শার্লক হোমসের মুখোমুখি

Never trust to general impressions, my boy, but concentrate yourself upon details.

পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত ঠিকানাটা খুঁজে পেতে আমার খুব একটা সমস্যা হয়নি। তবে শেষ মুহূর্তে একজনকে জিজ্ঞাসা করামাত্র হাত তুলে দেখাল—আমি যেখানে দাঁড়িয়ে, তার উল্টো দিকের বাসাটাই ২২১ বি বেকার স্ট্রিট। ইংরেজরা ব্যাপক ভদ্রলোক। কীভাবে নক করব, সেটাও বলে দিল।

ঠিক ৯টা ৩১ মিনিটে আমি ছোট দরজাটাতে কড়া নাড়লাম। বিলেতে এসে এখানকার বাড়িগুলো সম্পর্কে ধারণা হয়েছে। ডেকরে রোডের যে বাড়িটাতে আমরা উঠেছি, সেটার দরজা বরাবর সিঁড়ি।

দরজায় কোনো কলবেল নেই। দেখলাম, কড়ার ওপরে লেখা আছে কড়া বাজানোর জন্য। কড়া বাজাতেই ওপর থেকে কে যেন বললেন, ‘ইয়েস, মি. মুনির। দরজা খোলা আছে। ওপরে চলে আসুন।’

অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে এসেছি। কাজেই ওপর থেকে আমার নাম শুনে অবাক হলাম না। যেমনটা ভেবেছি, দরজা খুলতেই একচিলতে করিডর, ফুট দুয়েক হবে। তারপরই সিঁড়ি। ধাপ গুনে গুনে ওপরে পৌঁছালাম। দুটি দরজা। হাতের বাঁয়েরটা বন্ধ। কিন্তু নাক বরাবরটা খোলা। সেটা দিয়ে কাঙ্ক্ষিত ঘরে ঢুকলাম।

শার্লক হোমস মিউজিয়ামের এই সদর দরজা স্বাগত জানায় ভক্তদের

ছোট্ট একটি কক্ষ। ঢুকতেই বাঁ পাশে একটা পড়ার ডেস্ক। ডেস্কের সামনে একটু চেয়ার ঘুরিয়ে বসে থাকা লোকটাই যে আমাকে নাম ধরে ডেকেছেন, বুঝতে পেরেছি। লোকটার সামনের ডেস্কে মেডিকেলের বই দেখে নিশ্চিত হলাম তাঁর পরিচয়। তাঁর হাতে একটা পত্রিকা। তাঁর বাঁ দিকে ঘরের অন্য কোনায় একজন মনোযোগ দিয়ে মাইক্রোস্কোপে চোখ লাগিয়ে কী যেন দেখছেন। ডা. ওয়াটসনের দেখিয়ে দেওয়া চেয়ারে বসার সময় ওই ভদ্রলোকের কণ্ঠ শুনতে পেলাম, ‘পায়ের ফোসকাটা নিশ্চয়ই তেমন সিরিয়াস নয়। তারপর কেমন দেখলেন কেমব্রিজ আর ওয়েস্টমিনিস্টার, লন্ডন আই।’

বলতে বলতে আমার দিকে ঘুরে তাকালেন। কী আশ্চর্য, আমার পায়ে যে ফোসকা পড়েছে আর গত দুই দিন আমি কোথায় গেছি, তা কেমন করে জানলেন? আমার মতো ডা. ওয়াটসন বরাবরের মতো বিস্মিত হয়ে তাঁর দিকে তাকালেন। তাঁর দিকে ফিরে শার্লক হোমস বললেন, ‘এলিমেন্টারি, মাই ডিয়ার ওয়াটসন!’

