রহস্যময় ডার্ক ম্যাটার

একদিন দেখি একটা গ্লোব নিয়ে পল্টু খুব মনোযোগ দিয়ে কী যেন দেখছে। আবার মাঝেমধ্যে কী সব গুগল করছে। কী হচ্ছে জানতে চাইলাম। একরাশ হতাশা নিয়ে জানাল, পৃথিবীর কিছুই আবিষ্কারের বাকি নেই। ২০০ বছর আগে জন্মালে কী মজাটাই হতো। সাগর-মহাসাগর অভিযানে বেরিয়ে যেতে পারত। অজানা দ্বীপে গিয়ে নতুন নতুন গাছপালা, প্রাণী আবিষ্কার করে নাম দিয়ে দিত। আবার গবেষণা করে নিউটন, ম্যাক্সওয়েলের মতো বিজ্ঞানী হতে পারত। এখন কী করতে পারবে? অটোমেটিক খেলনা গাড়ি পর্যন্ত আবিষ্কার হয়ে গেছে।

আমি একটু খোঁচাই মারলাম, ‘বেশ হতো। কিন্তু তোর খেলনা কোয়াডকপ্টারটা, যেটা রিমোট দিয়ে উড়িয়ে দিস, তা কিন্তু থাকত না।’ এমনভাবে হাত নাড়ল, মনে হলো কোয়াডকপ্টারটা হাত দিয়েই উড়িয়ে দিল।

হতাশা ঢাকতেই মনে হয় টিভি ছেড়ে ডিসকভারি চ্যানেল দেখতে লাগল। আমার কিছু দয়া হলো। বেশ কয়েক দিন হলো ওকে পাত্তা-টাত্তা দিচ্ছি না। তাই আজ বসলাম। টিভি বন্ধ করেই ‘আলোচনা’ করতে বসল পল্টু। আমাদের কথাবার্তা খানিকটা তুলে দেওয়া যাক।

পল্টুর প্রথম প্রশ্ন, ‘ডার্ক ম্যাটার কী?’

‘আরিব্বাস, এ তো কঠিন প্রশ্ন। ডার্ক ম্যাটার কী বলতে পারলে তো আমি নোবেল পেয়ে যাব।’

‘তার মানে?’

‘মানে হলো বিজ্ঞানীরা জানেন না ডার্ক ম্যাটার বা কৃষ্ণবস্তু আসলে কী।’

‘একটা জিনিস জানে না, এই কথাটা কীভাবে জানল। একি ভূত নাকি?’

‘ভূত না হলেও ভুতুড়ে বটে।’

‘কেমন?’

এবার একটু সিরিয়াস আলোচনায় গেলাম। পল্টু নড়েচড়ে বসল। ওর নড়াচড়া আবার যে সে নয়, আশপাশে একটা ঝড় ওঠে আরকি। ধাক্কায় টেবিল থেকে আমার মোটাসোটা একটা বই পড়ে গেল। বইটা তুলে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটা কী দিয়ে তৈরি?’

পল্টুর সরল উত্তর, ‘কাগজ দিয়ে।’

‘উঁহু, কাগজটা কী?’

‘কাগজ আবার কী? একটা পদার্থ। ইংরেজিতে ম্যাটার। কাগজের অণু দিয়ে তৈরি।’

‘ঠিক, অণু-পরমাণু দিয়ে তৈরি। মানুষ কী দিয়ে তৈরি?’

‘সে কথা তো অনেক আগেই আবিষ্কার হয়ে গেছে। ডাল্টন বলে গেছেন, সবকিছুই তৈরি পরমাণু দিয়ে। এই পৃথিবী, সূর্য, চাঁদ—সবকিছু।’

‘খুশি হলাম। ওপরের ক্লাসের বই পড়ে পল্টু অনেক কিছু শিখে ফেলেছে। পরমাণু কী দিয়ে তৈরি, বলতে পারবি?’

