অভিধানের গল্পের আজকের বাগধারা ও শব্দগুলো গানের। ধ্রুপদি গানের সঙ্গে যাদের তেমন জানাশোনা নেই, তাদের পক্ষে অবশ্য বিষয়গুলো যে গানের, তা বুঝে ওঠা বেশ মুশকিল। মজার ব্যাপার, এগুলো গান নিয়ে হলেও এখন আর গানের সঙ্গে এদের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। অর্থও গেছে একেবারে পাল্টে। তার মধ্যে গানের বিন্দুবিসর্গও নেই।
ঢিমেতাল
অনেকের জীবন ও সংসার ঢিমেতালে চলে। অনেক অফিস বা কারখানায় টিমেতালে কাজকর্ম চলে। ঢিমেতাল কথাটার অর্থ মন্থরগতি বা অতি ধীরগতি।
এখন বাগধারা হলেও ঢিমেতাল আসলে গানের তালের প্রকারভেদ। উচ্চাঙ্গসংগীতের শিল্পীকে তাঁর গান বা বাজনার কিছুটা অংশ তালরক্ষার প্রয়োজনে ঢিমে বা ধীর লয়ে গাইতে হয়। ঢিমে শব্দের অর্থ ধীর বা মৃদু। সংগীতের ধীর লয়ের এই ঢিমেতালই বাগধারার রূপ নিয়েছে বাংলা ভাষায়।
ঢিমেতাল দুই প্রকার—ঢিমে একতাল ও ঢিমে ত্রিতাল। ঢিমে ত্রিতাল ঢিমে তেতালা হয়ে গিয়ে আরও একটি বাগধারার জন্ম দিয়েছে। যে ব্যক্তি সর্বদাই ধীরগতিতে কাজ করে, তার স্বভাবচরিত্র বোঝাতে গিয়ে ঢিমে তেতালা বাগ্ধারাটি ব্যবহৃত হয়।
আটঘাট
মানুষ অনেক সময়েই আটঘাট বেঁধে কাজে নামে বা আটঘাট বেঁধে কাজ শুরু করে। আটঘাট কথাটির অর্থ সব ধরনের প্রস্তাব গ্রহণ করা বা সব ধরনের বাধা দূর করা।
আটঘাট কথাটা এসেছে তবলা থেকে। তবলার গায়ের একেকটি ঘুঁটির ওপর চামড়ার যে দুটি ফিতা থাকে, তার মাঝের অংশটাকে বলে ঘাট। ঘাট আটটি। তবলা বাজানো শুরু করার আগে ঘুঁটির ওপর হাতুড়ি ঠুকে ঘাট বেঁধে নিতে হয়। নইলে তবলার বোল ঠিকমতো বের হয় না।
এই যে সাংগীতিক প্রস্তুতি, এটাই তবলার বোল পেরিয়ে ঢুকে পড়েছে মুখের কথায়। যেকোনো কাজ আটঘাট বেঁধে শুরু করা বিচক্ষণতার লক্ষণ।
পোঁ ধরা
অন্ধভাবে প্রতাপশালী কোনো ব্যক্তির কথার সঙ্গে মিলিয়ে বা তোষামোদ করে কথা বলাকে পোঁ ধরা বাগ্ধারার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। পোঁ ধরা বাগধারার অর্থ তোষামোদ করা।
পোঁ হলো সানাইয়ের ধ্বনি। মূল সানাইবাদকের সঙ্গে থাকেন সহযোগী সানাইবাদক। মূল সানাইবাদক বিভিন্ন সুর-তাল-লয়ে সানাই বাজালেও সহযোগী সানাইবাদক পোঁ করে একটানা অপরিবর্তনীয় সুরে বাজিয়ে চলেন। সহযোগী সানাইবাদকের এই একটানা পোঁ করে বাজানো থেকেই পোঁ ধরা বাগ্ধারার সৃষ্টি।
খাণ্ডারনি
কলহে ভীষণ ও উগ্র মেজাজযুক্ত নারীকে মানুষ খাণ্ডারনি বলে আখ্যায়িত করে থাকে। তাঁর নাম শুনলে অনেকে ভীত হয়। তাঁকে দেখলে অনেকে ভীত হয়ে পড়ে। মানুষ কখনো প্রকাশ্যে সেই নারীকে খাণ্ডারনি বলার সাহস রাখে না। খাণ্ডারনি শব্দটার অর্থ কলহপ্রিয় ও বদমেজাজি।
