সপ্তাশ্চর্য

আমাজন নদী

সেই আদ্যিকাল থেকে বিশ্বজোড়া সাতটি চমৎকার স্থাপনার তালিকা করে আসছে মানুষ, যা দেখে অভিভূত হয়েছে সবাই। যাকে আমরা সপ্তাশ্চর্য বলি। সপ্তাশ্চর্য কেন সাতটি, তারও একটি ব্যাখ্যা আছে। সাত সংখ্যাটা বেছে নিয়েছিলেন প্রাচীন গ্রিসের নাগরিকেরা। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, সাতে কোনো ত্রুটি নেই। সাত হলো প্রাচুর্যের প্রতীক। আরেকটি কারণ হলো, সে সময় কেবল পাঁচটি গ্রহের খবর জানত মানুষ। এর সঙ্গে চাঁদ ও সূর্য যোগ করলে হয় সাত।

না দেখলেই নয়

প্রাচীন বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের তালিকা করেছিলেন গণিতবিদ ফিলো অব বাইজানটিয়াম। আরও অনেকেই অবশ্য এমন তালিকা করেছিলেন। অনেকে সমন্বয় করেছিলেন। তালিকায় কী কী থাকা উচিত, তা নিয়ে কেউ কেউ দ্বিমত করেছিলেন। তবে খ্রিষ্টপূর্ব ২২৫ সালে প্রকাশিত ফিলোর অন দ্য সেভেন ওয়ান্ডার্স বইয়ে সপ্তাশ্চর্যকে তিনি ‘থেমাটা’ হিসেবে উল্লেখ করেন। গ্রিক ভাষায় সে শব্দের বাংলা করা যেতে পারে ‘না দেখলেই নয়’। অর্থাৎ ফিলো মূলত ট্রাভেল গাইড বা ভ্রমণনির্দেশক লিখেছিলেন। সপ্তাশ্চর্যের প্রতিটি সে সময়ের মানুষের সৃজনশীলতা ও স্থাপত্যকলার সেরা নিদর্শন। নিশ্চয় অনেক দূর থেকে অনেক পথ পাড়ি দিয়ে পর্যটকেরা সেগুলো দেখতে যেতেন।

প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে কেবল একটি এখনো মোটামুটি বহাল তবিয়তে আছে। অথচ গিজার সেই মহা পিরামিড প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন। এদিকে রোডসের মূর্তি, হ্যালিকারনেসাসের সমাধি মন্দির, আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর, আরটেমিসের মন্দির এবং অলিম্পিয়ার জিউসের মূর্তির কোনোটির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়, কোনোটি ভূলুণ্ঠিত। আর ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যানের কপালে কী জুটেছিল, তা কারও জানা নেই। সেটি কোথায় ছিল কিংবা আদৌ ছিল কি না, তা নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যাহোক, এই সাতটি মিলিয়েই প্রাচীন বিশ্বের সপ্তাশ্চর্য বলে এখন আমরা জানি।

জিজু আইল্যান্ড

এই স্থাপনাগুলো কেন তৈরি করা হয়, তা বিস্তর আলোচনার বিষয়। কিছু কিছু ছিল প্রয়োজনের জন্য। যেমন আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর। ওই অঞ্চলের কোথাও কোথাও সমুদ্রপথের গভীরতা কম ছিল, ডুবো পাথরে নৌযান ধাক্কা লাগার আশঙ্কা ছিল। সে কারণেই পথনির্দেশক হিসেবে সেটি তৈরি করা হয়। ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান আদৌ ছিল কি না, তা নিয়ে সংশয় যদি অমূলক হয়, তবে সেটি সম্রাজ্ঞীর জন্য উপহার হিসেবে তৈরি করেছিলেন ব্যাবিলনের তৎকালীন সম্রাট।

সপ্তাশ্চর্যের বেশির ভাগই তৈরি হয়েছিল; কারণ, সে সময়ের শাসকেরা হয়তো নিজেকে কালোত্তীর্ণ করতে চেয়েছিলেন। মানে যুগ যুগ ধরে মানুষ তাঁদের কীর্তি মনে রাখবে, দেখে বাহবা দেবে, হয়তো এমনটা চেয়েছিলেন। তাঁদের সে উদ্দেশ্য তো কিছুটা হলেও সফল। স্থাপনাগুলো নেই, অথচ আজও আমরা তা নিয়ে সেই সাতপাঁচ করে যাচ্ছি।

সাত-সাতে নতুন সপ্তাশ্চর্য

বুঝতেই পারছ, গিজার মহা পিরামিড বাদ দিলে বাকি ছয়টি সপ্তাশ্চর্য দেখার সৌভাগ্য আমাদের কখনোই হবে না। ওগুলোর অস্তিত্ব কেবল প্রাচীন চিত্রলিপিতেই সীমাবদ্ধ। হয়তো সে কারণেই সপ্তাশ্চর্যের তালিকা হালনাগাদের প্রয়োজন দেখা দেয়। ২০০০ সালের দিকে ‘নিউ সেভেন ওয়ান্ডার্স ফাউন্ডেশন’ নামের সুইজারল্যান্ডভিত্তিক এক সংস্থা নতুন সপ্তাশ্চর্যের খোঁজে নেমে পড়ে। এই সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন সুইস বংশোদ্ভূত কানাডীয় বার্নার্ড ওয়েবার।

