সমুদ্রের গভীরে

শিল্পী সাইমন মারটনের কল্পনায় ডুবোজাহাজ নটিলাস

ছোটবেলায় তোমরা নিশ্চয়ই পড়েছ, ভূপৃষ্ঠের তিন ভাগ জল, এক ভাগ স্থল। অর্থাৎ পুরো পৃথিবীপৃষ্ঠকে ৩ ভাগ করলে এর ২ ভাগ, মানে ৭০ শতাংশের মতোই পানি। বাকি ৩০ শতাংশের মতো মাটি। এই ৩০ শতাংশ মাটি বা স্থল বর্তমানে ৭টি মহাদেশে বিভক্ত। কিন্তু এই সব কটি মহাদেশ, সবটুকু মাটি বা স্থল একসময় একসঙ্গে ছিল একটি ‘অতি অতি মহাদেশ’ হিসেবে। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন প্যানজিয়া। ১৮ কোটি বছর আগে এই ‘অতি অতি মহাদেশ’ ভেঙে গিয়ে তৈরি হতে থাকে দুটি অতি মহাদেশ—লরেশিয়া ও গন্ডোয়ানাল্যান্ড।

যদি কল্পনার চোখ থাকে, তাহলে তুমি নিশ্চয়ই বিষয়টা বুঝে ফেলেছ। পুরো পৃথিবীর সবটা মাটি আসলে বিশাল সমুদ্রের মধ্যে একটুখানি দ্বীপের মতো ভাসছিল সে সময়—১৮ কোটি বছর আগে। তারপর ধীরে ধীরে এই মাটি ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে গড়ে ওঠে বিভিন্ন মহাদেশ। সে আরেক গল্প। আজ আমরা বরং সমুদ্রের গভীরে একটু ডুব দেব।

প্রাচীনকাল থেকে একটা দীর্ঘ সময় সমুদ্রের গভীরে কী আছে, সে বিষয়ে কিছুই জানত না মানুষ। না জানাই স্বাভাবিক। কারণ, মানুষের প্রধান চিন্তা ছিল জীবন ধারণ, সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা ও কঠিন প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা। এর মধ্যে একটুখানি কাব্য ও খানিকটা দর্শনচিন্তা মানুষকে তাড়িত করেছিল চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকাতে। আকাশপানে চেয়ে মানুষ নিজেকে প্রশ্ন করেছিল, জ্বলজ্বল করে চলা ওগুলো আসলে কী? এসব নক্ষত্র ও তাদের পেছনের বিজ্ঞান, মানুষ কীভাবে মহাকাশের গোপন রহস্যগুলো ভেদের চেষ্টা করে গেছে যুগে যুগে, সেসব গল্প তোমরা নিশ্চয়ই অনেক পড়েছ। কিন্তু তোমরা কি জানো, সমুদ্রের গভীরেও আছে রহস্যময় এক জগৎ? গভীর সমুদ্রের তলদেশে, যেখানে আলো পৌঁছাতে পারে না, সেখানেও আছে প্রাণ? আসো, সে গল্প আজ একটু শুনে আসি।

দুই

বিশাল সমুদ্রের নীল জলরাশির দিকে তাকিয়েছ কখনো? অবাক করা বিষয় হলো, সমুদ্রের এই বিশালতার মধ্যে বাস করে পৃথিবীর মোট জীবের ২ শতাংশের কম! এই অল্পসংখ্যক জীবের প্রায় ৯০ শতাংশ আবার বাস করে সমুদ্রের ওপরের ২০০ মিটারের মধ্যে। ঠিক এখান থেকেই আমাদের যাত্রা শুরু।

