শার্লক হোমস বা ফেলুদা কীভাবে ভাবতেন

একটিমাত্র পুরোনো হাতঘড়ি দেখে সেটার মালিক সম্পর্কে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বলে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের অনবদ্য চরিত্র শার্লক হোমসের। কী সে ক্ষমতা? জিজ্ঞেস করলে মৃদু হেসে হোমস বলতেন, ‘It was easier to know it than to explain why I know it.’ তিনি তার কাহিনিকার ডা. ওয়াটসনের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির উত্তরে বলতেন, ‘You know my methods, Watson.’ কী সেই ‘মেথড’, যাতে করে তিনি ব্যাখ্যা করতেন নানা অজানা রহস্যের, অথচ কাহিনি শেষে কখনো মনে হতো না তিনি ম্যাজিক দেখাচ্ছেন—সবকিছুরই একটি বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা পাওয়া যেত। একই কথা ফেলুদার বেলায়—প্রদোষ চন্দ্র মিত্তির, সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্র। তোপসের মুখ দেখে সে বলে দিতে পারত দার্জিলিং মেলের কোন পাশের বেঞ্চে সে বসেছিল—যার ব্যাখ্যা ফেলুদা দেয় এভাবে, ‘আজ বিকেলে রোদ ছিল। তোর বাঁ গালটা ঝলসেছে, ডান ধারেরটা ঝলসায়নি। একমাত্র ওই বেঞ্চিগুলোর একটাতে বসলেই পশ্চিমের রোদটা বাঁ গালে পড়ে।’

কেবল শার্লক হোমস বা ফেলুদা নয়, দেশি-বিদেশি নানান গোয়েন্দা কিরীটী রায়, প্রিয়নাথ দারোগা, জয়ন্ত, পরাশর রায়, দীপক চ্যাটার্জি, কর্নেল, ব্যোমকেশ, কিশোর-মুসা-রবিন, রবার্ট ব্লেক, অগস্টে ডুপিঁ, মিস মার্পল, জিমি কুডো, এরকুল পোয়ারো—প্রায় সবারই কিন্তু এই ‘ক্ষমতা’ ছিল। প্রথম দিকে মনে হয় তারা জাদুবিদ্যা জানেন, কিন্তু পরে যখন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, তখন মনে হয় ‘জলবৎ তরলং’। ‘দ্য সাইন অব ফোর’ উপন্যাসে কোনান ডয়েল শার্লক হোমসের মুখ দিয়ে তাই বলিয়েছেন, ‘গোয়েন্দাগিরিটা আদপেই একটা বিজ্ঞান।...আর আদর্শ গোয়েন্দার জন্য প্রয়োজন তিনটি গুণ—পর্যবেক্ষণ, ডিডাকশন আর জ্ঞান।’

এই বিশেষভাবে চিন্তা করার দক্ষতা, বিশ্লেষণ করার পারদর্শিতা—সবকিছুকে একসঙ্গে বলা যায় ‘মেটাকগনিটিভ স্কিল’, যাকে বাংলায় বলা যেতে পারে অনেকগুলো ধারণা বা চেতনাকে একসঙ্গে বিশ্লেষণ করে ডিডাকশন (অনুমানভিত্তিক সিদ্ধান্ত) পদ্ধতি প্রয়োগ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া। আমাদের মস্তিষ্কের কর্টেক্স থাকে, সেটার পেছনের অংশ কেবল কোনো প্রণোদনায় সাড়া দিতে সক্ষম, যেটাকে বলা হয় ‘রেসপন্স বা রেটিং’ আর কর্টেক্সের যে অংশে এটি ঘটে, সেটাকে বলা হয় ‘অবজেক্ট লেভেল’।