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় আপনার পায়ের শব্দ শুনে বুঝেছি আপনি জুতা পরে আসেননি। দুই পায়ের শব্দের তারতম্য দেখে বোঝা যায়, আপনার ডান পায়ের সমস্যাটা অনেক জটিল নয়। কাল আর পরশু আপনি দুটি শহরে অনেক হাঁটাহাঁটি করেছেন এই গরমের মধ্যে। এ থেকে বুঝলাম পায়ে ফোসকা পড়েছে।’

আমার হতভম্ব অবস্থাটা উনি উপভোগ করছেন। বললেন, ‘কেমব্রিজ আর এখানকার গরমে জুতা পরে হাঁটাহাঁটি করলে এটা হতেই পারে। গত পরশু কেমব্রিজে তো ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বেশি গরম ছিল। কাল এখানেও গরম কম ছিল না।’

তারপর ডা. ওয়াটসনের দিকে ঘুরে হোমস জানালেন, ‘বুঝলে ওয়াটসন। বাংলাদেশ থেকে এখানে এসে কেউ কি এমনি এমনি জুতা না পরে আমার কাছে আসবেন? সমস্যা যে এখানে এসে হয়েছে, সেটি তাঁর পায়ের নতুন স্যান্ডেলের দিকে তাকিয়েই তুমি টের পেতে।’

মরিয়া হয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিন্তু আমি যে কেমব্রিজে আর লন্ডন আইয়ে গিয়েছি, সেটা আপনি জানলেন কীভাবে?’

‘লন্ডনে এলে সবাই ওখানে একবার যায়। এটা আন্দাজ করেছি।’

‘আর কেমব্রিজ?’ আমার খটকা যায় না।

‘ফেসবুক, মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড, ফেসবুক। কালকে আপনার সঙ্গে কথা হওয়ার পরপরই ফেসবুকে আপনাকে খুঁজে নিয়েছি।’

বলতে বলতে আমার সামনে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিলেন। ‘পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।’

প্রথম পরিচয়ের ঘোর কাটিয়ে আমি কিছুই বলতে পারলাম না। আমার হাত ধরে ওয়াটসনের দিকে তাকিয়ে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা, আমার ছোটবেলার নায়ক একটু মাথা ঝুঁকে বললেন, ‘তুমি কি মুনিরকে বাড়িটা একটু ঘুরিয়ে দেখাবে, প্লিজ!’

‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলম্যান। ওয়েলকাম টু দ্য শার্লক হোমস মিউজিয়াম। আই অ্যাম হিয়ার টু হেল্প ইউ ইন দ্য জার্নি অব দ্য মোস্ট এক্সাইটিং অ্যান্ড দ্য মোস্ট ফেমাস হাউস অব দ্য ওয়ার্ল্ড!’

একটি ভরাট কণ্ঠস্বরে আমার তন্দ্রাটা কেটে গেল। খেয়াল করলাম, আমার আশপাশে আরও কয়েকজন। বুঝতে পারলাম, আমি দাঁড়িয়ে আছি ২২১ বি বেকার স্ট্রিটের দোতলায়, শার্লক হোমসের স্টাডিতে। আজ এখানে আসার জন্য আমি কত রকম পরিকল্পনা করেছি!

গতকাল রাতেই লোকজনের কাছ থেকে শুনে নিয়েছি। ভেবেছিলাম সকাল সাতটায় রওনা দেব। দিইনি, ভালো হয়েছে। কারণ, মিউজিয়ামটা খোলেই সাড়ে নয়টায়।

এপটন টাউন রেলস্টেশনের সাহায্যকারী লোকটাকে জিজ্ঞেস করে সাড়ে ৯ টাকা দিয়ে একটা আপ-ডাউন টিকেট কাটলাম টিউবের। আমি আগেই জানতাম, হ্যামারস্মিথে, মানে পিংক লাইনে আমাকে উঠতে হবে। স্টেশনের সাহায্যকারী আমাকে বলে দিলেন, ১৬ স্টেশন পরেই বেকার স্ট্রিট।

এ কদিনে আমার টিউবের অভিজ্ঞতা ভালোই হয়েছে। এর আগে প্যারিসে, মাদ্রিদে টিউবে চলাফেরা করেছি। তবে লন্ডনের পাতালরেল এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা। ১৫০ বছর আগে যে লোকেরা চিন্তা করেছে তাদেরকে মাটির নিচে চলাফেরা করতে হবে, তাদের সঙ্গে বিদ্যাবুদ্ধিতে আমাদের পেরে উঠতে ঢের সময় লাগবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। ওই ঘটনার ১৫০ বছর পরে মাটির ওপরে দৃশ্যমান মেট্রোরেল বানাতে গিয়ে আমাদের কতই–না গর্ব!