কীভাবে যাত্রা করব, সে নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না। মানুষের কল্পনার চেয়ে শক্তিশালী আর কিছু নেই। কল্পনায় ধরে নাও, ক্যাপ্টেন নিমোর নটিলাসের চেয়ে দুর্ধর্ষ কোনো ডুবোজাহাজ আছে আমাদের। সেই জাহাজে করে আমরা চলে যেতে পারব সমুদ্রের এক্কেবারে গহিনে। (ক্যাপ্টেন নিমোকে যদি চিনতে না পার, তাহলে বলে রাখি। বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান লেখক জুলভার্নের টোয়েন্টি থাউজ্যান্ড লিগস আন্ডার দ্য সি’স উপন্যাসের চরিত্র তিনি। দুর্ধর্ষ এই ক্যাপ্টেন ডুবোজাহাজ নটিলাসে করে ঘুরে বেড়ান সাত সমুদ্র। আগ্রহীরা চাইলে পড়ে ফেলতে পার উপন্যাসটা) একটুখানি নেমে দেখি, প্রথম ২০০ মিটারের এ অংশ কেমন।

পানির মধ্য দিয়ে এ অংশে আলো ঢুকতে পারে। কাজেই এ অংশের উদ্ভিদদের মধ্যে ফটোসিনথেসিস হয়। নানা ধরনের ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন, বিভিন্ন ধরনের শৈবাল ও ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি অতিক্ষুদ্র জীবেরা সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রের বেশ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তাদের বেশির ভাগের বাস এ অংশে। এদের উৎপাদকও বলা হয়।

যেসব অতিক্ষুদ্র জীব সরাসরি সূর্যের আলো ব্যবহার করে খাদ্য তৈরি করতে পারে, তারাই উৎপাদক। তাদের চেয়ে খানিকটা বড় জীব এই ক্ষুদ্র জীবদের খেয়ে নেয়, তাদের আবার খায় অন্য বড় জীবেরা। জীবনের নিয়ম এটাই। এভাবেই বিভিন্ন ধরনের বড়-ছোট জীব মিলে গড়ে তোলে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা বা সিস্টেম। পরস্পর নির্ভরশীলতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এ ব্যবস্থাকেই সহজ করে বলা যায় বাস্তুতন্ত্র। (বাস্তুতন্ত্রের অজৈব উপাদানও থাকে। সমুদ্রের ক্ষেত্রে যেমন সমুদ্রের পানি। থাকে বিভিন্ন স্তরের খাদক। তবে এসব বিষয়, অর্থাৎ বাস্তুতন্ত্র আমাদের এ লেখার আলোচ্য বিষয় নয়। তাই এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা এ লেখায় করব না।)

সমুদ্রের এ স্তরকে তুলনা করা যায় আমাজন রেইনফরেস্টের সঙ্গে। বিভিন্ন ধরনের কোরাল, শৈবাল ও অন্যান্য সামুদ্রিক উদ্ভিদে ভরপুর এ অংশে বাস করে নানা ধরনের সামুদ্রিক জীব। চমৎকার এ অংশেই মূলত মানুষ সাঁতার কাটে, বিভিন্ন বর্জ্য ফেলে দূষিত করে, মাছ ধরে ইত্যাদি।

এবার এসো, আরেকটু নিচে নামা যাক। খানিকটা নামলে আমরা পেয়ে যাব কন্টিনেন্টাল শেলফ। বাংলা করলে দাঁড়ায়, মহাদেশীয় তাক। বাংলাটা ঠিক জুতসই না হলেও বোঝার জন্য ঠিক আছে। তাকের মতোই এ অংশ সমুদ্রের তীরবর্তী অংশের আপাত তলদেশ। আরেকটু নামলেই শুরু হবে কন্টিনেন্টাল স্লোপ বা মহাদেশীয় ঢাল। নাম শুনে বুঝতেই পারছ, এ অংশ ঢালু হয়ে নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে।

মোটামুটি ২৩০ মিটারের পর থেকেই শুরু হয়ে যাবে এ ঢাল। এ ঢাল ধরে যত এগোব, তত কমতে থাকবে আলোর পরিমাণ। একসময় প্রায় নাই হয়ে যাবে বলতে পারো। এখানে আর তেমন কোনো উদ্ভিদ নেই। দেখে মনে হবে, ঠিক যেন চাঁদের মাটির মতো শূন্য প্রান্তরে চলে এসেছি। অবশ্য, চারপাশে ঠিকই ঘিরে থাকবে সমুদ্রের নোনাপানি।