‘প্রোটন, নিউট্রন আর ইলেকট্রন। প্রোটন আর নিউট্রন আবার তৈরি কোয়ার্ক দিয়ে। আপ কোয়ার্ক, ডাউন কোয়ার্ক।’

এত কিছু জানে দেখে খুশিতে ওকে একটা চকলেট দিয়ে দিলাম। পল্টু অবশ্য ভাব দেখাল, চকলেট পাওয়া—এ আর এমন কী। ছোট মুখখানায় গাম্ভীর্য ধরে রেখেই বলল, ‘এ চকলেটটাও আপ কোয়ার্ক, ডাউন কোয়ার্ক আর ইলেকট্রন দিয়ে তৈরি।’

এবার ছুড়লাম আমার মোক্ষম প্রশ্ন, আমি যদি অনেক অনেক প্রোটন, নিউট্রন আর ইলেকট্রন এনে দিই, পল্টু কি একটা মহাবিশ্ব বানাতে পারবে?

‘এ কেমন কথা, আমি ছোট মানুষ, আমি কেমনে পারব?’

‘কথার কথা। যদি কাউকে দেওয়া হয়, সে কি বানাতে পারবে? ধরা যাক তার শক্তি অনেক বেশি। অকল্পনীয়। সুপার পাওয়ার আছে।’

‘পারার তো কথা।’

‘কিন্তু না, মহাবিশ্বে শুধু ওই প্রোটন, নিউট্রন আর ইলেকট্রন নয়, তার চাইতে আরও অনেক বেশি কিছু আছে।’

‘বেশি কী আছে?’

‘এই যে প্রোটন আর নিউট্রন, এগুলো তৈরি কোয়ার্ক দিয়ে, তা তো তুই-ই বললি। আপ আর ডাউন। এর বাইরে কোয়ার্ক আছে আরও চারটা। আর ইলেকট্রন হলো একটা লেপটন। এমন লেপটন আছে আরও পাঁচটা। তার মানে একদম মৌলিক কণা আছে অন্তত ১২টা। এর বাইরে আরেক ধরনের কণা আছে, যাদের কাজ ওই সব কণার মধ্যে ইন্টার্যাকশন করা। অনেকটা পিয়নের মতো কাজ। এদের নাম ফোটন, গ্লুয়ন, ডব্লিউ বোসন, জেড বোসন আর হিগস বোসন। কিন্তু আমরা যা কিছু দেখি, মানে আমাদের জানা যে মহাবিশ্ব, তা তৈরি ওই আপ কোয়ার্ক, ডাউন কোয়ার্ক আর ইলেকট্রন দিয়ে।’

বিশাল একটা লেকচার দিয়ে ফেললাম। পল্টুকে লেকচারটা হজম করতে বলে তখনকার মতো ক্ষান্ত দিলাম।

২.

আগের আলোচনাটা ছিল দুপুরবেলা। রাতে ঘুমের আগে পল্টু এল আমার রুমে, হাতে বেশ কতগুলো কাগজ। একটা কাগজে দেখি মৌলিক কণাদের একটা লিস্ট। পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে এর নাম স্ট্যান্ডার্ড মডেল। ইন্টারনেট থেকে নামিয়ে প্রিন্ট করেছে পল্টু। তোমাদের সুবিধার জন্য এই লেখায় দিয়ে দিলাম ওটা। আরেকটা কাগজে ছিল একগাদা প্রশ্ন। যেগুলো নিয়ে পল্টু আলোচনা করতে চায়।

আলোচনার শুরুতেই পল্টুর অভিযোগ, ওর প্রশ্ন ছিল ডার্ক ম্যাটার নিয়ে। আমি নানান পাণ্ডিত্য দেখালেও ডার্ক ম্যাটার নিয়ে কিছু বলিনি। জানালাম, এ অভিযোগের জবাব যথাসময়ে দেওয়া হবে।

এবার পল্টুর প্রশ্ন, ‘আপ কোয়ার্ক, ডাউন কোয়ার্ক আর ইলেকট্রন দিয়ে সবকিছু বানানো হয়েছে। বাকি নয়টা কণার কাজ কী?’

