শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন
প্রতিকৃতি: কাইয়ুম চৌধুরী

ছোট্ট এক ছেলে। ফুল, পাখি, প্রকৃতি, নদীর প্রতি অসীম মমতা তার। ছেলেটা ছবি আঁকে। পাখি, পাখির ডিম, পাখির বাসা, ফুল, নদী। ছবি আঁকার পর মাকে দেখায়। মা ছেলের ছবির প্রশংসা করেন। ছেলে খুশি হয়, একদিন মস্ত বড় শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখে। সেই ছেলেটিই ১৬ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালায়। চলে যায় কলকাতায়। সেখানকার সরকারি আর্ট স্কুলটা ঘুরে দেখার বড্ড শখ তার। সেই সাধ পূরণ হয়। কিন্তু ততক্ষণে নেশা লেগে গেছে তার। সে বছর ছেলেটা দশম শ্রেণিতে পড়ে। কিছুদিন পরেই ম্যাট্রিক পরীক্ষা। কিন্তু পরীক্ষার আগে বেঁকে বসে। সাধারণ স্কুলে আর পড়বে না। পড়বে কলকাতার ওই আর্ট স্কুলে। মায়ের কাছে বায়না ধরে। কিন্তু এ বায়না পূরণ করা মায়ের জন্য অতটা সহজ ছিল না। বাবা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর। অত টাকাকড়ির জোগান তাঁদের নেই। কিন্তু ছেলের স্বপ্নকে গুঁড়িয়ে দিতে চাননি মা। নিজের গলার হার বিক্রি করে, সেই টাকায় ছেলেকে ভর্তি করান কলকাতার ওই আর্ট স্কুলে। তার পরের কাহিনি ইতিহাস।

সেই ছেলেটার নাম জয়নুল আবেদিন। আমাদের শিল্পাচার্য। তাঁর জন্ম ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর। বর্তমান কিশোরগঞ্জের কেন্দুয়া গ্রামে, ব্রহ্মপুত্র নদের তীর ঘেঁষে। সাধারণত নদী আর প্রকৃতি ব্যক্তির মধ্যে শিল্পসত্তার জন্ম দেয়। ব্রহ্মপুত্র নদও জয়নুল আবেদিনের শিল্পসত্তাকে জাগিয়ে তুলতে বড় ভূমিকা পালন করেছে।

১৯৩৩ সালে জয়নুল ভর্তি হন কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলে। ১৯৩৮ সালে ড্রয়িং অ্যান্ড আর্টস বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। সে বছরই সর্বভারতীয় চিত্রকলা প্রদর্শনীতে অংশ নেন জয়নুল আবেদিন। জলরঙের ছবির জন্য জয়নুল স্বর্ণপদক লাভ করেন। একই বছর জয়নুল তাঁর নিজের স্কুলেই শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। চালিয়ে যান তাঁর শিল্পচর্চা।

স্বর্ণপদক লাভের পর আলোচনায় আসেন জয়নুল। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। এশীয় ধাঁচের শিল্পরীতি চোখ বুজে অনুসরণ করেননি, আবার ইউরোপীয় রীতির গণ্ডিতেও তিনি আটকে থাকেননি। দুইয়ের মিশ্রণে নিজস্ব একটা ধাঁচ তৈরি করেন জয়নুল। জয়নুলের শিল্প তুমুল আলোচনায় আসে ১৯৪৩ সালে। তখন চলছে তেতাল্লিশের মন্বন্তর। সে এক মহা দুর্ভিক্ষ। সে সময়কার মানুষের দুর্দশার করুণ চিত্র উঠে আসে জয়নুলের ছবির ক্যানভাসে। সে সময়ে আঁকা জয়নুলের ছবিগুলো দুর্ভিক্ষের প্রতীকী চিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫১ সালে লন্ডনের স্লেড স্কুল অব আর্টে দুই বছরের জন্য প্রশিক্ষণ নেন। তারপর দেশে ফিরে এসে শিল্পকলায় যোগ করেন বাঙালি ধারা।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়। জয়নুল চলে আসেন পূর্ব পাকিস্তানে। তখন পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলায় কোনো আর্ট কলেজ বা প্রতিষ্ঠান ছিল না। ১৯৪৮ সালে পুরান ঢাকার জনসন রোডের এক পুরোনো বাড়িতে জয়নুল প্রথম আর্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। মাত্র ১৮ জন ছাত্র নিয়ে যাত্রা শুরু হয় আর্ট ইনস্টিটিউটের। পূর্ব বাংলার তরুণদের জন্য প্রথমবারের মতো আর্ট শিক্ষার দরজা খুলে যায়। ১৯৫৮ সালে সেই প্রতিষ্ঠানটিই রূপান্তরিত করে আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয় ঢাকার শাহবাগে। এখন এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট নামে পরিচিত। সেই আর্ট কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন জয়নুল আবেদিন।

জয়নুল আবেদিন মানুষের ছবি এঁকেছেন। এঁকেছেন জীবনসংগ্রামের ছবি। তাদের ফসল ঘরে তোলার, নৌকা বাওয়ার, শীতে আগুন পোহানোর, গরু আর গাড়োয়ানের, ঝড়ের দিনের ছবি এঁকেছেন জয়নুল পরম মমতায়। ১৯৫৭ সালে তিনি এঁকেছেন তাঁর বিখ্যাত ছবি ‘নৌকা’, ১৯৫৯ সালে এঁকেছেন ‘সংগ্রাম’। ১৯৭০ সালে ঘূর্ণিঝড়ে লাখো মানুষ প্রাণ হারায়। সেই ঘূর্ণিঝড় অবলম্বন করে ১৯৭৪ সালে তিনি আঁকেন ৩০ ফুট দীর্ঘ ‘মনপুরা-৭০’ ছবিটি। আমাদের সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধও জয়নুলের ক্যানভাসে বিমূর্ত হয়ে উঠেছে। ঊনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থান নিয়ে আঁকেন ৬৫ ফুট দীর্ঘ এক ছবি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এঁকেছেন ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ নামে বিখ্যাত এক ছবি। তাঁর আঁকা ছবির সংখ্যা তিন হাজারেরও বেশি।

জয়নুল যতখানি সময় ব্যয় করেছেন ছবি আঁকতে, তার চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করেছেন এ দেশের শিল্পচর্চার পথ সহজ করতে। তাঁরই উদ্যোগে ১৯৭৫ সালে সোনারগাঁয়ে লোকশিল্প জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। এ দেশের শিল্পচর্চার পথ মসৃণ করতে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে শিল্পাচার্য উপাধি দেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা ইনস্টিটিউটে তাঁর নামে একটি গ্যালারি আছে। বুধ গ্রহে একটি জ্বালামুখের নামকরণ করা হয় তাঁর নামে। সেটার নাম ‘আবেদিন ক্রেটার’।

১৯৭৬ সালের ২৮ মে জয়নুল আবেদিন মৃত্যুবরণ করেন।