সাইফোনোফোরদের বর্ণিল কলোনি

কন্টিনেন্টাল স্লোপ পেছনে ফেলে আরেকটু এগোলেই পেয়ে যাব টোয়াইলাইট জোন। গহিন সমুদ্রের শুরুটাও এখানে। এখন আমরা আছি মোটামুটি ৩০০ মিটার নিচে। মাথার ওপর পানির অসহ্য চাপ। দুর্ধর্ষ এ কাল্পনিক ডুবোজাহাজের ভেতরে না থাকলে এ চাপে তুমি-আমি মরেই যাব প্রায়। বোঝার জন্য কিসের সঙ্গে তুলনা করা যায়? তোমার মনে হবে, মাথার ওপর দাঁড়িয়ে আছে ২০০টা গাড়ি! স্কুবা ডাইভ করে ডুবুরিরা সমুদ্রের গভীরে নেমে যান। এই স্কুবা ডাইভিংয়ের রেকর্ড হলো সর্বোচ্চ ৩৩২ মিটারের মতো। অথচ আমরা পুরো যাত্রার মাত্র ৩ শতাংশ নেমেছি এতক্ষণে।

৩০০-৬০০ মিটারের এ অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে আছে আবছায়া। অথচ অনেক সামুদ্রিক জীব জীবনের অর্ধেকটা সময় কাটায় সমুদ্রের এ অঞ্চলে। দিনের বেলায় প্রায় অন্ধকার এ অঞ্চলে বিশ্রাম নেয় তারা। লুকিয়ে থেকে জীবন বাঁচায় শিকারি জীবদের থেকে। রাত নেমে এলে আবছায়া যখন ঘুটঘুটে অন্ধকারে পরিণত হয়, তখন তারা ওপরের দিকে উঠে যায় খাবারের খোঁজে। কারণ, ওপরে তখন আর দিনের আলো নেই। অন্ধকারে তারা নিরাপদে খাবার খেয়ে নিতে পারে।

সে জন্যই এ অঞ্চলে আলো বড় গুরুত্বপূর্ণ এক উপাদান সব সামুদ্রিক জীবের জন্য। তাই এ অঞ্চলে বাস করা প্রায় ৯০ শতাংশ জীব বায়োলুমিনিসেন্স রাসায়নিক ব্যবহার করে তৈরি করে আলো। বায়োলুমিনিসেন্স মানে, কোনো জীবের নিজের ভেতরে উৎপাদিত আলো। এ আলো ব্যবহার করে সূর্যের আলোর মধ্যে আত্মগোপন করা যায়, সংকেত পাঠানো যায় অন্যদের কাছে, শিকারিদের বিভ্রান্তও করা যায় এ দিয়ে। আবার শিকারি জীবেরা আলো ব্যবহার করে শিকার করে।

এই গভীরে জীবনযাপনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান দলবদ্ধভাবে কাজ করা। প্রায় ৭০০ মিটার গভীরে নেমে গেলে দেখা যাবে, এর চমৎকার এক উদাহরণ—সাইফোনোফোরদের কলোনি। একের পর এক সাইফোনোফোর একসঙ্গে যুক্ত হয়ে তৈরি করে এ কলোনি। প্রস্থে খুব বেশি না হলেও লম্বায় এ কলোনি ৫০ মিটারের মতো হতে পারে। উজ্জ্বল নীল বা লালচে আলোয় আলোকিত হয়ে থাকে এটি। আর দুই পাশে বেরিয়ে থাকে তাদের বিষাক্ত কাঁটা। আলোয় আকর্ষিত হয়ে কেউ কাছে এলেই কাঁটা বিঁধে মারা যায়, পরিণত হয় সাইফোনোফোরদের খাবারে।

নীল জেলিফিশ, জ্বলজ্বল করছে বায়োলুমিনিসেন্সের কারণে

তবে এ অঞ্চলের বেশির ভাগ খুদে জীবের খাবার মেরিন স্নো। না, সত্যিকার তুষার নয় এগুলো। শামুক-ঝিনুক বা এ রকম প্রাণীর খোলস, বিভিন্ন মৃত জীবদেহের অংশবিশেষ, মৃত উদ্ভিদ বা প্ল্যাঙ্কটন, বালু ইত্যাদি নিয়মিতভাবে ঝরে পড়ে ওপর থেকে। সে জন্যই এর নাম মেরিন স্নো, ঝরে পড়া তুষারের মতো খাদ্য। এই মেরিন স্নো না হলে খাবারের অভাবে মারা পড়ত গভীর সমুদ্রের বেশির ভাগ জীব।

