রাজা হলো রোমুলাস 

বহুকাল আগের কথা। সাত সাগর আর তেরো নদীর ওপারে অ্যালবা লাংগা নামে এক রাজ্য ছিল। রাজ্যটা ছিল ইউরোপ মহাদেশের অন্তর্গত বর্তমান ইতালির ভেতরে। তো, সেই রাজ্যের রাজা ছিলেন প্রকাস। তার ছিল দুই ছেলে। বড় ছেলের নাম ছিল নুমিটর। আর ছোট ছেলের নাম ছিল অ্যামালিউস।

তখনকার দিনে নিয়ম ছিল রাজার মৃত্যুর পর তার বড় ছেলেই হবে রাজা। নিয়ম মোতাবেক রাজা হওয়ার কথা ছিল নুমিটরেরই। সেটা অবশ্য অ্যামালিউসও জানতেন। তবে তার ছিল সিংহাসনের খুব লোভ। যখন তিনি দেখলেন, নিয়ম মেনে চললে তার রাজা হওয়া অসম্ভব, তখন তিনি ফন্দি আঁটলেন নিজেকে রাজা হিসেবে ঘোষণা করার। কিন্তু ঘোষণা করলেই তো আর হবে না, সবাইকে সেই ঘোষণা মানতেও হবে। সে জন্য অ্যামালিউস এমন ব্যবস্থা করলেন, যাতে সবাই তাকে রাজা হিসেবে মানতে বাধ্য হয়। বড় ভাই নুমিটরকে তিনি তাড়িয়ে দিলেন প্রাসাদ থেকে। এরপর কবজা করলেন সিংহাসন। এবারে আর তাকে পায় কে! তিনিই হয়ে বসলেন রাজা। ওদিকে নুমিটর প্রাসাদ থেকে বিতাড়িত হয়ে গ্রাম এলাকায় এক খামারে গিয়ে বাস করতে শুরু করলেন।

ঘটনা শুধু এটুকুই ছিল না। অ্যামালিউস খুব নিষ্ঠুরতার সঙ্গে তার সব ভাইপোকে অর্থাৎ নুমিটরের সব ছেলেকে মেরে ফেললেন। যাতে ভবিষ্যতেও নুমিটরের বংশের কেউ রাজা হতে না পারে, সে জন্যই এই কাজ করেছিলেন তিনি। তবে নুমিটরের শুধু ছেলেই ছিল না। তার একটি মেয়েও ছিল। মেয়েটির নাম ছিল রিয়া সিলভিয়া। সেই মেয়েকেও তিনি তাড়ালেন প্রাসাদ থেকে। তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো এক দেবীর মন্দিরের পূজারিণী করে। ঠিক হলো, সেখানেই সে একা একা কাটিয়ে দেবে জীবন। এমন ব্যবস্থা করা হলো, যাতে অ্যামালিউসের হাত থেকে কখনোই সিংহাসন ফসকে না যায়।

রোমুলাস প্যালাটিন পাহাড়ে আশ্রয় নিয়ে আকাশে ১২টি শকুন দেখতে পেল। আর রেমাস অ্যাভেনটাইন পাহাড়ে আশ্রয় নিয়ে ৬টি শকুনের দেখা পেল।

এভাবে কাটল অনেক দিন। এরপর একদিন রিয়া সিলভিয়ার দুটি যমজ ছেলের জন্ম হলো। ছেলে দুটির জন্মের খবর পেয়ে ভীষণ ক্ষিপ্ত হলেন অ্যামালিউস। তিনি আদেশ দিলেন ভাইঝিকে বন্দী ও হত্যার। সেই সঙ্গে ছেলে দুটিকে মেরে টাইবার নদীতে ফেলে দেওয়ার। তার ভয় ছিল, এই ছেলেরা বড় হয়ে সিংহাসনের দাবিদার হবে।

ছেলে দুটি কিন্তু যে সে মানুষ ছিল না। তাদের বাবা ছিলেন যুদ্ধের দেবতা মার্স। কেউ কেউ অবশ্য তাদেরকে মহাবীর হারকিউলিসের ছেলে বলে মনে করেন। ছেলে দুটিকে জলে ডুবিয়ে মারার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এক চাকরের ওপর। সে তাদের নিয়ে গেল টাইবার নদীর ধারে। কিন্তু জলে ছুড়ে ফেলার সময় তার মনটা কেঁদে উঠল। অতটুকুন দুটি ছেলে। তাদের জলে ডুবিয়ে মারবে সে!  তখন সে সিদ্ধান্ত নিল, না, ছেলে দুটিকে সে প্রাণে মারবে না। কিন্তু তাদেরকে ফেরতও তো নিতে পারবে না। ভেবেচিন্তে উপায় একটা বের করল। একটি ছোট ঝুড়িতে করে ভাসিয়ে দিল সে ছেলে দুটিকে। 

