শব্দগুলো মজার অনেক

ভাষার শব্দের খামখেয়ালিপনার অন্ত নেই। শব্দের খামখেয়াল সবচেয়ে বেশি দেখা যায় তার অর্থের বেলায়। একাধিক অর্থ নেই, এমন শব্দ নিতান্তই বিরল। তা ছাড়া শব্দের অর্থ নির্দিষ্ট জায়গায় থাকেও না। নানাভাবে, নানা কারণে শব্দের অর্থের পরিবর্তন ঘটে। এমনও দেখা যায়, একটি শব্দের একদা নেতিবাচক অর্থ ছিল, কিন্তু এখন সে অর্থ ইতিবাচক হয়ে গেছে। এর উল্টো ঘটনাও কিন্তু ঘটে। বিদেশি ভাষা থেকে আগত শব্দের বেলাতেও এর ব্যতিক্রম দেখা যায় না।

‘অভিধানের গল্প’ শব্দ ও শব্দের অর্থের এই বিচিত্র আচরণ নিয়ে আবর্তিত। একবার মজা পেয়ে গেলে এ আবর্তন থেকে বেরিয়ে আসতেও মন চাইবে না। এর মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতে দেখা পাওয়া যাবে ‘আমোদের অফুরন্ত খনির’।

অলংকরণ: রাকিব রাজ্জাক

খামখেয়াল

শব্দের খামখেয়ালিপনার যে খামখেয়াল, তা আসলে আলংকারিক প্রয়োগ। খামখেয়াল থাকে মানুষের। সংসারে অনেক মানুষকেই খামখেয়ালি হতে দেখা যায়। তারা খামখেয়ালি কাজ বা কাণ্ডকারখানা দেখিয়ে থাকে। বাংলায় খামখেয়াল বলতে বোঝায় খেয়ালি চিন্তা বা কল্পনাবিলাস। আর খামখেয়ালি হলো কল্পনাবিলাসী, অস্থিরমতি ইত্যাদি। খামখেয়ালি মানুষ বিশ্বের সর্বত্র বিরাজিত। কিন্তু একেক ভাষায় তাদের কী বলে, তা আমার জানা নেই।

বাঙালির সমাজ-সংসারে খামখেয়ালি লোকের অভাব নেই। এদের বিচিত্র আচার-আচরণের কারণে এরা প্রায়ই বাস্তববুদ্ধির লোকের ভর্ৎসনা শিকার হয়।

মজার ব্যাপার, বাঙালির ঘাড়ে খামখেয়ালির ভূত চাপলেও এই খামখেয়াল শব্দটা কিন্তু বাংলা নয়। ফারসি ও আরবি মিলে তৈরি নতুন এক শব্দ, যাকে বাংলা শব্দ বললে দোষের হয় না, কিন্তু পণ্ডিতদের মতে তা বিদেশি শব্দ।

ফারসি খাম এবং আরবি খায়াল মিলে তৈরি হয়েছে খামখেয়াল শব্দটি। খেয়াল অংশ বিশুদ্ধ আরবি উচ্চারণ নয়, উচ্চারণে বাঙালিয়ানা রয়েছে।

ফারসি খাম শব্দের তিন রকমের অর্থ যেমন—এক. কাঁচা, অপরিপক্ব; দুই. চামড়ার তৈরি পোশাক, এনভেলাপ বা লেফাফা এবং তিন. সামান্য জখম। আরবি খেয়াল শব্দের অর্থ কল্পনা, ধারণা, অবাস্তব চিন্তা ইত্যাদি। খামখেয়ালে ফারসি খাম শব্দের এক নম্বর অর্থটা ধরা হয়েছে। বস্তুত কাঁচা এবং অপরিপক্ব চিন্তাভাবনাই তো খামখেয়াল।

অলংকরণ: রাকিব রাজ্জাক

দাব

বাংলা ভাষায় দাবিয়ে রাখা, দাবানো, দেবে যাওয়া, দাবদাহ, দাবানল ইত্যাদি নানা শব্দ রয়েছে। এর সবই দাব শব্দ দিয়ে গঠিত। কিন্তু সব দাব এক দাব নয়।

দাবানল, দাবদাহের যে দাব, তা সরাসরি সংস্কৃত থেকে আগত। এই দাব শব্দের অর্থ বন। বনে লাগা আগুন হলো দাবানল। আর দাবদাহ হলো দাবানলের জ্বালা।

দাবানো, দেবে যাওয়ার যে দাব, তা হিন্দি দাবনা থেকে তৈরি। এর অর্থ চাপা, টেপা (যেমন, হাত-পা দাবানো বা দেবে দেওয়া), মর্দিত করা ইত্যাদি। বগলদাবা করার দাবাও হিন্দি দাবনা থেকেই।