এক হাজার মিটারের ওপরের এ অঞ্চলে একটুখানি ঘুরে বেড়ালেই চোখে পড়বে স্পার্ম হোয়েলের সঙ্গে বিশাল আকৃতির স্কুইডের যুদ্ধ। স্পার্ম হোয়েল একধরনের বিশালাকৃতির দাঁতালো তিমি। ভয়ংকর শিকারি তারা। স্কুইড প্রচণ্ড লড়াই করে বটে, কিন্তু শেষমেশ খাদ্যে পরিণত হয় এই তিমির।

১ হাজার মিটার পেরিয়ে এলে আমরা প্রবেশ করব সমুদ্রের মিডনাইট জোনে। প্রায় ২ হাজার মিটারের মতো বিস্তৃত এ অঞ্চলের নাম শুনে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, নিঃসীম অন্ধকারের রাজত্ব এখানে। খাদ্যের বড় অভাব। তাই এ অঞ্চলে যারা বসবাস করে, তারা চেষ্টা করে শক্তি যথাসম্ভব কম খরচ করতে। যেমন, ৩০ সেন্টিমিটার লম্বা ভ্যাম্পায়ার স্কুইডদের কথাই ধরো। এরা পানিতে ভেসে থাকে, নড়াচড়া করেই না বলতে গেলে। শরীরের পেছনের অংশটা ফানেলের মুখের মতো করে খুলে রাখে। সক্রিয়ভাবে খাদ্য ধরলে যে শক্তি খরচ হতো, তা বাঁচানোর জন্যই এই ব্যবস্থা। বিভিন্ন উদ্ভিদ বা প্রাণীর মৃতদেহ কিংবা ছোট প্রাণীগুলো ভাসতে ভাসতে এই ফানেলের মুখের মতো অংশটি দিয়ে ঢুকে যায়। এভাবেই পেট ভরে নেয় ভ্যাম্পায়ার স্কুইড।

বিশাল স্কুইড

যেসব সামুদ্রিক জীব শুধু প্রাণী খায়, ইংরেজিতে তাদের বলে কার্নিভোরাস বা মাংসাশী। খাবার খুঁজে পেতে খুব সমস্যা হয় এদের। সে জন্য তাদের দেহে আছে লম্বা দাঁত, দীর্ঘ চোয়াল এবং আঁকশি। যেমন ধরো, ভাইপার মাছ। কোনো মাছ এদের দীর্ঘ চোয়ালের নাগালে এলেই হলো। চট করে চোয়ালটা বন্ধ করে আস্ত মাছটাকে গিলে নেয়! এদের চেয়ে দশ গুণ ভয়ংকর হাঙরেরা। ৩০০ ধারালো দাঁতবিশিষ্ট চোয়ালের মাঝে পুরে নেয় শিকারকে নির্মমভাবে। তীব্র গতি এবং ধারালো দাঁত—এই দুইয়ে নির্ভর করে এরা খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করে।

এসো, আবার নামা যাক। ৩ হাজার মিটারের মতো নামলে সমুদ্রের নতুন এক অঞ্চলে প্রবেশ করব আমরা। মজার একটা তথ্য দিই। টাইটানিকের কবর হয়েছিল এ রকম গভীরেই, ৩ হাজার ৮ মিটারের মতো গভীরতায়। এই অঞ্চলটির নাম অ্যাবিসাল ডেপথ। সহজ বাংলায় বলা যায়, সমুদ্রের গহিন গভীরতা। জীবন এখানে বড় ধীর। একবিন্দু শক্তির গুরুত্বও এখানে অপরিসীম। এ অঞ্চলের সব জীব প্রায় নিশ্চল বা অতিধীরভাবে চলাফেরা করে। কখনো শিকারের হাত থেকে বাঁচার জন্য ছুটতে হলেই কেবল জোরে ছোটে এ অঞ্চলের বাসিন্দারা। এখানেই বাস অক্টোপাস বা ইল মাছের।

