সবকিছু মনে রাখে যে

‘ছোটবেলার সেই ঘটনাটা বলে দেব? ওই যে সেবার তোকে কোলে নিল ছোট খালু আর তুই কোলে উঠেই পি...’ বড় ভাই বা বোন ভিলেন মার্কা হাসি দিয়ে চমত্কার আড্ডার মধ্যে যদি তোমার ছোটবেলার বেঢপ গল্প করতে শুরু করে, তখন বাধ্য হয়েই তোমাকে ‘প্লিজ প্লিজ’ বলতে হয় গল্পটি না বলতে। আর এই সুযোগে বড়রা ‘আগামী দুই দিন আমার সব কথা শুনবি’ শর্ত জুড়ে দিলেও তোমাকে রাজি হতে হয়। ছোটদেরই যত জ্বালা! ছোটবেলায় কার কোলে না কার কোলে ‘ইয়ে’ করেছ, সে কথা মনে করিয়ে দেওয়ার কী আছে? আচ্ছা, ভেবে দেখো তো, যদি তোমার ছোটবেলার সব স্মৃতি মনে থাকত? এমনকি যখন কথা বলতে পারো না সেই সময়েরও? ভাবছ, ধুর! এ-ও কি সম্ভব? খুব সম্ভব!

ব্রিসবেনের রেবেকা শ্যারকের কথাই বলছি। তার বয়স তখন মাত্র ১২ দিন। বাবার কী খেয়াল হলো, গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসিয়ে ছবি তুললেন শ্যারকের। শ্যারক স্টিয়ারিং হুইলের দিকে তাকিয়ে তখন ভাবছিল, ‘এটা আবার কী?’ নেহাত কথা বলতে পারত না বলে জিজ্ঞেস করেনি। কিন্তু বড় হয়ে এ ঘটনার কথা মাকে বলতে ভোলেনি সে।

১২ দিন বয়সের কথা কীভাবে মনে রাখা সম্ভব? ১২ দিন থেকে এখন এই ২৭ বছর বয়সের সব ঘটনাই মনে আছে শ্যারকের। ছোট-বড়, সাধারণ-অসাধারণ একদম সব স্মৃতি! কবে পড়ে গিয়ে বাঁ হাঁটুতে ব্যথা পেয়েছিল, স্কুলে কে বুলিং করেছিল কিছুই ভুলতে পারেনি সে। ধরো, ১০ বছর আগের সেসব স্মৃতি মনে করলে ঠিক একই রকম অনুভূতি হয় তার, যেমনটা হয়েছিল ১০ বছর আগে।

এমন অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে বেশ ভুগতে হয়েছে তাকে। রাতের বেলা ঘুমাতে গেলেও হাজার স্মৃতির ভিড়ে সে ঘুমাতে পারত না। সারাক্ষণ একটা না একটা স্মৃতি মনে পড়তই তার। বাধ্য হয়ে একটা ছোট্ট রেডিও কানের পাশে রেখে, নিবুনিবু আলোয় ঘুমাত।

স্কুলে আরেক সমস্যা। শিক্ষক একটা প্রশ্ন করেছেন, কিন্তু শ্যারক উত্তর দিতে পারছে না। এক ঘণ্টা আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার খুঁটিনাটি তখন তার মাথায় ঘুরছে। স্মৃতির চাপে সে বর্তমান সময়টাতেই মনোযোগ দিতে পারত না। আর তাই সহপাঠীদের বুলিংও সহ্য করতে হতো তাকে। স্কুল থেকে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরেছে সে, এমন দিনও গেছে। পাস করে বের হওয়ার পর একদিন ছোট বোনের সঙ্গে স্কুলে গিয়েছিল শ্যারক। দুঃসহ সব স্মৃতি মনে করে বেশিক্ষণ থাকতে পারেনি সেখানে।

এ রকম মানসিক যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে নিয়মিত চিকিত্সা নিতে হতো তাকে। অটিজমের সমস্যার চেয়েও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াল তার এসব মনে রাখতে পারার কষ্ট!

একদিন শ্যারকের মা, মিসেস জেনেট টিভিতে অনুষ্ঠান দেখছিলেন। সেটা ২০১১ সালের কথা। অনুষ্ঠানের বিষয় ‘হাইলি সুপিরিয়র অটোবায়োগ্রাফিক্যাল মেমোরি’ বা সংক্ষেপে এইচএসএএম। এইচএসএএম হলো নিজের জীবনের সব ঘটনা মনে রাখতে পারার ক্ষমতা। অন্য কারও নয়, শুধু নিজের জীবনের ঘটনা। তখনই প্রথম মিসেস জেনেট বুঝতে পারলেন, তার প্রিয় বেকির এই অস্বাভাবিক ক্ষমতা রয়েছে।

যে বিষয়টাকে এত দিন শ্যারক একটা দুঃস্বপ্ন আর আতঙ্কের বিষয় ভাবত, কিংবা ভাবত, একটা কুিসত রোগ, সে ব্যাপারে হঠাত্ তার ধারণা বদলে গেল। পৃথিবীতে মাত্র ৮০ জন মানুষ আছে, যারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাদের জীবনের সব স্মৃতি মনে রাখতে পারে। শ্যারক তাদের মধ্যে একজন। তাকে নিয়ে বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়া ও কুইন্সল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রেইন ইনস্টিটিউট গবেষণা করছে। মানুষের মস্তিষ্ক ঠিক কীভাবে কাজ করে, বিষয়টা বেশ জটিল আর অদ্ভুত। একদিকে মানুষ ‘অ্যালঝেইমার’ নামক স্মৃতি ভুলে যাওয়া রোগে ভোগে, অন্যদিকে একদম সব স্মৃতি কেউ কেউ মনে রাখতে পারে। শ্যারকের মস্তিষ্ক গবেষণার অন্যতম কারণ, যদি সেখান থেকে অ্যালঝেইমার সমস্যার সমাধান বের করা যায়।

শ্যারকও বসে নেই। পুরো হ্যারি পটার সিরিজের সব বই সে গড়গড় করে বলতে পারে। লাইনের পর লাইন, পাতার পর পাতা। আর নিজেও একটা বই লেখা শুরু করেছে। যার নাম ‘মাই লাইফ ইজ আ পাজল’। কিন্তু একদম সব ঘটনা লিখে ফেলাটা চাট্টিখানি কথা নয়। চার বছর বয়সের কথা লিখছে সে এখন। জীবনটাকে আর দুঃসহ লাগে না তার।

তথ্যসূত্র: বোরড পান্ডা, ওমনিডটকম, ডেইলিমেইল ইউকে