এবার আসি দাবিয়ে রাখার দাব প্রসঙ্গে। প্রথমেই স্মরণ করি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের অবিস্মরণীয় ভাষণের কথা, যেখানে তিনি বলেছেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না’। দাবায়ে রাখা কথাটা আঞ্চলিক, যা বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব বাগ্ভঙ্গির একটা দিক। এই দাবিয়ে বা দাবায়ে রাখার উৎস যে দাব শব্দ, তা বাংলায় এসেছে হিন্দি থেকে। হিন্দিতে এই দাব শব্দের অর্থ দমন, শাসন, নিগ্রহ। তবে দাব শব্দটা পুরোপুরি হিন্দি নয়। এর মূলে রয়েছে সংস্কৃত দর্প—যার অর্থ অহংকার, অন্যকে খর্ব করার ইচ্ছা।

অলংকরণ: রাকিব রাজ্জাক

দাপিয়ে বেড়ানো

সাংবাদিকদের প্রতিবেদনে দাপিয়ে বেড়ানো কথাটার বেশ চল শুরু হয়েছে। কথাটি তাঁরা ব্যবহার করেন কোনো জায়গায় ক্ষমতাবানদের দাপট প্রদর্শন বোঝাতে। এই দাপিয়ে বেড়ানোর সাধারণ অর্থ হলো একত্রে পায়ের শব্দ করে আস্ফাালন দেখানো।

দাপিয়ে বা দাপানো কথাটার মধ্যে দাপ শব্দটি রয়েছে। দাপ এসেছে সংস্কৃত দর্প থেকে। বাংলায় দাপ শব্দের অর্থ দাপট, প্রতাপ ইত্যাদি। কিন্তু দাপ শব্দের সরাসরি কোনো ব্যবহার নেই।

অলংকরণ: রাকিব রাজ্জাক

গোলযোগ

গোলমাল এবং গন্ডগোলের চোটে গোলযোগ শব্দটা ইদানীং বাংলায় অচল শব্দের শ্রেণিতে বসতে চলেছে। অথচ গোলযোগ শব্দটা এককালে বেশ চালু ছিল, বিশেষত সংসারের বিশৃঙ্খল অবস্থা বোঝাতে গোলযোগ কথাটাই ব্যবহার করা হতো। গোলযোগ বলতে বোঝায় জটিল পরিস্থিতি, বিশৃঙ্খলা, অব্যবস্থা, ব্যাঘাত, কোলাহল ইত্যাদি।

গোলযোগ সংস্কৃত শব্দ। সংস্কৃত গোলযোগের সঙ্গে বাংলা গোলযোগের কোনো সম্পর্ক নেই। সংস্কৃত গোলযোগ বলতে বোঝায় এক রাশিতে ছয় বা সাতটি গ্রহের একত্র হওয়ার ঘটনা।

গন্ডগোল

গন্ডগোলের গোল শব্দটি ফারসি ভাষার। গোল শব্দের অর্থ গোলমাল, কলরব, হল্লা ইত্যাদি। বাঙালির গোল বেধে যায় ‘গণ্ড’ শব্দটি নিয়ে। অনেকেই গণ্ডগ্রাম বলতে বোঝায় অজপাড়াগাঁ। কিন্তু গণ্ডগ্রাম আসলে বৃহৎ বা শ্রেষ্ঠ গ্রাম। সংস্কৃত গণ্ড শব্দের অর্থ শ্রেষ্ঠ, কপোল বা গাল ইত্যাদি।

অলংকরণ: রাকিব রাজ্জাক

যা-ই হোক, গন্ডগোলের গন্ড শব্দটি মোটেও সংস্কৃত নয়। তাই গন্ডগোল প্রচণ্ড গোলমালও নয়। তামিল ভাষার গোন্দ্রা গোল থেকে বাংলা গন্ডগোল শব্দটি এসেছে বলে উল্লেখ করেছেন পণ্ডিত বিজয়চন্দ্র মজুমদার তাঁর দ্য হিস্টরি অব বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ গ্রন্থে। মধ্যযুগে রচিত কৃত্তিবাসী রামায়ণে গোন্ড গোল শব্দটি পাওয়া যায়। অধিকাংশ পণ্ডিতের মতে, এই শব্দই কালক্রমে গন্ডগোল রূপে বাংলায় ব্যবহৃত হতে থাকে। তবে তামিল গোন্দ্রা গোল খানিকটা মোলায়েম ধরনের শব্দ, বাংলা গন্ডগোলের মতো নয়। গোন্দ্রা গোল শব্দের মূল অর্থ চিৎকার, চেঁচামেচি ইত্যাদি।

প্রসঙ্গত, একটা কথা বলি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়টাকে অনেকের মুখে গন্ডগোলের সময় বলে শুনতে পাই। এরা পাষণ্ড। এদের ধিক্কার জানাই।