আরও প্রায় ১ হাজার মিটারের মতো নেমে গেলে আবার দেখা পাব সমুদ্রতলের। অ্যাবিসাল ডেপথের তলদেশ, অ্যাবিসাল প্লেন। সমুদ্রের গহিন তল। ধূসর কাদামাটি, পাথর এবং মেরিন স্নো জমে থাকে এই তলে। চিংড়ি, বিভিন্ন সামুদ্রিক পোকা ইত্যাদি প্রাণীর বাস এখানে। জমাট মেরিন স্নো, কাদামাটি, মৃত জীবের দেহাবশেষই এদের খাদ্য। এই তলের কোথাও কোথাও পাওয়া যায় খনিজ পদার্থ। এগুলো মূলত জমাট ম্যাঙ্গানিজ, জমে জমে নুড়ির মতো হয়ে থাকে। সামুদ্রিক স্পঞ্জ, কোরাল ইত্যাদি উদ্ভিদ এদের ব্যবহার করে নিজেদের আটকে রাখে সমুদ্রতলের সঙ্গে। জীবনের পরিমাণ এখানে খুবই কম। তবু কিছু অঞ্চলে দেখা মেলে প্রাণের। ধু ধু মরুর মাঝে মরূদ্যানের মতো।

ভ্যাম্পায়ার স্কুইড

ধীরে ধীরে আরও নেমে গেলে দেখা পাব টেকটোনিক প্লেট বা মহাদেশীয় পাতের ভাঙা অংশের। দুটো মহাদেশীয় পাতের মাঝের এসব অংশে নিচ থেকে উঠে আসে গলিত ম্যাগমা। আগ্নেয়গিরির ভেতর থেকে যে জ্বলজ্বলে লালচে তরল বের হতে দেখা যায়, তা-ই ম্যাগমা। শীতল হতে হতে এই ম্যাগমা তাপ ছড়িয়ে দেয়, ফলে তৈরি হয় পানি ও খনিজের ঘূর্ণি। প্রায় ৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো উত্তপ্ত হতে পারে এসব ঘূর্ণি। এ ধরনের ভয়ংকর পরিবেশে বাঁচতে পারে বিশেষ ধরনের কিছু ব্যাকটেরিয়া। ইংরেজিতে তাদের বলে এক্সট্রিমোফাইল। অর্থাৎ ভয়ংকর পরিবেশে বাঁচতে পারে, এমন জীব। তারা এসব খনিজ ব্যবহার করে তৈরি করে নানা ধরনের জৈব পদার্থ। এভাবেই এ অংশে গড়ে ওঠে অন্য অংশগুলোর চেয়ে অনেকটা ভিন্ন, অনন্য এক বাস্তুতন্ত্র।

এখন যদি আরও নামি, ৬ হাজার মিটারের কাছাকাছি এসে পাব অ্যাবিসাল প্লেনের সবচেয়ে নিচু অংশ। সমুদ্রের বেশির ভাগ অংশে এটিই সর্বনিম্ন ভূমি। আর নিচে নামার উপায় নেই। কিন্তু সমুদ্রের আরও গভীরে, একদম তলদেশে যদি যেতে চাই, বলতে হবে আমরা আছি মাত্র অর্ধেক পথে!

এখন যদি টেকটোনিক প্লেটের ভাঙা অংশের পাশ ঘেঁষে, তুলনামূলক সরু খাদ ধরে নিচে নেমে যাই, তাহলে প্রবেশ করবে হেইডাল জোনে। এটাকে বলা যায় সমুদ্রের আন্ডারগ্রাউন্ড। সরু খাদ ধরে এগোতে হবে এখন। দীর্ঘ ও সরু এসব খাদ বা ট্রেঞ্চ গঠন করেছে সমুদ্রের মাত্র ০.২৫ শতাংশ। কিন্তু এদের বলা যায় পৃথিবীর সবচেয়ে এক্সট্রিম বা ভয়ংকর অঞ্চলের অন্যতম। এ রকম ভয়ংকর পরিবেশে শুধু এক্সট্রিমোফাইলরাই থাকতে পারে। যেমন, ইথারিয়াল স্নেলফিশ। সমুদ্রের সবচেয়ে গভীর অংশে বাস করার রেকর্ডও এদের দখলে। কত গভীরে? প্রায় ৮ হাজার মিটারের মতো নিচে!