আমার উত্তর, ‘জানি না।’

পল্টু আক্রমণ করে বসল, ‘তুমি তো অনেক কিছুই জানো না। বই দেখে বলো।’

আমি অসহায়ভাবে জানালাম, ‘বইয়ে নেই। আসলে বিজ্ঞানীরা জানেন না এগুলোর কাজ কী।’

‘মানে? বিজ্ঞানীরা এদের যেখানে পেয়েছেন, সেখানে দেখলেই তো হয় এরা কী করছিল। তাতেই তো জানা যাবে এদের কাজ কী।’

‘আসলে এসব কণা এত ছোট যে এদের সাধারণভাবে দেখা যায় না। যেমন ধর নিউট্রিনো। একটা নিউট্রিনো এক আলোকবর্ষ সমান পুরু সিসার পাত ভেদ করে চলে যেতে পারে।’

‘তোমার কি মাথা খারাপ? এক আলোকবর্ষ মানে তো কোটি কোটি কিলোমিটার।’

‘আমার মাথা ঠিকই আছে। আসলেই এক আলোকবর্ষ পুরু সিসাই ভেদ করতে পারে। আর এদের সংখ্যাও অকল্পনীয়। যেমন ঠিক এই মুহূর্তে তোর নখ ভেদ করে চলে গেছে এক শ কোটি নিউট্রিনো! তুই কিন্তু টেরও পাসনি।’

অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকল পল্টু, ‘এ-ও সম্ভব! তাহলে জানল কীভাবে এদের কথা?’

‘সুইজারল্যান্ড আর ফ্রান্সের সীমান্তে মাটির নিচে ২৭ মাইল লম্বা একটা যন্ত্র আছে, নাম লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার। এটা একটা কণা এক্সিলারেটর। এমন এক্সিলারেটর আছে আরও নানান জায়গায়। এগুলোতে একঝাঁক কণা অপর একঝাঁক কণার সঙ্গে জোরে ধাক্কা খাওয়ানো হয়। তাতে উৎপন্ন হয় আরও অনেক কণা। সেই ধাক্কার ঘটনা বিশ্লেষণ করে পাওয়া যায় এসব কণার খবর।’

‘জটিল ব্যাপার তো দেখি।’

‘জটিলই। সার্নের ওই লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার মানুষের বানানো সবচেয়ে জটিল যন্ত্র।’

‘আচ্ছা, ওই ১২টা কণার বাইরে কি আর কণা নেই?’

‘আছে হয়তো। এখনো পাওয়া যায়নি।’

‘তিনটার বাইরে বাকিগুলোর কাজ কী, সত্যিই জানে না?’ ওকে কিছুটা হতাশ লাগছে।

‘না, আসলেই আমরা জানি না এগুলোর কাজ কী। শুধু জানি, এরা আছে।’

‘এবার বলো, ডার্ক ম্যাটার কী।’

আমিও এখন ডার্ক ম্যাটারের কথাই বলতে শুরু করেছিলাম, ‘এই যে বিশাল মহাবিশ্ব আমরা দেখি, তা মোট মহাবিশ্বের মাত্র ৫ ভাগ। বাকি ৯৫ ভাগ আমরা দেখি না।’

পল্টু বাধা দিল, ‘না না। ৯৫ ভাগের অনেক বেশি, প্রায় পুরোটাই আমরা দেখতে পাই না। কত কোটি কোটি গ্যালাক্সি আছে, সেগুলো দেখতে গেলে শক্তিশালী টেলিস্কোপ লাগবে। খালি চোখে দেখা যায় না।’

‘উঁহু, আমি সে কথা বলছি না। টেলিস্কোপ দিয়ে দেখলেও আমরা সব মিলিয়ে যে মহাবিশ্ব দেখি, তা মোট মহাবিশ্বের মাত্র ৫ ভাগ।’

‘পল্টু উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গেল, বলো কী? বাকিগুলো কী তাহলে?’