আমি পুরোনো দিনের লোক বলে আমার পকেটে একটা টিউবের ম্যাপ। তবে এ বছর খেয়াল করলাম, আইএমওতে আমাদের কোনো ম্যাপ দেওয়া হয়নি। কারণ, গুগল ম্যাপ! যেকোনো ঠিকানা দিলেই সেটি কোথায় জানা হয়ে যাচ্ছে।

আমি মহানন্দে এপটন টাউন থেকে উঠে পড়লাম আমার গন্তব্যে। দুই স্টেশন পরেই বসার জায়গা পেয়ে গেলাম। যাক, আজকে কেউ অবশ্য আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ায়নি। কাল টিউবে একটি চ্যাংড়ামতো ছেলে দাঁড়িয়ে আমাকে বসতে বলেছিল। তার মনে হয়েছে আমি ‘সিনিয়র’ সিটিজেন!

যাকগে। ১৬ স্টেশন পরে, গুগলে দেখানো সময়মতো আমি বেকার স্ট্রিট স্টেশনে পৌঁছালাম। নেমেই দ্রুত উঠে এলাম রাস্তায়, মাটির ওপরে। রাস্তায় বের হয়ে প্রথমেই অবাক হয়ে গেলাম। কারণ, আমার হাতের ডানেই মাদাম তুসোর মিউজিয়াম। গুগলের শরণাপন্ন হলাম। দেখলাম, আমাকে যেতে হবে উল্টো দিকে, অর্থাৎ বাঁয়ে। ম্যাপ খুলে রেখে রাস্তা পার হয়ে এসে পড়লাম কাঙ্ক্ষিত রাস্তায়।

আমি যেদিকে, সেদিকের বাড়িগুলো দেখলাম জোড়া নম্বরের। বুঝলাম কোথাও গিয়ে আমাকে রাস্তা পার হতে হবে। ম্যাপে চোখ রেখে হাঁটতে থাকলাম। দোকানপাট তখনো খোলেনি। একজনকে দেখলাম শাটার খুলছে মাত্র। আর একজন ভেতরের জিনিসপত্র বের করে রাস্তার ধারে সাজাচ্ছে। কয়েক মিনিট হাঁটার পর গুগল দেখাল আমি আমার গন্তব্যের ঠিক উল্টো পাশে আছি। দোকানগুলোর নম্বর দেখলাম ২৩৬, ২৩৮ ও ২৪০!

হায় হায়। ভুল জায়গায় এসেছি তো! আমি তো বিলেতের রোডের দুই পাশের বাড়ির নম্বর ধরে ফেলেছি। এর একদিকে থাকে জোড়া নম্বর, অন্যদিকে বেজোড় নম্বর। তবে জেড সিকুয়েন্স মেইনটেইন করে। সেই হিসাবে ৩৬, ৩৮, ৪০–এর উল্টো দিকে ৩৫, ৩৭, ৩৯ বা ৪১ হওয়ার কথা। ২১ তো হওয়ার কথা নয়!

গুগল কি তাহলে ভুল বলে? মন খারাপ করে যে ব্যাটা তার দোকানের জিনিসপত্র বাইরে সাজাচ্ছিল, তার কাছে জানতে চাইলাম, ‘ভাই, শার্লক হোমসের বাড়িটা কোনটা!’