প্রথমে ৭৭টি স্থাপনার তালিকা তৈরি করে নিউ সেভেন ওয়ান্ডার্স ফাউন্ডেশন। সব কটিই ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান। তা থেকে একদল বিচারক ২১টি স্থাপনা নির্বাচন করেন। এই পর্যায়ে দুনিয়াজোড়া মানুষকে আহ্বান জানানো হয় নতুন সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনের। অনলাইনে, এসএমএসের মাধ্যমে এবং কিছু কিছু জায়গায় টেলিফোনে ভোট দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। আয়োজনটিকে সে সময়ের সবচেয়ে বড় গণভোট হিসেবে বলা হয়েছিল। ভোটাভুটি শেষে ২০০৭ সালের ৭ জুলাই পর্তুগালের লিসবনে নতুন সপ্তাশ্চর্যের তালিকা প্রকাশ করা হয়। ঘোষণার তারিখটি (০৭-০৭-২০০৭) দেখো, সেখানেও সেই সাতেরই খেলা।

হালং বে

নতুন তালিকায় স্থান পায় চীনের মহাপ্রাচীর, মেক্সিকোর চিচেন ইৎজা, জর্ডানের পেত্রা, পেরুর মাচুপিচু, ব্রাজিলের ক্রাইস্ট ডি রিডিমার, রোমের কলোসিয়াম এবং ভারতের তাজমহল। আর মহাদেশের কথা বললে স্থাপনাগুলো মোট চারটি মহাদেশে রয়েছে। আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার কোনো স্থাপনা নতুন সপ্তাশ্চর্যের তালিকায় ঠাঁই পায়নি। তালিকায় অ্যান্টার্কটিকাও নেই। সে অবশ্য থাকার কথাও নয়। কারণ, তালিকা নতুন হলেও স্থাপনাগুলো প্রাচীন নিদর্শন।

তালিকায় আফ্রিকা নেই বলা ঠিক হলো না। কারণ, পুরোনো তালিকার মিসরের গিজার পিরামিডকে নতুন তালিকায় সম্মানজনক স্বীকৃতি বা অনারারি স্ট্যাটাস দেওয়া হয়েছে। যাক, বাঁচা গেল। কারণ, আমাদের সপ্তাশ্চর্য দেখার সুযোগ এবার আর একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।

বাংলাদেশও ছিল

তোমাদের মনে আছে কি না জানি না, বছর দশেক আগে আমরা সবাই মিলে কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতকে বিজয়ী করতে খুব চেষ্টা করেছিলাম। এসএমএস দাও, অনলাইনে নিবন্ধন করো, বন্ধুদের বলো, প্রচারণা চালাও, আরও কত কী! প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনের শেষ দিকের ঘটনা এসব। চূড়ান্ত তালিকায় অবশ্য আমাদের সমুদ্রসৈকত ছিল না।

নতুন সপ্তাশ্চর্যের তালিকা প্রকাশের পর ২০০৭ সালেই প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনের উদ্যোগ নেয় নিউ সেভেন ওয়ান্ডার্স ফাউন্ডেশন। তিনটি ধাপে নির্বাচন হয়। ২০০৭-এর ডিসেম্বর থেকে ২০০৯ সালের ৭ জুলাই পর্যন্ত প্রাথমিক মনোনয়ন ঠিক করা হয় ভোটাভুটির মাধ্যমে। ৪৪০টির বেশি স্থানের নাম জমা পড়ে। তা থেকে বেছে নেওয়া হয় শীর্ষ ৭৭টি। নিউ সেভেন ওয়ান্ডার্স ফাউন্ডেশনের বিচারকেরা তা থেকে ২৮টি স্থান নির্বাচন করলে বাদ পড়ে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত। তবে তালিকায় ছিল সুন্দরবন। আবার ভোট দেওয়ার পালা। নির্বাচনের পুরো প্রক্রিয়ায় প্রায় ৫০ কোটি ভোট জমা পড়েছিল। অবশেষে ২০১১ সালের ১১ নভেম্বরে সুইজারল্যান্ডের জুরিখে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করে নিউ সেভেন ওয়ান্ডার্স ফাউন্ডেশন।

প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যের চূড়ান্ত তালিকায় ঠাঁই হয় দক্ষিণ আফ্রিকার টেবিল মাউন্টেন, ভিয়েতনামের হালং বে, দক্ষিণ কোরিয়ার জিজু দ্বীপ, দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদী ও রেইন ফরেস্ট, ইন্দোনেশিয়ার কমোডো দ্বীপ, ব্রাজিলের ইগুয়াচু জলপ্রপাত এবং ফিলিপাইনের পুয়ের্তো প্রিনসেসা ভূগর্ভস্থ নদী।

নতুন সপ্তাশ্চর্য নিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি। অনেক দেশ থেকে অভিযোগ জানানো হয়। অভিযোগের আওয়াজ জোরালো হয়েছে কোথাও কোথাও। ভোট দেওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। তবু সবকিছু ছাড়িয়ে নতুন সপ্তাশ্চর্যকে স্বাগত জানিয়েছে মানুষ।

সাত নিয়ে সাতপাঁচ অনেক করা যাবে বলেছিলাম। করেও ফেললাম। এবার শেষ করা যাক। শুধু শেষ দুটি প্রশ্ন। বলো তো, ‘হ্যারি পটার’ সিরিজে মূল বইয়ের সংখ্যা কটি? কিংবা জেমস বন্ডের কোড নম্বর কত?