রোবট ও একজন আইজ্যাক আসিমভ

প্রায় আড়াই শ বছর আগের ঘটনা। ইতালির বিজ্ঞানী লুইজি গ্যালভানি হঠাৎ চমকে ওঠার মতো এক আবিষ্কার করে বসেন। তিনি মৃত ব্যাঙের পা নিয়ে গবেষণা করছিলেন। একদিন লোহা ও তামার তার দিয়ে ব্যাঙকে স্পর্শ করতেই সেটি আচমকা নড়ে উঠল। একই ঘটনা বারবার ঘটতে থাকে। প্রথমে ভুতুড়ে কাণ্ড ভেবে ভয় পেলেন গ্যালভানি। একসময় তাঁর ধারণা হলো, মৃত ব্যাঙে প্রাণ ফিরে এসেছে। এ বিষয়ে তাঁর লেখা এক প্রতিবেদন সে সময় রীতিমতো চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। হইচই পড়ে যায় ইউরোপে। তবে শিগগিরই ভুল ভাঙে গ্যালভানির। কয়েক বছর গবেষণার পর তিনি বুঝতে পারেন, বিদ্যুতের প্রবাহের কারণে এমনটি ঘটছে। কিন্তু মরা ব্যাঙ নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকায় তত দিনে তাঁর কপালে জুটল ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ। নিন্দুকেরা তাঁর নাম দিল ব্যাঙ নাচানো অধ্যাপক। মজার ব্যাপার, আজ সেই নিন্দুকেরা কেউ টিকে নেই, আছেন গ্যালভানি। কারণ, বিজ্ঞানের ইতিহাসে তাঁর আবিষ্কার গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর সম্মানে বিদ্যুৎপ্রবাহ মাপার যন্ত্রের নাম দেওয়া হয়েছে গ্যালভানোমিটার।

গ্যালভানির মরা ব্যাঙ নাচানো দেখে সেকালে অনেকের ধারণা হয়েছিল, জীবনের গুপ্তরহস্য বোধ হয় এবার উদ্ঘাটিত হতে চলেছে। সে সময়ের বিখ্যাত দুজন ইংরেজ কবি জর্জ গর্ডন বায়রন আর পার্সি শেলিও তা-ই ভেবেছিলেন। ১৮১৬ সালে সুইজারল্যান্ডে ছিলেন দুজন। এক সন্ধ্যায় তাঁদের সঙ্গে ছিলেন শেলির বান্ধবী মেরি উলস্টোনক্র্যাফট। মেরিকে সে বছরই বিয়ে করেন শেলি। সেদিন তাঁরা গ্যালভানির চাঞ্চল্যকর ঘটনা নিয়ে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নিলেন, অদ্ভুতুড়ে আর অস্বাভাবিক ঘটনা নিয়ে গল্প লিখবেন। তবে বায়রন ও শেলি কথা রাখতে পারলেন না। মেরি ১৮১৮ সালে মাত্র একুশ বছরে লিখে ফেলেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। ব্যাপক সাড়া ফেলে বইটি। আর একেই প্রথম সার্থক বিজ্ঞান কল্পকাহিনি হিসেবে ধরা হয়।

সেকালের নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ওপর ভিত্তি করে লেখা হলেও গল্পটির কোনো বাস্তব ভিত্তি ছিল না। এরপর এক শ বছরে বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখা হলেও সেগুলোর কোনোটাই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন-এর মতো বিখ্যাত হয়নি। দীর্ঘ বিরতির পর, ১৯২০ সালে চেকোস্লোভাকিয়ান লেখক ক্যারেল চ্যাপেক ‘আর ইউ আর’ নামে বিজ্ঞান কল্পকাহিনিনির্ভর একটি নাটক লেখেন। নাটকে রোসাম নামের এক কারখানায় চাবি দেওয়া স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র বানানো হতো। যন্ত্রগুলো দেখতে মানুষের মতোই। সব ধরনের কাজ করে মানবজাতিকে শ্রমের মতো অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতেই এদের বানানো হয়েছিল। তবে এ উদ্দেশ্য শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। শিগগিরই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবের মতো এ যন্ত্রমানবেরা ভয়ংকর হয়ে একসময় পৃথিবী থেকে মানবজাতিকে চিরতরে মুছে ফেলে। শেষ পর্যন্ত বেঁচে যান রোসাম। আর ইউ আর আদ্যক্ষর দিয়ে রোসামের কারখানার নাম বোঝানো হয়েছিল, যার পূর্ণাঙ্গ অর্থ হচ্ছে রোসামস ইউনিভার্সাল রোবটস। চেক ভাষায় রোবট অর্থ ‘অনৈচ্ছিক কর্মী’ বা ‘ক্রীতদাস’। রোসামের রোবট এমনভাবে নকশা করা হয়েছিল, যাতে মানুষের সব কাজই করতে পারে তারা। এ নাটকের কল্যাণে একসময় রোবট শব্দের অর্থ দাঁড়ায় ‘কৃত্রিম মানুষ’। এখন স্বচালিত যন্ত্র বোঝাতে প্রায় সব ভাষাতেই ‘রোবট’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়।

