এ দেশে যত আন্দোলন হয়েছে, তার সিংহভাগে ছিলেন সুফিয়া কামাল। বাঙালিদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সব সময় মিছিলের সামনের সারিতে পাওয়া গেছে তাঁকে।
সুফিয়া কামালের যখন জন্ম হয়, তখন এ দেশের মুসলিম মেয়েরা শিক্ষাদীক্ষায় অনেক পেছনে পড়ে ছিল। ১৯১১ সালের ১০ জুন বরিশালের শায়েস্তাবাদে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা সৈয়দ আবদুল বারী ছিলেন পেশায় উকিল। সুফিয়া কামালের সাত বছর বয়সে বাবা বাড়ি ছেড়ে চলে যান। মা সৈয়দা সাবেরা খাতুনের কাছে বড় হতে থাকেন সুফিয়া। সুতরাং বুঝতেই পারছ, কী রকম এক অবস্থা থেকে তাঁকে উঠে আসতে হয়েছে! বাড়িতে ছিল উর্দু ভাষার চল। সুফিয়া নিজের উদ্যোগেই শিখে নিয়েছিলেন বাংলা। খুব বেশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না তাঁর।
মায়ের সঙ্গে ১৯১৮ সালে কলকাতায় গিয়েছিলেন সুফিয়া। সেখানেই তাঁর সাক্ষাত্ হয় রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। সুফিয়ার কোমল মনে বেগম রোকেয়া ঠাঁই করে নেন।
১৯২৩ সালে মামাতো ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে সুফিয়ার বিয়ে হয়। পরে তিনি ‘সুফিয়া এন হোসেন’ নামে পরিচিত হন। সৈয়দ নেহাল হোসেন সুফিয়াকে সমাজসেবা ও সাহিত্যচর্চায় উৎসাহ দেন। বরিশালের তরুণ পত্রিকায় ১৯২৩ সালে সুফিয়ার লেখা প্রথম গল্প ‘সৈনিক বধূ’ প্রকাশিত হয়।
১৯২৫ সালে মহাত্মা গান্ধী বরিশালে এসেছিলেন। সুফিয়া সাক্ষাৎ করেন তাঁর সঙ্গে। কলকাতায় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা হওয়া ছিল সুফিয়ার জীবনে এক অসাধারণ ঘটনা। কবি নজরুল সুফিয়ার কবিতা পড়ে মুগ্ধ হন। সওগাত পত্রিকায় মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ‘বাসন্তী’ নামে তাঁর প্রথম কবিতা ছাপেন ১৯২৬ সালে।
১৯৩১ সালে সুফিয়া মুসলিম মহিলাদের মধ্যে প্রথম ‘ভারতীয় মহিলা ফেডারেশন’-এর সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৩২ সালে তাঁর স্বামী মারা যান। ১৯৩৩-৪১ পর্যন্ত তিনি কলকাতা করপোরেশন প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। পাশাপাশি চলতে থাকে সাহিত্যচর্চা। ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সাঁঝের মায়া কাব্যগ্রন্থটি। বইটির ভূমিকা লিখেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এটি পড়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। পরের বছর আপনজন ও শুভানুধ্যায়ীদের ইচ্ছায় তিনি চট্টগ্রামের লেখক ও অনুবাদক কামালউদ্দীন আহমদকে বিয়ে করেন। সেই থেকে তিনি ‘সুফিয়া কামাল’ নামে পরিচিত হন।
১৯৪৬ সালে কলকাতায় যখন হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাধে, তখন তিনি লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজে একটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলার ব্যাপারে সাহায্য করেন। পরের বছর মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকা প্রকাশ করলে তিনি হন তার প্রথম সম্পাদক। ওই বছরেরই অক্টোবর মাসে তিনি সপরিবারে ঢাকা চলে আসেন।
১৯৪৮ সালে তিনি হিন্দু-মুসলিম সমপ্রীতি রক্ষার উদ্দেশ্যে শান্তি কমিটিতে যোগ দেন। ওই বছরই তাঁকে সভানেত্রী করে ‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতি’ গঠিত হয়। ১৯৪৯ সালে তাঁর যুগ্ম সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সুলতানা পত্রিকা। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সুফিয়া কামাল সরাসরি অংশ নেন। শুধু তা-ই নয়, পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির ওপর দমননীতির অঙ্গ হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে তিনি তাঁর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে তিনি ‘সাংস্কৃতিক স্বাধিকার আন্দোলন’ পরিচালনা করেন। ১৯৬৯ সালে ‘মহিলা সংগ্রাম পরিষদ’ (বর্তমানে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ) গঠিত হলে তিনি তার প্রতিষ্ঠাতাপ্রধান নির্বাচিত হন। আজীবন তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সুফিয়া কামালের দুই মেয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। ভারতের আগরতলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সেবার জন্য একটি হাসপাতাল করা হলে তাঁরা সেখানে কাজ করেন। সুফিয়া, তাঁর স্বামী ও ছেলে দেশে ছিলেন। যুদ্ধকালীন তিনি ‘একাত্তরের ডায়েরি’ নামে একটি দিনলিপি রচনা করেন। এ সময়ে লেখা তাঁর কবিতাগুলো পরবর্তীকালে মোর যাদুদের সমাধি ’পরে নামে প্রকাশিত হয়। কবিতাগুলোতে তিনি বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা বর্ণনা করেন।
স্বাধীনতার পরেও সুফিয়া কামাল অনেক সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেন। তিনি যেসব সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন সেগুলো হলো বাংলাদেশ মহিলা পুনর্বাসন বোর্ড, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন কমিটি এবং দুস্থ পুনর্বাসন সংস্থা। এ ছাড়া তিনি ছায়ানট, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন এবং নারীকল্যাণ সংস্থার সভানেত্রী ছিলেন।
কেয়ার কাঁটা (১৯৩৭) সুফিয়া কামালের উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ। মায়া কাজল (১৯৫১), মন ও জীবন (১৯৫৭), উদাত্ত পৃথিবী (১৯৬৪), অভিযাত্রিক (১৯৬৯) তাঁর উল্লেখযোগ্য বই। তাঁর কবিতা চীনা, ইংরেজি, জার্মান, ইতালিয়ান, পোলিশ, রুশ, ভিয়েতনামিজ, হিন্দি ও উর্দু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর তিনি মারা যান।