একটি ছেলে গাইছে একা...

ভিডিওগুলোতে শ্রেয়ানকে দারুণ গিটার বাজাতে দেখা যায়
সাড়ে সাত বছরের ছোট্ট শ্রেয়ান যখন যেভাবে খুশি, সেভাবে গান গায়। কখনো ঘর মোছার মব হাতে, কখনোবা বারান্দার গ্রিল ধরে। নিজের মনে, নিজের খুশিতে। মাঝেমধ্যে শ্রেয়ানের বাবা গানের মুহূর্তগুলো ক্যামেরাবন্দী করে, তা শেয়ার করেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কিছুদিন আগে ওয়ারফেজ ব্যান্ডের জন্মদিনে ‘একটি ছেলে’ গানটি গেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবাইকে মুগ্ধ করেছে শ্রেয়ান।

প্রথম গান গাওয়া

ক্ষুদে এ গায়কের মূল নাম সাদাত সাফওয়ান। শ্রেয়ান নামেই সবাই ডাকে তাকে। পড়ছে ক্লাস টুতে। সিলেবাসের বাইরে প্রকৃত সৃজনশীল পরিবেশে শ্রেয়ান বেড়ে উঠবে, এমনটাই চাওয়া বাবার। তাই শ্রেয়ানকে স্কুলে ভর্তি করার আগে মা–বাবা চিন্তা করেন, ওকে এমন একটা স্কুলে দেওয়া হবে যেখানে নেই কোনো লেখাপড়া, নেই কোনো পরীক্ষা। যেখানে বাচ্চাদের পড়াশোনা করানো হবে বাচ্চাদের মতো। অনেক স্কুলে খুঁজে দেখার পর অরণি বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় শ্রেয়ান।

স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর, সে বছরের বর্ষায় এক বৃষ্টির দিনে বাসার সবাই হঠাৎ খেয়াল করে, বারান্দায় বসে শ্রেয়ান গুনগুন করে বৃষ্টির গান গাইছে। তখন তার বয়স মাত্র সাড়ে তিন বছর! কোথা থেকে শিখলে এ গান? বাবার এমন প্রশ্নে শ্রেয়ানের সোজাসাপ্টা উত্তর, স্কুলে শিখেছি। দিন পার হতেই দেখা গেল, শ্রেয়ান শরতের সময় শরতের গান আর হেমন্তের সময় হেমন্তের গান গাইছে। গান গাওয়ার শুরুটা এভাবেই।

শ্রেয়ানের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ওর খালা

গানের সঙ্গে দিনকাল

শ্রেয়ানের বাবা এ এস এম মুনির হোসেন ও মা কাজী মেহনাজ তামান্না দুজনই স্থপতি। মা, বাবা ও খালার সঙ্গে মোহাম্মদপুরে থাকে শ্রেয়ান। খালা ছায়ানটে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন। খালা ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধু। শ্রেয়ানের গানের জগতে খালারও কিছুটা প্রভাব রয়েছে। খালার সঙ্গে থেকে নজরুলসংগীত শিখছে শ্রেয়ান।

বাবা ও মায়ের সঙ্গে শ্রেয়ান

আড়াই বছর বয়সে শ্রেয়ান তার ট্যাবে চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমা আর রাশিয়ান কার্টুন দেখত। আড়াই বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পরও শ্রেয়ান ঠিকমতো কথা বলছে না দেখে মা–বাবা কিছুটা দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। মা একদিন গায়েব করে দিলেন ট্যাব। দুই মাস পরই অনর্গল কথা বলতে শিখে যায় শ্রেয়ান। যে কথা দিয়ে এখন সারা দিন গান গায় সে। পরবর্তী সময়ে অবশ্য ট্যাব ফিরে এসেছে তার হাতে। এই ট্যাব দিয়ে শ্রেয়ান এখন একাই গান খুঁজে বের করে, গান শোনে এবং গান সম্পর্কে জানে নানা তথ্য।

গান শুনিয়ে মা-বাবাকে অবাক করাই শ্রেয়ানের কাজ। ওর মুখে নতুন নতুন গান শুনে হরহামেশা অবাক হয় বাসার সবাই। মায়ের কাছে শ্রেয়ান কার্টুন নেটওয়ার্কের মতো ‘এন্টারটেইনমেন্ট প্যাকেজ’।

নতুন কোনো গান শোনার পরই শ্রেয়ানের প্রথম কাজ সেটি নিজের কিবোর্ডে তুলে ফেলা
নতুন কোনো গান শোনার পরই শ্রেয়ানের প্রথম কাজ সেটি নিজের কিবোর্ডে তুলে ফেলা