ব্যাটা ইংরেজ আমার দিকে তাকাল। তারপর আঙুল তুলে সামনের বাড়িটা দেখিয়ে দিল—ওই যে।

আর আমিও গাধা, দেখলাম ওই বাড়িতে বড় করে লেখা আছে ‘দ্য শার্লক হোমস মিউজিয়াম’।

কিন্তু ওইটা তো ২৩৮ আর ২৪০ নম্বর বাড়ির উল্টো দিকে। কী আর করা। বড় করে সাইনবোর্ড তো রয়েছে। কাজেই হেঁটে ট্রাফিক লাইটের সামনে এলাম। বিলেতে আমাদের মতো যেকোনো জায়গায় রাস্তা পার হওয়া যায় না। আমাদের দেশের মতো দৌড়ও দেওয়া যায় না। নির্ধারিত জায়গায় গিয়ে জেব্রাক্রসিং দিয়েই কেবল রাস্তা পার হতে হয়। তো সেভাবে আমি এসে পৌঁছালাম ছোটবেলার কাঙ্ক্ষিত বাড়ির সামনে। সকাল সোয়া নয়টা বাজে। আমার মতো আরও একটা বিদেশি পরিবার ওখানে দাঁড়ানো। ছবি তুলছে। আমিও তুললাম। দেখলাম দোতলার জানালার নিচে আলাদা একটা নম্বর প্লেটও আছে, যেখানে পরিষ্কার করে লেখা 221 B । আমার অবশ্য খটকাটা গেল না। সামনে–পেছনে হেঁটে দুইটা বাড়ি দেখলাম। যা ভেবেছি তা–ই। একটা ২৩৭ আর একটা ২৪১। তার মানে, এটা ২৩৯! তাহলে তো এটা ২২১ বি নয়!

তখনো প্রায় ১৫ মিনিট বাকি মিউজিয়াম খোলার। লাইনে দাঁড়ালাম। একটু পরই একজন লোক এসে আমার পেছনে দাঁড়াল এবং জানতে চাইল মিউজিয়াম কখন খুলবে? সময়টা জানিয়ে ভাবলাম গল্প করা যাক। তার কাছে জানতে চাইলাম, এটা তো ২৩৯ মনে হচ্ছে আমার কাছে। ২২১ বি কেমন করে হলো? ব্যাটা ব্রিটিশ বেশি কথা বলে না। বলল, সে এক বিরাট ইতিহাস! তারপর আমার স্মার্টফোনে বের করে দিল এ বাড়ির ইতিহাস।

আর্থার কোনান ডয়েলের হিসাবে ১৮৮১ থেকে ১৯০৪ সাল পর্যন্ত ওয়াটসন আর হোমস ২২১ বি–তে থাকতেন। সে সময় এমন কোনো ঠিকানা সেখানে ছিল না। কারণ, হিসাবমতো যেখানে ২২১ থাকার কথা, সেটি একটা বড় ব্লকমতো ছিল। ফলে আলাদা করে ২২১ নম্বর ছিল না। কেউ ভাবতও না। ঝামেলা শুরু হলো পরে। ১৯৩০ সালে সেখানে অ্যাবে ন্যাশনাল বিল্ডিং সোসাইটির অফিস শুরু হয়। অফিস চালুর পরদিন থেকে তারা চিঠি পেতে শুরু করে ২২১ বি বেকার স্ট্রিটের ঠিকানায়, শার্লক হোমসকে লেখা। অনেক চিঠি আসতে শুরু করল। বাধ্য হয়ে তারা একজন ফুলটাইম সেক্রেটারি নিয়োগ দিল চিঠির জবাব দেওয়ার জন্য। বেশির ভাগ চিঠির জবাবে সেক্রেটারি লিখতেন, ‘দুঃখিত। হোমসের পক্ষে আপনার কেসটি নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তিনি এখন অবসর জীবন যাপন করছেন সাসেক্সে। সেখানে তিনি মৌমাছি নিয়ে ব্যস্ত।’

শার্লক হোমস মিউজিয়ামের প্রতিটি কক্ষ এমন সাজানো গোছানো

এভাবে প্রায় ৬০ বছর কেটে যায়। এর মধ্যে অনেকেই ওই এলাকার বাড়িঘরের খোঁজ নিয়ে বের করার চেষ্টা করে, আসলে কোনান ডয়েল কোন বাড়িটির কথা বলেছেন। তবে, তারা একমত হতে পারেনি। ১৯৯০ সালে এই মিউজিয়াম চালু করে শার্লক হোমস ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ২৩৯ নম্বর বাড়িতে (এটুকু জেনে আমি খুব স্বস্তিবোধ করলাম)। তারপর তারা ন্যাশনাল অ্যাবের সঙ্গে ঝগড়া শুরু করল। তাদের বক্তব্য হলো, হোমসের কাছে আসা চিঠির মালিক তারাই। ওদেরকেই চিঠি দেওয়া হোক। কিন্তু অ্যাবে ন্যাশনাল সেটা অস্বীকার করে। শেষ পর্যন্ত ২০০২ সালে অ্যাবে ন্যাশনাল যখন ওই বিল্ডিং ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়, তখন থেকে ব্রিটিশ রাজকীয় ডাকবিভাগ ২৩৯ নম্বরে হোমসের চিঠি এই মিউজিয়ামে ডেলিভারি করতে শুরু করে। এর মধ্যে সিটি অব ওয়েস্টমিনিস্টার শেষ পর্যন্ত বিশেষ ক্ষমতাবলে ২৩৯ বেকার স্ট্রিটকে ২২১ বি বেকার স্ট্রিট হিসেবে ঘোষণা করে। আর এভাবে একটি কাল্পনিক ঠিকানা বাস্তব ঠিকানায় পরিণত হয়।