নদীর জলে ভাসতে লাগল তারা। ভাসতে ভাসতে এক জায়গায় গিয়ে গাছের শিকড়ে আটকে গেল ঝুড়ি। আসলে দেবতা টাইবারনিয়াস নজর রাখছিলেন তাদের ওপরে। তার ইচ্ছেতেই ভেসে না গিয়ে শিকড়ে আটকে গিয়েছিল ঝুড়িটি। 

ছেলে দুটিকে ওভাবে ভাসতে দেখে খুব দয়া হলো এক মাদী নেকড়ের। সে তাদেরকে ঝুড়ি থেকে নিয়ে গেল নিজের গুহায়।  সেখানে ওই নেকড়ের দুধ পান করে বাঁচল তারা। ওদিকে ফাউস্টালাস নামের এক মেষপালকের কোনো সন্তান ছিল না। সে নেকড়ের গুহায় দুটি শিশু থাকার কথা জানতে পারল। তখন গুহা থেকে তার বাড়িতে নিয়ে গেল। তার স্ত্রী লরেনশিয়া ছেলে দুটিকে নিজের সন্তানের মতোই আদর দিয়ে মানুষ করল। ওই বাড়িতেই ছেলেদের নাম হলো রেমাস ও রোমুলাস। 

দিন গেল, মাস গেল, বছর গেল। রেমাস আর রোমুলাস বড় হলো। দুজনই হলো খুব সাহসী। ডাকাতদের কাছ থেকে ধনসম্পদ কেড়ে নিয়ে গরিব-দুঃখীদের মধ্যে তারা বিলিয়ে দিতে লাগল। এতে তাদের ওপর খেপে গেল ডাকাতেরা। তারা একসময় ধরে ফেলল রেমাসকে। তাকে তারা নিয়ে গেল রাজা অ্যামালিউসের দরবারে। সেখানে তার বিরুদ্ধে একটি মিথ্যা অভিযোগ আনা হলো। বলা হলো, রেমাস নুমিটরের মেষ চুরি করেছে। রাজা তখন তাকে নুমিটরের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। নুমিটর নিজের নাতিকে চিনে ফেললেন। ততক্ষণে দুই ভাইয়ের পালক পিতা ও রোমুলাস সেখানে হাজির হয়ে গেল। এবারে দুই নাতিকে একসঙ্গে দেখে নুমিটরের আর সন্দেহ রইল না যে তার নাতিরা প্রাণে বেঁচে গেছে। এবারে নানার সঙ্গে মিলে প্রতিশোধ নিল দুই ভাই। যুদ্ধ হলো ঘোরতর। মারা পড়ল অ্যামালিউস। নুমিটর পেলেন সিংহাসন।

নুমিটরের নির্দেশে দুই ভাই গেল নতুন শহর গড়তে। কিন্তু শহর কোথায় হবে এবং রাজা কে হবে, তা নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে প্রবল বিরোধ দেখা দিল। রোমুলাস প্যালাটিন পাহাড়ে আশ্রয় নিয়ে আকাশে ১২টি শকুন দেখতে পেল। আর রেমাস অ্যাভেনটাইন পাহাড়ে আশ্রয় নিয়ে ৬টি শকুনের দেখা পেল। বেশি পাখির দেখা পাওয়ায় রোমুলাস নিজেকে বিজয়ী বলে ঘোষণা করে আশ্রয়স্থলের চারপাশে পরিখা ও প্রাচীর তৈরি করতে শুরু করল। এই দেখে রেমাস এক লাফে প্রাচীরের ওপরে চড়ে বসল।  তখন রেগে গিয়ে রোমুলাস তাকে মেরে ফেলল। এরপর সে গড়ে  তুলল এক মস্ত শহর। এভাবেই একেবারে শূন্য থেকে যাত্রা করে রোমুলাস হয়ে গেল রাজা। প্রতিষ্ঠাতা রোমুলাসের নামানুসারে এই শহরের নাম হলো রোম। রোমান পুরাণ অনুযায়ী এটাই হলো রোম শহরের জন্মকথা।