কিন্তু মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোবের সামনের অংশ, যার নাম ‘প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স’, সেটি সেই প্রণোদনাকে মূল্যায়ন বিশ্লেষণ করে আর আগের স্মৃতিতে থাকা তথ্যকে সমন্বয় করে ডিডাকশনের ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলে সেটাকে বলা হয় ‘মেটাকগনিশন’। এই মেটাকগনিশন হয় মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল অংশে, যাকে বলা হয় ‘মেটা লেভেল’।

এ বিষয় নিয়ে যাঁরা গবেষণা করছেন, এমন কয়েকজন বিজ্ঞানী ফার্নান্দেজ, পোসনার আর বেয়ার্ডের মতে, মেটাকগনিশন আমাদের সাধারণ চিন্তাধারার চেয়ে বেশি কিছু—সাধারণ ভাবনার বাইরে মেটাকগনিশনের মাধ্যমে আমরা যা যা করতে পারি, তা হলো ১. কোনো বিশেষ বিষয়ে গভীর মনঃসংযোগ করা ২. মনের দ্বন্দ্ব নিরসন করা ৩. ভুল পথে পরিচালিত ভাবনাকে সংশোধন করা ৪. অনাকাঙ্ক্ষিত আবেগের অবদমন করা এবং ৫. স্বাভাবিক আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা ও প্রকাশ করা। এর জন্য মস্তিষ্কের একটি নিউরাল সার্কিট কাজ করে, যা প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স ও মিডফ্রন্টাল কর্টেক্সের সঙ্গে মস্তিষ্কের নানা অংশকে যুক্ত করে। মেটাকগনিশনের জন্য সার্কিটটি তিনটি ভাগে কাজ করে—ক. মস্তিষ্কের নির্বাহী নিয়ন্ত্রণ, আমাদের দৈনন্দিন কাজ, চলাফেরা, পর্যবেক্ষণ, প্রণোদনা (দেখা, শোনা, স্পর্শ, অনুভূতি, স্বাদ, ঘ্রাণ) ইত্যাদি খ. ওয়ার্কিং মেমোরি, অনেকটা কম্পিউটারের ডেস্কটপের মতো প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য ও স্মৃতি, যা চটজলদি ব্যবহার করা যায়, যেমন কোনো রাস্তার ঠিকানা, চলার পথ, স্বল্প সময়ের জন্য মনে রাখতে হবে, এমন কোনো তথ্য ইত্যাদি এবং গ. ফ্রন্টাল লোবের কাজ—সমস্যা সমাধানের কৌশল, অনুমানভিত্তিক সিদ্ধান্ত (ডিডাকশন), ছোট ছোট সিদ্ধান্ত গ্রহণ, তাৎক্ষণিকতা, ভাষার উপযুক্ত ব্যবহার, বিচারিক ক্ষমতা, আবেগের নিয়ন্ত্রণ, গাণিতিক সমস্যার সমাধান, সামাজিক আচার–ব্যবহার ইত্যাদি। এই তিনটি বিষয় একসঙ্গে কাজ করে বলেই মেটাকগনিশন তৈরি হয়। যদি উদাহরণ দিই, তবে দেখা যায়, ‘দ্য সাইন অব ফোর’–এর শুরুর দিকে শার্লক হোমস সহজেই বলে দিচ্ছে যে ডা. ওয়াটসন টেলিগ্রাম করার জন্য উইগমোর স্ট্রিটের পোস্ট অফিসে গিয়েছিল। ওয়াটসন অবাক হতেই শার্লক হোমস ব্যাখ্যা দিল যে ওয়াটসনের পায়ের জুতার গায়ে লালচে কাদা (পর্যবেক্ষণ-মস্তিষ্কের নির্বাহী নিয়ন্ত্রণ), এই কাদা যে কেবল ওই পোস্ট অফিসের উল্টো দিকেই রয়েছে, তা শার্লক হোমস জানতেন (ওয়ার্কিং মেমোরি—তিনি এটা সদ্য দেখে এসেছেন আর তা তার মনে আছে)। এতে করে তিনি ওয়াটসন যে কোথা থেকে আসছেন, তা বুঝতে পেরেছিলেন, আর ওয়াটসন যে টেলিগ্রাম করতে সেখানে গিয়েছিলেন, তার ব্যাখ্যা দিলেন যে সারা সকাল তিনি ওয়াটসনকে চিঠি লিখতে দেখেননি, টেবিলে এক শিট স্ট্যাম্প আর পোস্টকার্ড যথাবিহিত মজুত ছিল, একটিও ব্যবহৃত হয়নি, তাই পোস্ট অফিসে যাওয়ার আর একটামাত্র কারণ বাকি থাকে, তা হচ্ছে টেলিগ্রাম করা (ডিডাকশন-প্রিফ্রন্টাল লোবের কাজ)।

মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল অংশ (লাল চিহ্নিত) সক্রিয় হচ্ছে যখন মেটাকগনিশন প্রক্রিয়া চলছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সবাই কেন শালর্ক হোমস হয় না, সবাই কেন ফেলুদার মতো চিন্তা করতে পারে না, সবার কেন এই মেটাকগনিটিভ দক্ষতা থাকে না। এককথায় এর উত্তর দেওয়া কঠিন—সবাই দেখে, কিন্তু পর্যবেক্ষণ করতে পারে না। ওয়াটসনের জুতার পাশে লাল মাটি আরও অনেকে দেখলেও পর্যবেক্ষণ করে সেটির দিকে মনঃসংযোগ করেছিলেন কেবল শার্লক হোমস। আর ওই মাটি যে কেবল পোস্ট অফিসের উল্টো দিকে আছে, তা তিনি তার সঞ্চিত তথ্যের (স্মৃতি) সঙ্গে সমন্বয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অন্য কেউ একজন লালমাটি দেখলেন, কিন্তু সেটার সঙ্গে পূর্বস্মৃতির সমন্বয় ঘটাতে পারলেন না, তাহলে বলা যাবে, ‘অবজেক্ট লেভেলে’ তিনি সক্ষম, কিন্তু ‘মেটা লেভেলে’ তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। আবার অনুমানভিত্তিক সিদ্ধান্ত বা ডিডাকশন করার সক্ষমতা নির্ভর করে পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণী শক্তি আর আবেগবিবর্জিত নৈর্ব্যক্তিক হিসাব–নিকাশের ওপর। যিনি যত বেশি আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, তথ্যকে জ্ঞানে রূপান্তরিত করতে পারবেন, তিনি ডিডাকশন তত ভালোভাবে করতে পারবেন।

গোয়েন্দাদের এই বিশ্লেষণী শক্তি, ডিডাকশন, মেটাকগনিটিভ দক্ষতা—সবই বিজ্ঞান। কোথাও কোনো জাদু নেই। গোয়েন্দা হতে হলে তাই সবার আগে বিজ্ঞানকে বুঝতে হবে—মানুষের চিন্তা করার প্রক্রিয়াকে বুঝতে হবে, মেটাকগনিটিভ দক্ষতা কীভাবে কাজ করে, সেটা বুঝতে হবে।

কীভাবে মেটাকগনিটিভ দক্ষতা বাড়াবে?

নিজের ‘চিন্তা’কে প্রশ্ন করবে: তুমি যা ভাবছ, তা কতটুকু সঠিক, তার ভিত্তি কতটুকু, তা বোঝার চেষ্টা করো। নিজের ভাবনাকে চ্যালেঞ্জ করো।

ঝোঁক বা পক্ষপাত দমন করো: কোনো বিষয়ে আগে থেকেই কোনো পূর্বধারণাপ্রসূত সিদ্ধান্ত না নিয়ে পক্ষপাতহীন হয়ে পর্যবেক্ষণ করতে শেখো, ঝোঁকমুক্ত হয়ে বিশ্লেষণ করো।