‘বাকিগুলো কী বলছি, তার আগে বল তো, এই ৫ ভাগ কী দিয়ে তৈরি?’

পল্টু বেফাঁস মন্তব্য যাতে না হয়ে যায়, তাই এবার সাবধান, ‘কী দিয়ে? অণু-পরমাণু? প্রোটন, ইলেকট্রন, নিউট্রন?’

‘হ্যাঁ। এগুলো দিয়েই তৈরি। বাকিটা তৈরি ডার্ক ম্যাটার আর ডার্ক এনার্জি দিয়ে। ২৭ ভাগ ডার্ক ম্যাটার, আর ৬৮ ভাগ ডার্ক এনার্জি। দাঁড়া, তোকে একটা পাই চার্ট একে দেখাই।’ (পাই চার্টটা তোমাদের জন্যও দিয়ে দিলাম)।

অনেকক্ষণ চার্টটার দিকে তাকিয়ে থেকে পল্টু আবারও বলল, ‘যা কিছু দেখি, তা মাত্র ৫ ভাগ?’

‘হ্যাঁ, সত্যিই তাই। মাত্র ৫ ভাগ।’

‘এবার তাহলে বলো ডার্ক ম্যাটার কী? ডার্ক এনার্জি কী, তা-ও বলতে হবে। আগে ডার্ক ম্যাটার।’

‘কিন্তু রাত যে অনেক হয়েছে। এখন ঘুমাতে যা। কাল বলব।’

কিন্তু পল্টু নাছোড়বান্দা। তার এখনই শুনতে হবে। ওরই বা দোষ দিই কীভাবে, তোমরাই বলো, এই জায়গায় পল্টুর কথা শেষ করে দিলে কি তোমাদের ভালো লাগবে? আমার তো ঘুমই হতো না। তাই দুই মগ কফি নিয়ে ছাদে চলে গেলাম। তারা দেখতে দেখতে বাকি কথা বলা যাবে। তোমাদের বলে রাখি, আমার বা পল্টুর, দুজনেরই কিন্তু কফি খেলেও ঘুমের কোনো সমস্যা হয় না।

৩.

আগামীকাল পূর্ণিমা। চাঁদ উঠে গেছে প্রায় মধ্যাকাশে। আজকেই বেশ জোছনা হয়েছে। চারদিক ভেসে যাচ্ছে কেমন নরম আলোতে। এত আলো যে একটা বই নিয়ে এলে পড়তে বসে যেতে পারতাম। পল্টু দেখি নোটবুক নিয়ে এসেছে। প্রয়োজনে আঁকিবুঁকি করা যাবে, দরকারে টুকে নিতে পারবে এক-দুটো তথ্যও।

‘পল্টু, বল তো এই যে চাঁদটা পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে। কেন ঘুরছে?’

‘মহাকর্ষ বলের কারণে। পৃথিবীর মহাকর্ষ টেনে রাখছে চাঁদকে।’

‘পৃথিবী যদি টানছেই তাহলে টুপ করে আপেলের মতো পৃথিবীতে এসে পড়ছে না কেন?’

‘চাঁদ তো গতিশীল। ও আসলে সোজা চলে যেতে চাচ্ছে। কিন্তু পৃথিবী টেনে ধরছে বলে সোজা না গিয়ে ঘুরছে আমাদের চারপাশে। ছবি এঁকে দেখাব?’