এসব জানতে জানতে দেখলাম, নিচতলার দোকানের দরজা খুলে দেওয়া হলো এবং আমি ভেতরে ঢুকে টিকেট কিনে আনলাম। শপ থেকে বের হয়ে পাশের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকেছি। ওই বর্ণনা আগে দিয়েছি। তবে আরও একটি কাজ করেছি। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় ধাপগুলো গুনেছি এবং ডা. ওয়াটসনের মতো আমিও ১৭ ধাপ পেরিয়ে দোতলার স্টাডিতে পৌঁছেছি! (হয়তো ২৩৯–কে বেছে নেওয়ার এটাই কারণ!)

স্টাডি রুম দিয়ে শুরু করা যাক। ঢুকেই বাঁ দিকে ওয়াটসনের ডেস্ক। ডেস্কটাতে মেডিকেলের কয়েকটি বই আছে। তবে এটার ওপরে একটা দৈনিক পত্রিকা আছে ১৮৮১ সালের। ১৮৮১ সালের কেন? কারণ, ১৮৮১ সালেই ডা. ওয়াটসনের সঙ্গে হোমসের এই বাড়িতে প্রথম দেখা হয়।

গাইডের কথার সঙ্গে মিল রেখে আমি হিসাব করে দেখলাম, রুমটা অনেক বড় নয়। ছোটখাটো। ১০ বাই ৮ হতে পারে সর্বোচ্চ বা আরেকটু বেশি। দুটো দরজা। আমাদের অবশ্য বেশি ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হলো না। একটা অংশ দড়ি দিয়ে আটকে রেখেছে। তার মধ্যেই ওয়াটসনের টেবিল, হোমসের আরামকেদারা আর হোমসের কোনার টেবিলটা।

আমার হাত ধরে ওয়াটসনের দিকে তাকিয়ে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা, আমার ছোটবেলার নায়ক একটু মাথা ঝুঁকে বললেন, ‘তুমি কি মুনিরকে বাড়িটা একটু ঘুরিয়ে দেখাবে, প্লিজ!’

এগুলো সব বাঁ দিকে। যেখানটায় আমাদের আটকে দেওয়া হয়েছে, সেখানে একটা ছোট টি-টেবিলও আছে। তার ওপর কিছু ব্যবহৃত জিনিসপত্র। কোনার দিকের ছোট টেবিলটা, যেটাতে মাইক্রোস্কোপটা, ওটার পাশেই আতশ কাচটাও আছে। ঠিক পাশেই হোমসের বিখ্যাত পাইপ। মনে হবে, এইমাত্র উনি গেলেন! স্তূপ করে রাখা পুরোনো পত্রিকা, বই এবং কিছু টেস্ট টিউবও দেখলাম রাখা আছে।

এই রুমের দ্বিতীয় দরজাটা দিয়ে হোমসের বেডরুমে যাওয়া যায়। আবার বাইরে থেকে যাওয়া যায় সিঁড়ি দিয়ে উঠে। হোমসের বেডরুমের দেয়ালজুড়ে একগাদা লোকের ছবি। গাইড জানাল, এগুলো সব সিরিয়াল কিলার বা বি(কু)খ্যাত সব অপরাধীর। হোমসের বেডরুমের দেয়ালে এর চেয়ে ভালো আর কী শোভা পেতে পারে! বিছানার ওপর একটা বাক্স। বাক্সটা খোলা। বাক্সের ডানার ওপরে একটা হ্যাট। হোমসের টুপি! রুমজুড়ে আরও কিছু আছে।

ভালো কথা, হোমসের এসব জিনিস কোথা থেকে এল!

আমার প্রশ্নবোধক চাহনি দেখে গাইড হেসে দিল। বলল, হোমসকে নিয়ে যেসব সিনেমা, নাটক হয়েছে, সেগুলোর অভিনেতারা যেসব প্রপস ব্যবহার করেছেন, সেখান থেকে এগুলো যাচাই–বাছাই করে এনে রাখা হয়েছে। খেয়াল করা হয়েছে, যাতে কোনোভাবে দর্শকেরা অন্য রকম না ভাবেন। বেশির ভাগ সিডনি পেইজের করা চরিত্র থেকে নেওয়া হয়েছে।

একটু ধাতস্থ হয়ে হোমসের বেডরুম থেকে বের হলাম। গাইড জানাল, আরও দুই ফ্লোর আছে। তার মানে মোট চারতলা। গাইড না বললেও আমি যেতাম। যদিও আমার হাতে সময় খুবই কম।

প্রতিটি রুম সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। বেশির ভাগ রুমই ভিক্টোরিয়া আমলের ফার্নিচার। আর বিভিন্ন প্রপস! তিনতলার দুটো রুম চিনে নিতে তেমন কষ্ট হয় না। মিসেস হাডসনের রুমটাতে রাখা হয়েছে ভিক্টোরিয়া যুগের মেয়েদের ব্যবহৃত পোশাক। আর বাকি রুমটা আমাদের ডাক্তারের। ডা. ওয়াটসনের। ওখানেও বইয়ের আধিক্য দেখলাম। দেয়ালে ছবি, যথারীতি।

এর ওপরের তলাটা চমকে দেওয়ার মতো। আরেকটা রুম, যেখানে কিছু মোমের তৈরি ম্যানিকুইন রাখা হয়েছে। এ ঘরে আমার দেখা হয়ে গেল প্রফেসর মারিয়ার্টির সঙ্গে। সামনে যেতেই হাত নাড়াল। বললাম, ‘আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। আমাদের দেশেও অনেক লোক তোমার নাম জানে।’

বলল, ‘বাংলাদেশ, মানে কবীর চৌধুরীর দেশ থেকে? ওর সঙ্গে তোমার পরিচয় আছে? অনেক গুণী লোক।’

বললাম, ‘না, কবীর চৌধুরীর সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়নি।’

শুনে প্রফেসর হাসলেন। বললেন, ‘হোমস কিন্তু আমার সঙ্গে কখনো পারত না। এখন এরা দেখো আমার পা ফ্লোরের সঙ্গে আটকে দিয়েছে। সে জন্য এখান থেকে বের হতে পারি না। আর মানুষ হোমসকে কেন ভালোবাসে, আমি জানি না। তুমিই বলো, প্রফেসর মারিয়ার্টি না থাকলে হোমসের কী দাম!’

আমি ভাবলাম, তা–ই তো। মনে পড়ল লেবাননের কবি কাহলিল জিব্রানের কথা। তাড়াতাড়ি প্রফেসরের সামনে থেকে সরে গেলাম। এখানে আরও অনেক ম্যানিকুইন সাজানো।

বাড়ি এখানে শেষ। এখানেও হোসমনের একটা ম্যানিকুইন রাখা আছে।

আরও একটা সিঁড়ি দেখলাম, যা দিয়ে সুন্দর সাজানো টয়লেটে যাওয়া যায়।

একপাশে একটা স্টোররুম! কিছু লাগেজ ফেলে দেওয়া আছে।

আর ১০টা জাদুঘরের মতো নয় এই জাদুঘর। খুব কমসংখ্যক নিদর্শনের সামনে কোনো ব্যাখ্যা রাখা আছে। গাইডও আর ওপরে ওঠেনি। দুই–তিন মিনিটের ছোট্ট ইন্ট্রো ছাড়া আর কিছুই বলেনি। নিচতলার শপটিতে অনেক স্যুভেনির বিক্রি করে তারা।

তারা জানে দর্শকদের কল্পনাকে আটকানোর কোনো মানে হয় না। বিশেষত যখন এখানে ঢুকতে মাত্র ১৫ পাউন্ড দিতে হয়!