এরপর বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিজ্ঞান কল্পকাহিনির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। ১৯২৬ সালে অ্যামেজিং স্টোরিজ নামের পুরোপুরি বিজ্ঞান কল্পকাহিনিনির্ভর প্রথম কোনো ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়। এসব ম্যাগাজিনে অনেকেই লিখতে থাকেন। এতে বছরে কয়েক শতাধিক বিজ্ঞান কল্পকাহিনি প্রকাশিত হতে থাকে, যার অনেকগুলো লেখা হতো রোবট নিয়ে। গল্পগুলোতে মেরি শেলি আর চ্যাপেকের শক্তিশালী প্রভাব ছিল। প্রায় সব বিজ্ঞান কল্পকাহিনিতেই রোবটকে ভয়ংকর কিংবা খুনে চরিত্র হিসেবে তুলে ধরা হতে থাকে।

ঠিক এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে আইজ্যাক আসিমভ নামের এক তরুণ লেখক পুরোনো এই ছকের বাইরে অন্য ধরনের রোবটের গল্প লেখার সিদ্ধান্ত নেন। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির আগ্রহ তাঁর। তাই দেখে টাইপরাইটার কিনে দিয়েছিলেন বাবা। প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লিখতে শুরু করেন ১৯৩৭ সালে। তখন আসিমভের বয়স মাত্র ১৭ বছর। গল্পটির নাম কসমিস কর্কস্ক্রু। ১৯৩৮ সালে গল্পটি লেখা শেষ করেন আসিমভ। প্রথম গল্প লেখার উত্তেজনায় সাতপাঁচ না ভেবেই তিনি সে সময়ের বিখ্যাত বিজ্ঞান কল্পকাহিনির পত্রিকা অ্যাসটাউন্ডিং-এর সম্পাদক ডব্লিউ ক্যাম্পবেলের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন গল্পটি। গল্পটি বাতিল করে আসিমভকে কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন ক্যাম্পবেল। শুধু প্রথমটিই নয়, পরপর ১২টি গল্প বাতিল করেন ক্যাম্পবেল। তবে হতাশ না হয়ে লেখা চালিয়ে যান আসিমভ। তার পরের বছর অন্যান্য পত্রিকায় গল্প বিক্রি করতে শুরু করেন তিনি। আসিমভের লেখা ৩২তম গল্প ছেপেছিল অ্যাসটাউন্ডিং। গল্পটির নাম নাইটফল, যা সর্বকালের সেরা বিজ্ঞান কল্পকাহিনি হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এরপর অ্যাসটাউন্ডিং পত্রিকায় নিয়মিত লেখক আর ক্যাম্পবেলের বিশ্বস্ত বন্ধু বনে যান আসিমভ। ১৯৩৯ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে নতুন ধরনের রোবটের গল্প লেখেন আসিমভ। সেই গল্পে রোবট এক সাধারণ যন্ত্র, যাকে নির্দিষ্ট কাজের জন্য বানানো হয়েছিল। এ ছাড়া রোবটটি আগে থেকেই রক্ষাকবচসহ তৈরি হয়েছিল। ফলে রোবটটি কারও ক্ষতি করতে পারত না। নতুন রোবটের কাহিনি দ্রুতই জনপ্রিয়তা পায়। এরপর রোবট নিয়ে একের পর এক গল্প লিখে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন আসিমভ।

আসিমভের গল্পের রোবটে আগে থেকেই ঢুকিয়ে দেওয়া সেই সুরক্ষাকবচকে ডাকা হতে লাগল, ‘রোবটিকসের তিনটি সূত্র’ হিসেবে। এখন রোবটসংক্রান্ত প্রায় গল্পেই এই তিনটি সূত্র থাকে। সূত্রগুলো হচ্ছে: ১. রোবট কখনো মানুষের ক্ষতি করবে না বা কোনো মানুষের কোনো ক্ষতি হতে দেবে না। ২. রোবট অবশ্যই মানুষের নির্দেশ মেনে চলবে, যদি না সেই নির্দেশ প্রথম সূত্রকে লঙ্ঘন করে। ৩. রোবট সব সময় নিজেকে রক্ষা করবে, যদি না তা প্রথম ও দ্বিতীয় সূত্রকে লঙ্ঘন করে।

আসিমভ রোবটিকসের তিনটি সূত্র প্রথম উল্লেখ করেছিলেন ‘রানঅ্যারাউন্ড’ গল্পে। গল্পটি প্রকাশিত হয় ১৯৪২ সালে। এ গল্পের মাধ্যমে রোবটিকস শব্দটিও প্রথমবার ছাপার অক্ষরে দেখা গিয়েছিল। বর্তমানে রোবট নিয়ে পড়ালেখা, নকশা, রোবট বানানো, রক্ষণাবেক্ষণ এবং রোবট মেরামত বোঝাতে সবাই এ শব্দটি ব্যবহার করেন।