গান নিয়ে শ্রেয়ানের ধারণা দারুণ। সুর, তাল খুব সহজেই ধরতে পারে সে। নতুন কোনো গান শোনার পরই ওর প্রথম কাজ, সেটি নিজের ছোট কিবোর্ডে তুলে ফেলা। বাবার করা ভিডিওগুলোতে দারুণ গিটার বাজাতে দেখা যায় শ্রেয়ানকে। গিটারটি কিনে দিয়েছেন শ্রেয়ানের ছোট চাচা। আজকাল এটি কোলে নিয়েই ঘুমায় শ্রেয়ান। গিটার বাজাতে গিয়ে আপাতত কোনো নিয়মকানুন সে মানছে না। গান শুনে শুনে, নিজে নিজেই গিটারে কিছু একটা দাঁড় করাচ্ছে। এরপর সেটা বাজিয়েই গাইছে গান। মোবাইল অ্যাপে ড্রাম বাজানোর চেষ্টা চলছে এই লকডাউনে। খালার সঙ্গে বসে হারমোনিয়ামটাও বাজানো হচ্ছে ইদানীং।

আজকাল গিটার কোলে নিয়েই ঘুমায় শ্রেয়ান
আজকাল গিটার কোলে নিয়েই ঘুমায় শ্রেয়ান

ওয়ারফেজ ও অন্যান্য

গানের সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম দিকে শ্রেয়ান আইয়ুব বাচ্চু, জেমস ও লাকী আখান্দের গান শুনত। ঠিকভাবে কথা বলতে না পারলেও পুরো দমে গান গাইত শ্রেয়ান। মেটাল ও হার্ড রক গান শুনতে পছন্দ করে সে। প্রিয় ব্যান্ড ‘ওয়ারফেজ’। এ বছর প্রিয় ব্যান্ডের জন্মদিনে ‘একটি ছেলে’ গানটি গেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবাইকে মুগ্ধ করে দেয় শ্রেয়ান।

ওয়ারফেজ সম্পর্কে প্রায় সব জানা। জনপ্রিয় এ ব্যান্ডের ভাঙাগড়া থেকে শুরু করে কোন অ্যালবামে কে মিউজিক করেছেন, কোন সদস্য কত দিন থেকে কবে চলে গেছেন, সাবেক ব্যান্ড সদস্যরা এখন কে কী করছেন, সবই মুখস্ত শ্রেয়ানের। ওয়ারফেজের প্রায় সব সদস্যই শ্রেয়ানের গলায় ‘একটি ছেলে’ গানটি শুনেছেন এবং প্রশংসা করেছেন। ওয়ারফেজভক্ত শ্রেয়ান কখনো ওয়ারফেজের ব্যান্ড সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে পারেনি। তার খুব ইচ্ছা, প্রিয় ব্যান্ড ওয়ারফেজের মানুষগুলোর সঙ্গে দেখা করার। ওয়ারফেজ ছাড়াও শ্রেয়ান এলআরবি, সোলস, নগরবাউল ও মাইলসের গান শোনে। নিজে নিজেই সব গান সিলেক্ট করে শ্রেয়ান। ইদানীং সুইডিশ ব্যান্ড ‘ইউরোপ’-এর গানও শোনা হচ্ছে।

শ্রেয়ানের কিছু গান

কিশোর আলোর পাঠকদের জন্য দেওয়া হলো শ্রেয়ানের কভার করা তিনটি গান। 

একটি ছেলে : ওয়ারফেজ 

ইটজ মাই লাইফ : বন জভি

মহারাজ : ওয়ারফেজ

আরও শখ

শ্রেয়ান পড়ালেখাতেও আনন্দ পায়। গণিত ওর প্রিয় বিষয়। শ্রেয়ান বই পড়ে, ছবি আঁকে। একই সময়ে দুই হাতে আলাদা আলাদা ছবি আঁকতে পারে সে। এ ছাড়া তায়কোয়ান্দো শিখছে শ্রেয়ান। ঘোরাঘুরিটাও খুব পছন্দ ওর। আরও ছোট থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞান ওর আগ্রহের বিষয়। মহাকাশের গল্প শুনতে ও এ বিষয়ে ইউটিউবে ডকুমেন্টারি দেখতে ভালোবাসে শ্রেয়ান।

তায়াকোন্দো শেখে শ্রেয়ান

বড় হয়ে কী হতে চাও? এমন প্রশ্নের জবাবে শ্রেয়ান জানায়, বড় হয়ে অনেক কিছু হতে চায় সে। ‘অনেক কিছু’র তালিকায় গানও আছে। শ্রেয়ানের মা–বাবার চাওয়া, ও একজন সংবেদনশীল ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠুক। মানুষকে ভালোবাসুক, পৃথিবীটাকে ভালোবাসুক।