সঙ্গী-সাথি চতুষ্পদী

চারপেয়ে সঙ্গীদের কথা মনে এলে আমার কখনোই হামাগুড়ি দেওয়া মানবশিশুর কথা মনে পড়ে না। তারা সবকিছুতেই কান্নাকাটি করে আর দুই ঘণ্টা পর পর প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়। ভালো সঙ্গী হিসেবে লোমশ-চারপেয়ে যাদের কথা বলা হচ্ছে, এরা আমার জীবনের সবচেয়ে চমৎকার বন্ধু, যদিও এরা আমাকে কখনো আইসক্রিম কিনে দেয় না অথবা হোমওয়ার্ক করে দেয় না।

আমি মানুষ হিসেবে এতই জংলি হয়ে জন্মেছিলাম যে আমার চারপেয়ে কাল কাটিয়েছিলাম নানুবাড়ির খাটের নিচের বিড়ালদের সঙ্গে। তাদের ছিল ধবধবে সাদা একটা মা আর ছয় ভাইবোন। ওদের নাম দিয়েছিলাম সিমকি-চুমকি-রুমকি-পিংকি...‘কি’ দিয়ে যতগুলো নাম দেওয়া সম্ভব।

এরপর দাদুবাড়িতে যখন থাকতাম, আমার জন্মের আগে থেকেই ছিল বিল্টু। বিল্টু ছিল এলাকার পাহারাদার কুকুর। অনেক সাহসী। চোর তাড়াতে গিয়ে একবার সে বেশ ব্যথাও পেয়েছিল। এক হোমিওপ্যাথ ডাক্তার দাদাভাইয়ের ওষুধে তার দগদগে ঘা সেরে গেলে আমরা সবাই হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। সন্ধ্যাবেলায় খেলার আসরে মানুষ আমাকে দুধভাত বানালে অভিমান করে আমি বিল্টুর কাছে বিচার দিতাম, কারণ সে ছিল আমার চেয়ে চার বছরের বড়। প্রতি বেলায় খাবারের থালায় কিছু অবশিষ্ট পেলে মা আমাকে ডালের চামচ দিয়ে আচ্ছামতো ঠুকে দিত বলে বাকিটা আমি চুপিচুপি গিয়ে বিল্টুকে দিয়ে আসতাম। খড়ের মতো সোনালি রঙের বিল্টুর সঙ্গে আমার একটু বেশি খাতির ছিল, আমি ওর লোমশ গায়ে হাত বুলিয়ে দিতাম। কখনো আবেগের আতিশয্যে (বিশেষ করে মায়ের বকা খেলে) ওর গলা জড়িয়ে বিরস মনে বসেও থাকতাম। প্রথম প্রথম এটা দেখে বাসার লোকজন আমাকে আচ্ছা করে বকা দিলেও শেষমেশ তারা নিয়মিত বিল্টুকে গোসল করাতে বাধ্য হয়েছিল।

ক্লাস ওয়ানে উঠে মা-বাবা আর আমি অন্য শহরে চলে আসি। একা একা থাকতাম বলে একদিন বাবা একটি খরগোশ নিয়ে এল। নাম দিলাম কিটি। ভাড়া বাসার ছাদে অন্য খরগোশদের সঙ্গে কিটি ঘুরে বেড়াত। দোতলার মীমকে নিয়ে আমি ওদের ভুসি, ঘাস ও শাকসবজির খোসা খাওয়াতাম। পেটুক খরগোশেরা মাঝেমধ্যে মীমদের কবুতর উড়িয়ে দিয়ে নিচে পড়ে থাকা গমের দানা খেত। কিটির বাচ্চা হলো তিনটি। দেখতে নেংটি ইঁদুরের ছানার মতো। গোলাপি আর লোমহীন, চোখও ফোটেনি! দুই সপ্তাহের মধ্যে তারা চোখ ফুটে, লোম উঠে গোল পিং-পং বলের আকৃতি ধারণ করল। আমরা নাওয়া-খাওয়া ফেলে সারা দিন এদের নিয়ে মেতে থাকতাম। কিন্তু আকৃতি টেনিস বলের মতো হওয়ার আগেই একদিন হতচ্ছাড়া এক কাক এসে এদের নিয়ে গেল। এর পর থেকে আমি আর কাক সহ্য করতে পারি না। একদমই না।

মাঝে এক ছুটিতে নানুবাড়ি বেড়াতে গেলাম এক আঙ্কেলের কাছে কিটিকে রেখে। ফিরে এসে দেখি, কিটির মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। কিটি তো ছেলে ছিল না, এই পরিবর্তন কেন আসবে! বড় মানুষেরা আমাকে নানা কথা বোঝালেও আমি আসল ঘটনা যখন বুঝেছিলাম, তখন বড়দের ওপর বিশ্বাসই উঠে গেল। এরপর ছেলে কিটির জন্য সঙ্গিনী আনা হয়েছে, ওরা ১০ বছর ধরে ঘর-সংসার করে নাতিপুতি দিয়ে যে হাল করেছে, তা জানাতে হলে আমাকে একটা বিশাল বংশপঞ্জি বানাতে হবে।

এরপর আসি হতচ্ছাড়াদের কথায়। সবারই কিছু বন্ধু থাকে, যারা কোনো কাজেরই হয় না, ক্লাসে ঘুমিয়ে থাকে, টিফিনের অর্ধেক নিজের পেটে চালান করে দেয়। ২০১০ সালে যখন বিশ্বকাপ ফুটবলের সেমিফাইনাল চলছিল, তখন আমাদের বাসায় খেতে আসা একটা বিড়াল তার একটা বাচ্চা রেখে চলে যায়। কোলে-পিঠে মানুষ করার পর থেকে তিনি মহারাজার মতো জীবন যাপন করছেন। যখন ছোট ছিল, তখন সে অনেক লক্ষ্মী ছিল, কোলের ওপর চুপটি করে বসে থাকত, উলের বল দিয়ে খেলত। তবে এখন একে দেখতে আন্ডারওয়ার্ল্ডের বদখত গুন্ডার মতো লাগে। দিনে চার বেলা মাছ-ভাত খেয়ে পাঁচ কেজি ওজন নিয়ে মিউন যখন আমাদের সামনে দিয়ে হেঁটে যায়, তখন মনে হয় আমরা সবাই এর অধীন! তিনি রাজা আমরা সবাই তুচ্ছ প্রজা। এমনকি আজ যখন ছবি তুলতে যাচ্ছিলাম, তখন সে অনেক বিশ্রীভাবে ছবি তুলতে অসম্মতি জানিয়ে আমাকে ১০ মণের একটা থাবা দিয়ে বাইরে হাওয়া খেতে বের হয়ে গেল!

এমন বদমেজাজ নতুন কিছু না তার জন্য। সম্প্রতি বাসায় আরও একটা বিড়াল যোগ হয়েছে, যে দেখতে সম্পূর্ণ ওরই মতো। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার পথে একে একটা বস্তা থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। আপাতত একে ‘বগা’ বলেই ডাকা হচ্ছে।

কেন জানি আমার বাসায় শুধু কালো বিড়ালছানারাই আশ্রয় নেয়, যারা ভয়াবহ দুরন্ত আর একই সঙ্গে অসম্ভব রকম মায়াকাড়া। আমার মনে হয়, এসব মায়ার কারিকুরি দেখিয়েই এরা কোনো একদিন পৃথিবীটা দখল করে নেবে।