‘না, থাক। ছবি আঁকতে হবে না।’ (তবে ছবিটা দিয়ে দিলাম তোমাদের জন্য)।

‘পৃথিবী যদি আরও অনেক অনেক ভারী হতো, তাহলে কী হতো বলো তো।’

‘চাঁদকে আরও অনেক জোরে ঘুরতে হতো। এমন আস্তে ঘুরলে টুপ করে পৃথিবী টেনে নিত। আবার ধর পৃথিবীর ভর যদি কম হতো, চাঁদের গতি হতো বেশি, তাহলে সোজা আমাদের ছেড়ে চলে যেত মহাকাশে। টাটা, বাই বাই।’ পল্টুর হাত নাড়া দেখে আমার হাসি পেয়ে গেল।

পৃথিবী টেনে ধরছে বলে সোজা না গিয়ে ঘুরছে আমাদের চারপাশ

‘আরেকটা প্রশ্নের উত্তর দে, চাঁদ ঘুরছে পৃথিবীকে ঘিরে। কিন্তু পৃথিবী ঘুরছে কাকে ঘিরে?’

‘সে তো একটা বাচ্চাও জানে। পৃথিবী ঘুরছে সূর্যকে ঘিরে।’

‘এবার বল, সূর্য ঘোরে কাকে ঘিরে?’

পল্টু কিছুটা বিরক্ত হলো মনে হয়, ‘তুমি তো দেখি ডার্ক ম্যাটারের কথা বলতে এনে আমার পরীক্ষা নিচ্ছ।’

‘আহা, বল না। এগুলো জানলেই না ডার্ক ম্যাটারের কথা বুঝবি।’

‘সূর্য ঘুরছে আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চারপাশে। একটা গ্যালাক্সির তারাগুলো কেন্দ্রকে ঘিরে ঘুরতে থাকে।’

‘ঠিক এটাই ঝামেলা বাধাল। উনিশ শ ষাটের দিকের ঘটনা। দূরের গ্যালাক্সির তারাদের ভর মাপলেন বিজ্ঞানীরা। তারার উজ্জ্বলতা মেপে, আরও কিছু হিসাব-নিকাশ করে ভর মাপা যায়। একটা গ্যালাক্সির সব কটি তারার ভর মেপে যোগ করে দেখা গেল, তারাগুলো গ্যালাক্সিতে যত দ্রুত ঘোরার কথা, তার চাইতে অনেক বেশি দ্রুত ঘুরছে। বেশি দ্রুত ঘুরলে ছিটকে বাইরে চলে যাওয়ার কথা।’

পল্টু আমাকে থামাল, ‘ওই চাঁদের মতো?’

‘হ্যাঁ, চাঁদের মতো। পৃথিবী যেমন চাঁদকে ধরে রাখতে পারবে না, গ্যালাক্সিও তারাদের ধরে রাখতে পারার কথা নয়।’

‘তার মানে কী?’

‘তার মানে হলো যেহেতু তারাদের গ্যালাক্সি ধরে রাখছে, নিশ্চয় ওই গ্যালাক্সির ভর অনেক বেশি। হিসাব করে যা পাওয়া গেছে, তার চাইতে অনেক বেশি। তাই অনেক দ্রুত ঘুরলেও ছিটকে পড়ছে না তারাগুলো।’

‘তাহলে কি বিজ্ঞানীদের হিসাবে ভুল ছিল?’

‘না, হিসাব ঠিকই ছিল। কিন্তু বিজ্ঞানীরা ওই গ্যালাক্সিতে আর কোনো ভারী বস্তু খুঁজে পেলেন না।’

‘এ দেখি ভুতুড়ে কাণ্ড।’

‘ভুতুড়েই তো। ধর, তুই তোর হাতের নোটবুকটা টেবিলের ওপর দেখলি। তুই তো জানিস এটা কাগজের। কতই-বা ভারী হবে, ৩০০ গ্রাম। কিন্তু তুলতে গিয়ে দেখিস, বেজায় ভারী। যেন কাগজ নয়, লোহা দিয়ে তৈরি।’

‘তার মানে কী, ওই তারা অন্য কিছু দিয়ে তৈরি?’

