শব্দগুলো হাসির

আজকের অভিধানের গল্পের বিষয় হাসি। মানুষ নানা কারণে হাসে। মানুষ কেন হাসে, অভিধানে অবশ্য তার কোনো উত্তর নেই।

তবে হাসির কারণ ও বিষয় অনুসারে মানুষ যে বিভিন্ন ভাবভঙ্গিতে হাসে—অভিধানে হাসির সেসব অভিব্যক্তি ব্যক্ত করার জন্য বহুবিধ শব্দ রয়েছে এবং রয়েছে বিচিত্র সব ভঙ্গিমার হাসির নানা রকম অর্থ।

কেউ কেউ সদাহাস্যময়। সর্বদা হাসিমুখে থাকতে ভালোবাসেন। সদাহাস্যমুখী বালিকাকে বলা হয় হাসকুটে। অনেকে হাসিমুখে সব সহ্য করতে পারেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় রয়েছে, ‘হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস।’

অনেকে হেসে কুটিকুটি হয়। কেউ হেসে গড়িয়ে পড়ে। কেউবা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দেয়। কেউ হাসে মুখ টিপে, কেউবা হাসে দম ফাটানো বা প্রাণখোলা হাসি।

অনেকের হাসিহাসি মুখ, হাসিখুশি চেহারা। এঁরা জীবনটা হেসেখেলে কাটিয়ে দিতে চান। কারও মুখে হাসি ধরে না, কেউ আবার অদ্ভুত কাণ্ড করে লোকের মুখ হাসান। মানুষ তাই নিয়ে হাসাহাসি করে।

হাসতে হাসতে কারও পেটে খিল ধরে। কেউ আবার হেসে খুন হন। কেউবা বলেন কাণ্ড দেখে হেসে বাঁচিনে।

সংসারে হাস্যরসিক মানুষের অভাব নেই। সবকিছু নিয়েই তাঁরা হাস্যকৌতুক বা হাস্য পরিহাস করতে পারেন। আবার হাস্যরসাত্মক কথা শোনার পরও অনেকের মুখে হাসি ফোটে না। গম্ভীর এই মানুষেরা প্রবাদবাক্য আওড়ান—যত হাসি তত কান্না, বলে গেছেন রামশর্মা। অনেকেই তাঁদের কথা হাস্যকর বলে হেসে উড়িয়ে দেন।

হাসি বা হাস্য নিয়ে কিছু শব্দ, বাক্যাংশ ও বাক্যের উদাহরণ এতক্ষণ দেওয়া হলো। হাসির এসব ভঙ্গিমার প্রতিটির কিন্তু আলাদা অর্থ রয়েছে। কষ্ট করে অভিধান দেখে অর্থগুলো বের করতে হবে। অভিধানের গল্পতে অর্থ পাওয়া যাবে না।

হাসি শুধু মুখে থাকে না, চোখেও থাকে। চোখের হাসি বড় রহস্যময়।

হাসির শব্দকেও নানাভাবে প্রকাশ করা হয়। হো-হো, হা-হা, হি-হি, খিলখিল, ফিকফিক, খিকখিক, খলখল—এগুলো হাসির শব্দ। খিলখিল করে হাসে মেয়েরা। বাচ্চা মেয়েদের খিলখিল হাসি অসম্ভব শ্রুতিমধুর। খলখল করে হাসে ছেলেরা। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় আছে, ‘হেসে খলখল...’। মেয়েরা ফিক করে হাসে, আবার ফিকফিক করেও হাসে। যাহোক, কোনো হাসিই অর্থহীন নয়, সবই অর্থপূর্ণ।

সবশেষে বাঙালির কিছু মার্কা মারা হাসির কথা। হাস্যময় এসব বাক্যাংশকে বাগ্ধারা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এগুলোর কোনোটা বহুল ব্যবহূত। কোনোটা আবার ইদানীং অপ্রচলিত।

অলংকরণ: সাদমান মুন্তাসির

অট্টহাসি

বাঙালির অট্টহাসি বেশ বিখ্যাত। অট্ট শব্দের অর্থ হলো উচ্চ। উচ্চরবের হাসি হলো অট্টহাসি।

