রয়েছে কবির ছেলেবেলা থেকে মৃত্যুশয্যা পর্যন্ত নানা বয়সের সব ছবি। নিচতলার ঘরে ঢুকেই কানে এল রবীন্দ্রসংগীত। প্রতিটি ঘরেই ছোট ছোট সাউন্ডবক্স লাগানো, তাতে মৃদু শব্দে বাজছে রবীন্দ্রসংগীত। নিচতলার ঘরগুলোতে রয়েছে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন, কবি মেরি শেলিসহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ছবি। রবীন্দ্রনাথের আঁকা বেশ কিছু ছবিও আছে এখানে। আর রয়েছে তাঁর নিজ হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি, চিঠি। আরও আছে সে সময় চলা বিভিন্ন রকম নৌকার ছোট ছোট প্রতিকৃতি। দোতলায় তাঁর ব্যবহার করা বেশ কিছু জিনিস আছে। এসবের মধ্যে রয়েছে চঞ্চলা ও চপলা নামের দুটি স্পিডবোট, পালকি, কাঠের চেয়ার, টেবিল, সোফা, পালঙ্ক, চাবুক, খড়্গ, ওয়াটার ফিল্টার, ঘাস কাটার যন্ত্র—এমনই নানান জিনিস।

কবিগুরু যখন কুষ্টিয়া এসেছেন, তখন তো শুধু এই কুঠিবাড়িতেই বসে থাকেননি, পদ্মায় ভেসে বেড়িয়েছেন বজরায়। তাই তাঁর স্মৃতির স্পর্শ নিতে এসে পদ্মা না দেখলে ভ্রমণটাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এ কারণে কুঠিবাড়ি দেখা শেষে আমরা চললাম পদ্মা নদীর দিকে। কুঠিবাড়ি থেকে বের হয়ে চড়ে বসলাম ইজিবাইকে। ভাঙাচোরা রাস্তা পার করে ইজিবাইক আমাদের নামিয়ে দিল পদ্মা নদীর তীরে ছোট্ট এক ঘাটে। দূরে চর দেখা যায় সেখান থেকে। ঘাট থেকে কিছুক্ষণ পরপর ইঞ্জিনচালিত নৌকা ছেড়ে যায় সেই চরে। আমরাও চরে যাওয়ার জন্য উঠে পড়লাম নৌকায়। ৮-১০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম চরে।

চরে নেমে দেখলাম ঘাটের কাছে কয়েকটা টং দোকান। কয়েকজন ঘোড়সওয়ারকে দেখলাম ঘোড়া নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, ভাড়ার বিনিময়ে বেড়াতে আসা ব্যক্তিদের চর ঘুরিয়ে দেখান তাঁরা। আমরা হাঁটতে হাঁটতেই বিশাল চর ঘুরে দেখতে লাগলাম। কোনো ঘরবাড়ি চোখে পড়ল না। অর্থাৎ সেই চরে মানুষের বসবাস নেই। চারদিকে ধু ধু বালি। তার ওপর অনেক জায়গায় আগাছার জঙ্গল হয়েছে। এই বালির মধ্যেও চরের একটা অংশে কৃষিকাজও চলছে। কয়েকজন কৃষককে কাজ করতেও দেখলাম। কয়েকটা বদ্ধ জলাশয় আছে, তার সঙ্গে শুকনো নালা মিশেছে নদীর সঙ্গে। হয়তো বর্ষায় এসব নালা দিয়েই নদীর পানি আসে এসব জলাশয়ে। একদিকে রোদের প্রচণ্ড তাপ, আবার উত্তপ্ত বালিতে পা প্রায় পুড়ে যায়। অর্ধেক চর দেখার আগেই ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লাম। ক্ষুধা, তৃষ্ণা মেটাতে সে সময় কাজে লাগল ব্যাগে থাকা চিপস আর পানি। সেই রোদের মধ্যে বসেই একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার কিছুক্ষণ ঘুরলাম চরে। তারপর আবার নৌকায় করে ফিরলাম তীরে।

এত ঘোরাঘুরির পর পেট ক্ষুধার জানান দিতে শুরু করল। আমরাও আবার সেই সুন্দর গ্রামের রাস্তা দিয়ে চলে এলাম আলাউদ্দিন মোড়ে। আগে থেকে ঠিক করে রাখা হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে সেখানেই একটু জিরিয়ে নিলাম। সেখান থেকে বের হয়ে পাশের গ্রামটা ঘুরে দেখতে গেলাম। গ্রামের মধ্যে প্রায় পরিত্যক্ত একটা রেলস্টেশনও পেলাম। সেখানে কয়েকটি চায়ের দোকান। একটি দোকানে বসে চা খেতে খেতে আড্ডা দিলাম কিছু সময়। এর মধ্যে সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিম দিগন্তে, কখন যে বেলা শেষ, খেয়ালও করিনি আমরা। তারপর নিজেদের ঝুলিতে অনেক স্মৃতি আর অভিজ্ঞতা নিয়ে সবাই মিলে বাড়ির পথ ধরলাম।

(কিশোর আলোর মে ২০১৫ সংখ্যায় প্রকাশিত)