‘না, তারারা ঠিকই আছে। তবে ওই গ্যালাক্সিতে কিছু একটা আছে, যা অনেক ভারী। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি না।’

‘একটা বুদ্ধি করলেই তো হয়, দেখতে না পেলেও ওই ভারী জিনিসের পেছনের কিছু তো আমরা আর দেখতে পারব না। তখন বুঝে যাব ওই জায়গায় আছে আমাদের ভুতুড়ে বস্তু।’

‘নাহ্, তা-ও সম্ভব নয়। ওই ভুতুড়ে ভারী বস্তু আলোকে বাধা দেয় না। আলো ঠিকই ভেদ করে চলে আসতে পারে।’

‘একে তুমি বস্তু বলছ কেন? যে আলোই বাধা দিতে পারে না, তাকে কি বস্তু বলা যায়?’

‘যায় মনে হয়। কাচও তো আলোকে ভেতর দিয়ে চলে যেতে দেয়। তাই বলে কাচ কি বস্তু নয়? এই যুক্তি অবশ্য খাটবে না এখানে।’

‘হুম। তারপর কী হলো?’

‘নানানভাবে এই ভারী জিনিসটা কী, বোঝার চেষ্টা করা হলো। দেখা গেল এর কিছুই আমরা দেখতে পাচ্ছি না। শুধু বুঝতে পারছি এখানে কিছু একটা আছে, যার মধ্যে মহাকর্ষ বল কাজ করে। বাকি কিছুর সঙ্গে এ কোনো ইন্টার্যাকশন করে না।’

‘এ তো মহা সমস্যা, আলো দিয়েও দেখতে না পারলে তো বিপদ।’

‘মহা সমস্যাই। তবে মহাকর্ষের অন্য যে প্রভাব, তা কিন্তু দেখা গেল। যেমন ধর, আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ত্ব বলে, কোথাও ভারী বস্তু থাকলে চারপাশের স্থানটাই বেঁকে যায়। তাই ভারী বস্তুর পাশ দিয়ে আলো আসতে গেলে আর সোজা পথে আসতে পারে না। আসে ওই বাঁকানো পথেই। এই যে আমাদের ভুতুড়ে বস্তু, সে কিন্তু ঠিকই পথটা বাঁকিয়ে দিয়েছে। পেছন থেকে আসা আলো বেঁকে গেছে।’

পল্টু বলল, ‘আর কিছু করে না এই ভূত মশাই?’

‘আরও কিছু করে কি না দেখতে গিয়ে আসলে হতভম্ব করে দেওয়া একটা ব্যাপার পাওয়া গেছে। দূর আকাশে মাঝেমধ্যে একটা গ্যালাক্সি মহাকর্ষের টানে আরেকটা গ্যালাক্সির মধ্যে গিয়ে পড়ে। তখন গ্যালাক্সির তারাগুলো একটা আরেকটার মধ্যে পড়ে বিশাল বিশাল বিস্ফোরণ ঘটায়। বুঝতেই পারছিস, লাখ লাখ তারা একটা আরেকটার ওপর গিয়ে পড়ছে।’

‘শুনেই তো ভয় লাগছে। আমাদের গ্যালাক্সি আবার এই কাণ্ড করবে না তো?’

‘না, ভয় নেই। কোটি বছরের মধ্যে এমন হবে না। যা-ই হোক, এমন ধাক্কা খাওয়া দুটো গ্যালাক্সি দেখতে গিয়ে পাওয়া গেল, তাদের মধ্যে যে ভুতুড়ে বস্তু ছিল, তারা কিন্তু নিজেদের মধ্যে কোনো ধাক্কা খায়নি।’

‘বলো কী! পাশ কাটিয়ে গেল? এ তো দেখি মহা ধড়িবাজ।’

‘না, পাশ কাটিয়েও যায়নি। একজন আরেকজনের মধ্য দিয়ে চলে গেছে! যেন একজন আরেকজনকে দেখেইনি।’

‘আমি তোমার মধ্য দিয়ে চলে গেলাম! কেউ টেরও পেল না! এ কীভাবে সম্ভব?’