এই তিনটি সূত্রই ছিল রোবট নিয়ে মানুষের আতঙ্কের অবসানে প্রথমবারের মতো কোনো সত্যিকারের প্রচেষ্টা। আসিমভের ভাষায়, রোবট নিয়ে মানুষের এই আতঙ্কের নাম ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন কমপ্লেক্স’। তাঁর প্রচেষ্টা সফল হয়েছিল। আসিমভের রোবটের গল্পের কারণে পুরোনো ধাঁচের রোবটের গল্প একসময় অচল হয়ে পড়ে। এতে ভালো বিজ্ঞান কল্পকাহিনিকারেরা সেকেলে ধাঁচের রোবটের গল্প লেখা বন্ধ করে দেন। পাশাপাশি রোবটকে তাঁরা নিরীহ আর উপকারী, এমনকি ভালোবাসার যোগ্য চরিত্র হিসেবে গল্পে তুলে ধরতে শুরু করেন। এর ধারাবাহিকতায় স্টার ওয়ার্স চলচ্চিত্রে C3PO আর R2D2 নামের দুটি রোবট দেখা গিয়েছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, রোবট দুটি দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।

তবে আমরা যেগুলোকে বিজ্ঞান কল্পকাহিনি বলছি, সেগুলো বিজ্ঞানী আর প্রকৌশলীদের উৎসাহ জোগায়। গল্পে বর্ণিত কোনো উন্নত কিছু নিয়ে কাজ করতে অনুপ্রাণিত হন তাঁরা। উদাহরণ হিসেবে ১৯৫০ সালের একটি ঘটনার কথা বলা যায়। সে বছর রোবট নিয়ে আসিমভের লেখা মোট নয়টি গল্প একত্র করে আই, রোবট নামে বই প্রকাশিত হয়েছিল। বইটি ব্যাপকভাবে পঠিত ও জনপ্রিয় হয়েছিল। সেই সঙ্গে বইটি প্রভাবশালী বলেও প্রমাণিত হয়েছিল।

বইটির প্রথম দিকের পাঠক ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জোসেফ এফ এঞ্জেলবার্গার। এটি পড়ে তিনি ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে বাকি জীবন রোবটের পেছনে উৎসর্গ করতে মনস্থির করেন। পরে প্রকৌশলী জর্জ ডেভোলের সঙ্গে যৌথভাবে বিশ্বের প্রথম রোবট কারখানা খোলেন তিনি। নাম ইউনিমেশন ইনকরপোরেট। তাঁকে বলা হয় রোবটিকসের জনক। এ প্রতিষ্ঠান থেকে বিশ্বের প্রথম রোবট তৈরি হয়েছিল, যা শিল্পকারখানায় উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা হয়। সেই ছিল শুরু, এখন তো সারা বিশ্বে ঘর ঝাড়ু দেওয়া থেকে শুরু করে মহাকাশ গবেষণায় রোবট ব্যবহার করা হচ্ছে। বর্তমানে যাঁরা রোবটিকস নিয়ে কাজ করেন তাঁদের অধিকাংশই আই, রোবট পড়েছেন এবং বইটি দিয়ে প্রভাবিত। অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে, আসিমভ শুধুই লেখক। তিনি রোবট নিয়ে কোনো কাজ করেননি, শুধু তাঁদের নিয়ে গল্প লিখতেই পছন্দ করেন। তার পরও রোবটের ইতিহাসে তাঁর নাম যুক্ত হয়েছে।

রোবটের গল্প ছাড়াও ‘ফাউন্ডেশন ট্রিলজি’ আসিমভের সেরা রচনা বলে সমালোচকদের ধারণা। এ ট্রিলজি ১৯৬৬ সালে সর্বকালের সেরা বিজ্ঞান কল্পকাহিনি হিসেবে হুগো অ্যাওয়ার্ড পায়। ১৯৮৭ সালে তাঁকে ‘গ্র্যান্ডমাস্টার অব সায়েন্স ফিকশন’ সম্মানে ভূষিত করা হয়। তিনি ‘হুগো অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন চারবার। পেয়েছেন নেবুলা পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার। আসিমভের সম্মানে তাঁর নামেও একাধিক পুরস্কার চালু হয়েছে। তাঁর নামে নিয়মিত প্রকাশিত হয় একটি বিজ্ঞান কল্পকাহিনি পত্রিকা। তাঁকে সম্মান জানাতে ১৯৮১ সালে একটি গ্রহাণুর নাম রাখা হয় ‘৫০২০ আসিমভ’। মঙ্গল গ্রহের এক খাদের নাম আসিমভ। তাই ১৯৯২ সালে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও বিজ্ঞান কল্পকাহিনি আর রোবটিকসে অবদানের জন্য আসিমভ এখনো অমর।

আইজ্যাক আসিমভের হাউ ডু উই নো অ্যাবাউট রোবট অবলম্বনে