অট্টহাসি সবার আসে না। অট্টহাসি হাসতে পারেন ক্ষমতাবানেরা। অসহায় কাউকে বাগে আনার পর দম্ভভরে অথবা বিদ্রূপাত্মকভাবে উচ্চরবে তাঁরা যে একটানা হাসি দেন, সেটাই অট্টহাসি।

অট্টহাসির নমুনা শুনতে পাওয়া যায় সিনেমা বা যাত্রাপালার ভিলেন বা খলনায়কের মুখে।

শিষ্টজনেরাও অনেক সময় অট্টহাসি দেন। সেটা অবশ্য দম ফাটানো বা প্রাণখোলা হাসির পর্যায়ে পড়ে। বন্ধুদের আড্ডায় সবার একসঙ্গে এ রকম প্রাণখোলা হাসির শব্দকে বলে হাসির গররা।

অলংকরণ: সাদমান মুন্তাসির

কাষ্ঠাসি

কাঠ সব সময় শুকনোই হয়। ভেজা থাকলে কিংবা ভিজে গেলে পর তাকে বলা হয় ভেজা কাঠ। শুকনো কাঠে রসকষ নেই। শুকনো কাঠের মতো মানুষের আন্তরিকতাও অনেক সময় রসকষহীন হয়। তারপরও মানুষ লোক দেখানো আন্তরিকতাহীন কৃত্রিম হাসি হাসার চেষ্টা করে। এ ধরনের হাসিকেই বলে কাষ্ঠহাসি। কাষ্ঠহাসির পেছনে কিছু একটা গোপন করার চেষ্টা থাকে।

অলংকরণ: সাদমান মুন্তাসির

দেঁতো হাসি

দেঁতো হাসি এবং কাষ্ঠহাসিতে খুব একটা ফারাক নেই। দেঁতো হাসিও কৃত্রিম, কপট। ঠোঁট দুটো একটু ফাঁক করে দাঁত বের করা যান্ত্রিক হাসিকেই বলে দেঁতো হাসি। লোক দেখানো এই দেঁতো হাসি রাস্তাঘাটে স্বল্প পরিচিত কিংবা বিরক্তিকর কোনো লোককে সহজে এড়ানোর জন্যই দেওয়া হয়। দেঁতো হাসি নিতান্তই পোশাকি হাসি।

অলংকরণ: সাদমান মুন্তাসির

দেখন-হাসি

দেখন-হাসি হলো দেখাদেখি হওয়ার পর হাসি অর্থাৎ দৃষ্টি পড়ামাত্র আনন্দে যাদের মুখ হাস্যময় হয়। হাসির সঙ্গে দেখন-হাসি শব্দের সম্পর্ক এটুকুই। দেখন-হাসি বিশেষ্য পদ। দেখন-হাসি শব্দের অর্থ প্রিয় সখী। প্রিয় বন্ধুদের মধ্যে পরস্পর দেখা হলে হাসাহাসি তো হবেই—সম্ভবত এ জন্যই এই হাসি দেখন-হাসি নাম। দেখন-হাসি এখন আর তেমন প্রচলিত নয়। এখন এটি আভিধানিক শব্দ।

অলংকরণ: সাদমান মুন্তাসির

মুচকি হাসি

মুচকি হাসির আরেক রূপ মুচকি মুচকি হাসি। দুই হাসির অর্থ অবশ্য আলাদা। মুচকি হাসি বেশ রহস্যময়। যে হাসি শুধু চোখে ও বন্ধ ঠোঁটে খেলে যায়—সে হাসিকেই বলে মুচকি হাসি। অপরিচিত কারও সামনে মুচকি হাসি চলে না। মুচকি হাসি হাসার পাত্রপাত্রী আলাদা। এ হাসি শুধু ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

মুচকি মুচকি হাসি আরও রহস্যময়। কারও গোপন কিছু জেনে ফেলার পর তা প্রকাশ অথবা গোপন করার অভিপ্রায়ে তার সামনে এই হাসি হাসা হয়। মুচকি হাসি উদ্দেশ্যমূলক হাসি।