‘অসম্ভবকে সম্ভব করাই মনে হয় ভুতুড়ে বস্তুর কাজ।’

‘একেই কি ডার্ক ম্যাটার বলে?’

‘হ্যাঁ, এরাই ডার্ক ম্যাটার।’

‘এর নাম তো হওয়া উচিত ঘোস্ট ম্যাটার। আমি হলে এর নাম রাখতাম গোস্ট ম্যাটার। আর কিছু জানা যায়নি?’

‘না, আর কিছু আমরা এখনো জানি না। আমাদের জানা বস্তু ৫ ভাগ। হিসাব করে দেখা গেছে, ডার্ক ম্যাটার ২৭ ভাগ।’

‘কিছু জানি না, তাহলে হিসাব করল কীভাবে?’

‘ওই যে মহাকর্ষের প্রভাব দেখে। কত জোরে ঘুরছে, সে হিসাবে ভর কত। বিজ্ঞানীরা নানানভাবে চেষ্টা করছেন ডার্ক ম্যাটারের ব্যাখ্যা করতে। কিন্তু পারছেন না। মিলছে না আমাদের জানা সূত্রের সঙ্গে।’

‘বাকি ৬৮ ভাগ তো ডার্ক এনার্জি বা কৃষ্ণশক্তি। সেগুলো কী?’

‘খুব ঘুম পাচ্ছে। ডার্ক এনার্জির কথা আরেক দিন বলব।’

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দেখি পল্টু বিড়বিড় করছে, ‘মাত্র ৫ ভাগ দেখি আমরা। ৯৫ ভাগই দেখি না। আমরা তো আসলে কিছুই জানি না। কী ভুতুড়ে ব্যাপার রে বাপ! না জানি আমার মধ্য দিয়ে কেবলই কত ডার্ক ম্যাটার চলে গেল।’

মনে হলো পল্টু খানিকটা কেঁপে উঠল। আমি গুরুত্ব দিলাম না। আমার নিজেরই তো কেমন লাগে। তেমন কিছুই তো আমরা জানি না।

৪.

রাতে স্বপ্ন দেখলাম, আমি ডার্ক ম্যাটারের জগতে। ইউনিভার্সাল ডার্ক ম্যাটার স্কুলের ছাত্র। বন্ধুদের সঙ্গে স্কুল পালানোর প্ল্যান করছি। দারোয়ান কড়া পাহারা দিচ্ছে গেটে। আমরা সোজা দেয়াল ভেদ করে চলে এলাম। ডার্ক ম্যাটার দিয়ে তৈরি তো, তাই কোনো বাধা পেলাম না।

৫.

সকালে ঘুম ভাঙল পল্টুর ডাকে। স্কুলে যাচ্ছে। যাওয়ার আগে আমাকে একটা কথা বলতে চায়। কী কথা?

‘একটা সুযোগ পাওয়া গেছে।’

‘কী সুযোগ?’

‘এই যে আমরা মাত্র ৫ ভাগ জানি। বাকিটা জানি না, এটা খুব ভালো দিক। ২০০ বছর আগে না জন্মালেও আমার আবিষ্কারের জন্য পড়ে আছে কত বিশাল জগৎ!’

‘আরে, তাই তো। আমি তো এটা ভাবিনি। যদি শুনতাম, পৃথিবীর মাত্র ৫ ভাগ আবিষ্কার হয়েছে, বাকিটা কী, কেউ জানে না। তাহলে তো আমি এখনই অভিযানে নেমে পড়তাম।’

মহাবিশ্বের ৯৫ ভাগই পড়ে আছে আবিষ্কারের জন্য। পল্টু তো চেষ্টা করবে। তুমিও দেখবে নাকি একবার চেষ্টা করে? সে জন্য তোমাকে হতে হবে পদার্থবিজ্ঞানী।