এই উপমহাদেশের প্রাচীন গীতপদ্ধতির একটি হলো খাণ্ডারি গীতি। এই খাণ্ডারি গীতি থেকে ধ্রুপদের চারটি বাণীর অন্যতম বাণী খাণ্ডার বাণীর উদ্ভব। আর এই খাণ্ডার বাণী থেকেই বাংলা খাণ্ডারনি কথাটার উৎপত্তি।
খাণ্ডারি গীতি ও খাণ্ডার বাণী বীররসপ্রধান গয়ানভঙ্গি। এই বীররসের আধিক্য যে নারীর মধ্যে ঘটে, মানুষ আড়ালে সেই নারীকেই খাণ্ডারনি বলে থাকে।
গৎবাঁধা
জীবন কিংবা জীবনের সবকিছুতেই যে সর্বদা বৈচিত্র্য থাকবে, এমন নয়। অনেককেই গত্বাঁধা জীবন যাপন করে যেতে হয়। অনেকেই প্রতিদিন গৎবাঁধা কাজ করে থাকেন। কারও মুখে থাকে শুধু গৎবাঁধা বুলি। গৎবাঁধা বাগধারাটির অর্থ নিয়ম বাঁধা, রুটিনমাফিক, একই ধরনের ইত্যাদি।
গৎবাঁধা বাগধারাটি এসেছে বাদ্য বা বাজনা থেকে। গৎ শব্দের মূল অর্থ হলো বাজনার বোল। বোলের ওপর নির্ভর করে ছন্দোবদ্ধ সংগীতরূপ হলো গৎ-এর প্রকৃত রূপ।
গৎ প্রধানত খেয়ালের অনুকরণে রচিত হয়।
গৎ-এর মধ্যে খেয়াল গানের যে ধীরগতি এবং ছন্দের যে নিয়মবন্ধন রয়েছে, সেটাই মুখের কথায় উঠে এসেছে গৎবাঁধা বাগধারার মাধ্যমে।
ফাঁকতাল
জগৎ সংসারে এমন অনেকে আছেন, যাঁরা ফাঁকতালে কখন কেটে পড়তে হবে অথবা ফাঁকতালে কোন কাজটা হাসিল করে নিতে হবে, তা বেশ ভালোমতো বোঝেন এবং জানেন। ফাঁকতাল শব্দটির অর্থ হলো সুযোগ বা অনুকূল মুহূর্ত। ফাঁকতাল বাগধারা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ফাঁকতাল সংগীতশাস্ত্রের একটি পারিভাষিক শব্দ। তালের যে অঙ্গে ঝোঁক পড়ে না, সেই অঙ্কটিই হলো ফাঁকতাল। স্বরলিপিতে তালের অঙ্কে (০) শূন্য বসিয়ে ফাঁকতাল নির্দেশ করা হয়ে থাকে। ফাঁকতালের শূন্য অবস্থার বিষয়টিই অবসর ও সুযোগ অর্থে বাগধারা হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
তালকানা
সংসারে তালকানা লোকের অভাব নেই। যিনি ঠিক সময়ে বেঠিক কাজটি করে বসেন, মানুষ সেই লোকটিকে বলে থাকে তালকানা। তালকানা শব্দের অর্থ কাণ্ডজ্ঞানহীন বা অসাবধান।
বাংলায় তাল শব্দটার নানা রকম অর্থ রয়েছে। তাল শব্দের একটি অর্থ হলো গীত, বাদ্য ও নৃত্যে সময়ের বিভাগ বা মাত্রা। ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে এই তাল থেকেই তালকানা মানুষের পরিচিতি।
তালের গতি হলো লয়। তাল ও লয় ভঙ্গ হলে সংগীতের বা নৃত্যের রসভঙ্গ হয়। তাল ও লয় যিনি ভঙ্গ করেন, আসলে তিনিই হলেন তালকানা। কিন্তু মানুষ এখন কাণ্ডহীন মানুষকেই তালকানা বলে থাকে।