অনাবশ্যক বিষয়াবলি বর্জন করো: অনেক সময় অনাবশ্যক বিষয়গুলো আমাদের স্বাভাবিক বিচারপ্রবণতাকে কমিয়ে দেয়।

সার্বিকভাবে পর্যবেক্ষণ করার অভ্যাস করো: ধরো, তুমি একটি চিঠি পড়ছ, কেবল অক্ষরগুলোকে দেখবে—তা হবে না, কাগজটিকে খুঁটিয়ে দেখো, কখন কোথায় হাতের লেখা পরিবর্তন হয়েছে, লক্ষ করো। শার্লক হোমস যেকোনো চিঠি শুঁকে দেখতেন এবং সেখান থেকেও সূত্র পেতেন!

পেছন থেকে চিন্তা করো: একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে সে বিষয়ের ব্যাকগ্রাউন্ড জানতে হবে, পেছন থেকে চিন্তা করার ক্ষমতা রপ্ত করতে হবে।

ডকুমেন্ট সংরক্ষণ করো: যা ভাবছ, তা যেকোনোভাবে লিখে বা রেকর্ড করে সংরক্ষণ করো, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ডায়েরিতে বা অর্গানাইজারে লিখে রাখো। অবসরে সেগুলো বারবার পড়ো, দেখো আর কথা রেকর্ড করা থাকলে বারবার শোনো।

‘মাইন্ডফুলনেস’: কোনো একটি বিষয়ে তীক্ষ্ণ মনোযোগ দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করো—বিষয়টির প্রতি মনঃসংযোগ নিবদ্ধ করতে হবে। অপরাপর বিষয়গুলোকে গৌণ মনে করে বিষয়টিকেই গুরুত্ব দিতে থাকো।

প্রতিটি মুহূর্তই শিখছ: মনে রাখতে হবে, প্রতিটি মুহূর্তেই আমরা কিছু না কিছু শিখছি। তাই শেখার ধারা অব্যাহত রাখো, সবকিছু থেকেই শেখার আছে।

সমন্বয় করো: এক বিষয়ের সঙ্গে আরেক বিষয় সমন্বয় করতে জানতে হবে। সমন্বয়ের দক্ষতা বাড়াতে প্রতিটি বিষয়কে যুক্তি দ্বারা যুক্ত করো, দৈনন্দিন জীবনেও যুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে দাও।

অনুভূতির চর্চা বাড়াও: স্নায়ুসংবেদী অনুভূতিগুলোর চর্চা বাড়াও—দেখো, শোনো, ঘ্রাণ নাও, স্পর্শ করো ইত্যাদি।

‌‘ননভার্বাল কমিউনিকেশন’ বুঝতে শেখো: মানুষের দেহের ভাষা বোঝার চেষ্টা করো। যেটাকে বলা হয় ননভার্বাল কমিউনিকেশন, সেটা কী কী ধরনের হতে পারে, তা বুঝতে শেখো।

পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে শেখো: তাতে করে তুমি সহজেই স্ট্রেস থেকে মুক্ত থাকবে, পরিষ্কার চিন্তা করতে পারবে।

নিজের শরীরের ও মনের শক্তিকে অযথা ক্ষয় করবে না: শরীর ও মনে শক্তি সঞ্চিত রাখো। অযথা শক্তিক্ষয় করবে না। পর্যাপ্ত ঘুম আর সুষম খাদ্য তোমাকে শক্তি জোগাবে।

বিনোদন ও অবসর: শার্লক হোমস বেহালা বাজাতেন, যা আসলে তার একধরনের ‘মাইন্ডফুলনেস’। অতএব, বিনোদনকে পরিহার করবে না। মেটাকগনিশন বাড়াতে অবসর কাটাও, ঘুরতে বের হও, গান শোনো, বই পড়ো আর নির্মল বিনোদনে অংশ নাও।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, চাইল্ড অ্যাডলোসেন্ট ও ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা