শায়েস্তা খাঁর এক টাকা

ছোটবেলা থেকে পড়ে আসছি, শায়েস্তা খাঁর আমলে এক টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। এখন তো পরিস্থিতি উল্টো। আট মণ চাল দিলেও বাজারে এক টাকার নোট আর পাওয়া যাবে না। এই যুগে এক টাকার নোট পুরোটাই অচল। এক টাকায় এখন কিছুই পাওয়া যায় না, তাই কেউ আর পকেটে রাখেন না এক টাকার নোট।

অনেকেরই হয়তো মনে আছে, কিছুদিন আগে আমাদের অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, এক ও দুই টাকার নোট আর রাখবেন না। ধাতব মুদ্রার সর্বনিম্ন মান পাঁচ টাকার ঘোষণাও দিয়েছিলেন তিনি। চিন্তার কিছু নেই, অর্থমন্ত্রী হয়তো সবাইকে একটু ভয় দেখাতে চেয়েছিলেন।

আসল কথাটি বলি। শায়েস্তা খাঁ ছিলেন মোগল বাংলার সুবেদার। তাঁর শাসনকালটি ছিল ১৬৬৪ থেকে ১৬৮৮ সাল পর্যন্ত। ঐতিহাসিকেরা অবশ্য বলছেন, আরেক নবাব সুজাউদ্দীন খানের (১৭২৭-১৭৩৯) আমলেও টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। তবে তাঁর কথা কেবল ঐতিহাসিকেরা মনে রেখেছেন, বইপত্রে খুব একটা পাওয়া যায় না। আর আমরা এখন যারা নিয়মিত বাজারে যাই, টাকায় আট মণ চালের কথা শুনে হয়তো লম্বা দীর্ঘশ্বাসও ছাড়ি।

এবার সত্যের আড়ালের আসল সত্যটা বলি। ঐতিহাসিকরা দেখিয়েছেন, শায়েস্তা খাঁর সময়ে এক টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত ঠিকই, কিন্তু ওই এক টাকা আয় করাই ছিল অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। খুব কম মানুষই ছিল, যাদের পকেটে এক টাকা থাকত। তখন বাংলার মানুষ ছিল অত্যন্ত গরিব। সে সময়ের অর্থনীতিকে বলা হতো খোরাকি অর্থনীতি। অর্থাৎ ফসল ভালো হলেও সবাই দুই বেলা খেতে পারত না, কোনো কারণে ফসল ভালো না হলে পরবর্তী ফসল না হওয়া পর্যন্ত প্রায় উপোস করেই থাকতে হতো। বলা হয়, সে সময়ে অনাহারে, দুর্ভিক্ষে, রোগে এত বেশি মানুষ মারা যেত যে, অতীত বাংলায় জনসংখ্যা খুব বেশি বাড়ত না।

এ থেকে অর্থনীতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা আমরা শিখতে পারি। আর তা হলো সত্ত্বাধিকার। অর্থাৎ বাজারে বস্তা ভরা চাল মানে এই নয় যে দেশের সব মানুষ খুব ভালো আছে। বাম্পার ফলন মানে এই নয় যে দেশে কোনো খাদ্যাভাব নেই। আমরা অনেকেই অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী প্রথম এবং একমাত্র বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের কথা জানি। সত্ত্বাধিকারের কথা তিনিই দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন। অর্থাৎ বাজারে চাল থাকলেই হবে না, সেটি কেনার সামর্থ্য থাকতে হবে, অধিকার থাকতে হবে। অমর্ত্য সেনের ভাষায় বলি, ‘পণ্যসমষ্টির ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করে আমরা খাই-পরি। যেসব অধিকার আইনগতভাবে পাকা অধিকার বলে স্বীকৃত হয়, সে অধিকারগুলোকেই সত্ত্বাধিকার বলে।’ আমাদের সংবিধানেই আছে, অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বাসস্থান আমাদের চারটি মৌলিক অধিকার।

শায়েস্তা খাঁর আমলে টাকায় আট মণ চাল পাওয়া গেলেও তা কিন্তু বাংলার অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিচয় ছিল না। দেখা গেছে, যদি আবহাওয়া ভালো থাকত, তাহলে সারা দেশেই অনেক বেশি ফলন হতো। এতে কৃষকের কোনো লাভ হতো না। তখন টাকায় আট, এমনকি নয় মণ চালও পাওয়া যেত। আবার এমনও হয়েছে দাম এতটাই কমে যেত যে কৃষকেরা মাঠ থেকে ফসল তুলতই না। ধান মাঠেই পচে যেত। সেই পচা ধান জমিতে সারের কাজ করলেও চাষির জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ত। কৃষকের হাতে কোনো টাকা থাকত না। সুতরাং শায়েস্তা খাঁর আমলে টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত, তবে তা মোটেই প্রাচুর্যের লক্ষণ ছিল না। খুব কম মানুষেরই সে সময়ে এক টাকা থাকত। এক টাকা থাকা মানেই তিনি ধনী হিসেবে সমাজে পরিচিত ছিলেন।

সে সময়ে কিন্তু বিনিময়ের জন্য অনেক ধরনের মুদ্রা ছিল। আর গ্রামাঞ্চলে কড়িই ছিল কেনাবেচার মাধ্যম। কড়ির হিসাবটা এ রকম—৪ কড়িতে এক গন্ডা, ২০ গন্ডায় ১ পণ, ৪ পণে এক আনা, ৪ আনায় ১ কাহন, ৪ কাহনে ১ টাকা। সুতরাং বুঝতেই পারছ, শায়েস্তা খাঁর আমলে ওই টাকাওয়ালাদের দেখা পাওয়াটাই ছিল বিরল।

তোমাদের জানার জন্য বলি, স্বাধীনতার পরপর এই বাংলাদেশেই মাত্র ৪০ টাকায় পাওয়া যেত এক মণ চাল। আর এখন? এখন একটু ভালো মানের মোটা চালের কেজিই ৪০ টাকা। ইতিহাস বইয়ে উল্লেখ আছে, ইস্ট ইন্ডিয়া নামের যে কোম্পানি বাংলা শাসন করেছিল, সে আমলেও টাকায় তিন মণ চাল পাওয়া যেত।

তবে এ কথা ঠিক, শায়েস্তা খাঁর আমলে ঢাকার প্রভূত উন্নতি হয়েছিল। তবে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যাই থাকুক, টাকায় আট মণ চালের জন্যই সবাই তাঁকে মনে রাখবে, বারবার বইয়ে পড়বে। শায়েস্তা খাঁও হয়তো তা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তো ঢাকা থেকে বের হওয়ার একটি তোরণে তিনি লিখে রেখেছিলেন, ‘শস্যের এ ধরনের সস্তা বিক্রয়মূল্য প্রদর্শনকারীরাই একমাত্র এ তোরণ উন্মুক্ত করবে।’

ইতিহাসের কথাই যখন উঠল, আরেকটা মজার তথ্য দিই। সময়টা উনিশ শতক। উন্নত বিশ্বে শিল্পবিপ্লব ঘটেছে। কিন্তু সেখানে শ্রমিক নেই। শ্রমিক আছে এখানে—ভারতবর্ষে, বাংলায়। শিল্প ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের আবাদের কাজ করার জন্যও শ্রমিকের ব্যাপক চাহিদা ছিল। এশিয়া ও আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপন করে সেসব দেশে চা, রাবার, তামাক, আখ, তুলা চাষ, ইত্যাদি করা হতো। এ জন্য প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন হতো।

শ্রমিক পেতে বিলেতের কোম্পানিগুলো এখানে নিয়োগ বা রিক্রুটিং কেন্দ্র খোলা শুরু করেছিল। তখন তো আর পত্রিকা বা টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দেওয়ার চল ছিল না। সে সময়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো অভিনব কায়দায়। একদল ঢোলক নিয়োগ দেওয়া হতো। তারা জায়গায় জায়গায় ঢোল পিটিয়ে মুখে মুখে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রচার করত। এখন যেমন এটা নিলে ওটা ফ্রি পাওয়া যায়, শ্রমিক নিয়োগ পেতেও সে ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বাড়তি সুবিধার কথাও ঢোল বাজিয়ে প্রচার করা হতো। যেমন, বাড়ি থেকে বিদেশে কর্মস্থল পর্যন্ত আসা-যাওয়ার খরচ, পরিবারের আসা-যাওয়ার খরচ, আকর্ষণীয় বেতন, বিনা খরচে থাকার ব্যবস্থা, চিকিৎসা, বিমা সুবিধা এবং একটানা কাজ করলে বাড়তি বোনাস, ইত্যাদি। মজার ব্যাপার হলো এই বিজ্ঞাপনে সাড়া দিয়ে সবচেয়ে বেশি গেল বিহারি, উড়িষ্যা, তামিল ও তেলেগুরা। গেল না কেবল বাঙালিরা। লাখো লাখো তামিল-তেলেগু গেল মালয়েশিয়া, মরিশাস, ফিজি, দক্ষিণ আফ্রিকা, কেনিয়া ও পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে। সেই ভারতীয় শ্রমিকদের বংশধরেরাই কিন্তু এখন নিয়ন্ত্রণ করছে ওই সব দেশের অর্থনীতি, এমনকি রাজনীতিকেও।

বাঙালিরা কেন গেল না? আগেই বলেছি সাধারণ মানুষের মধ্যে ধনী মানুষ ছিল খুবই কম। অধিকাংশ সাধারণ মানুষই ছিল অত্যন্ত গরিব। প্রায়ই দেখা দিত দুর্ভিক্ষ। আর তাতে মারা যেত হাজার হাজার মানুষ। তারপরেও বাঙালিরা গেল না বিদেশে চাকরি করতে। কারণ দুটি। একটি কারণ হচ্ছে সমুদ্র বা কালাপানি পাড়ি দেওয়াকে চরম ধর্মবিরুদ্ধ কাজ বলে মনে করা হতো। আরেকটি কারণ, অলসতা। না খেয়ে থাকবে, তবু অন্য দেশে যাবে না।

আর এখন সেই বাঙালি একটু কাজের আশায়, আরেকটু ভালো থাকার আকাঙ্ক্ষায় অবৈধভাবে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে গণকবরে ঠাঁই করে নিচ্ছে।

তথ্য সূত্র: ঐতিহাসিকের নোটবুক, সিরাজুল ইসলাম।