আরেকটু নামা যাক এবার, নাকি? ১০ হাজার মিটার পেরিয়ে গেলে সামনে দেখা যাবে কালো, তীক্ষ্ণ সব পাথরের মাথা বেরিয়ে আছে। নামতে নামতে একসময় আমরা দেখা পাব ১.৬ কিলোমিটারের মতো প্রশস্ত ঢালু খাদের। এই খাদটি বিশাল মারিয়ানা ট্রেঞ্চের অংশ। তোমরা নিশ্চয়ই মারিয়ানা ট্রেঞ্চের নাম শুনেছ। সমুদ্রের গভীরতম অংশ হিসেবে এটি বিখ্যাত।

স্পার্ম হোয়েল

হ্যাঁ, চলে এসেছি আমরা সেখানে। সমুদ্রের গভীর গহিনতম তলে। সমুদ্রপৃষ্ঠের ১১ হাজার মিটার নিচে। এখানে পানির চাপ ১ হাজার ৮৬ বারের মতো। ১ বার মানে ১ লাখ প্যাসকেল! (আর, ১ প্যাসকেল মানে তোমরা নিশ্চয়ই জানো। ১ বর্গমিটার জায়গার ওপর ১ নিউটন চাপ দেওয়া হলে এর মান হয় ১ প্যাসকেল) এখন নিশ্চয়ই খানিকটা আন্দাজ করতে পারছ, কী প্রচণ্ড চাপ এখানে। মনে হবে, মাথার ওপর দাঁড়িয়ে আছে ১ হাজার ৮০০ পূর্ণবয়স্ক হাতি!

এই গহিনেও প্রাণ ঠিকই নিজের জায়গা খুঁজে নিয়েছে। চারদিকে তাকালেই দেখবে, সি কিউকাম্বার বা অ্যাম্ফিপডেরা ঠিকই ভেসে বেড়াচ্ছে চুপি চুপি। আকারেও এরা নিতান্ত ছোট নয়। প্রায় ৩০ সেন্টিমিটারের মতো বড় হতে পারে।

এসব প্রাণীর মতো আরও কিছু জিনিসও ভাসতে দেখবে তুমি চারপাশে। প্লাস্টিকের ব্যাগ, বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য। হ্যাঁ, সমুদ্রের এই গহিন গভীরেও দেখা পাওয়া যাবে মানুষের নির্মমতা, অবিবেচনা ও ধ্বংসযজ্ঞের পরিচয়। না, শুধু কথার কথা হিসেবে বলছি না। ২০১৮ সালে বিজ্ঞানীরা মারিয়ানা ট্রেঞ্চের তলদেশে আসলেই পেয়েছেন এসব বর্জ্য।

আর কিছু করার নেই। এতক্ষণে আমাদের দুর্ধর্ষ ডুবোযানটিতে জমিয়ে রাখা অক্সিজেনও শেষ হয়ে এসেছে প্রায়। তাহলে চলো, এবার ফেরা যাক!

ফিরতে ফিরতে আসো ভাবি, এই পৃথিবীটাকে এভাবে ময়লা ফেলে ফেলে আমরা ধ্বংস করে দেব না। চেষ্টা করব নদী বা সমুদ্রের নিচের আমাদের বন্ধু প্রাণীগুলোর কথা ভাবতে। একটাই পৃথিবী আমাদের। জল-স্থলের সব প্রাণ নিয়েই এই পৃথিবী। আমরা যদি এর যত্ন না নিই, তাহলে পৃথিবীটার খেয়াল আর কে রাখবে, বলো?

সূত্র: কুটজেগার্ট ইউটিউব চ্যানেল, ব্রিটানিকা, উইকিপিডিয়া; হাউ ডিড উই ফাইন্ড আউট অ্যাবাউট লাইফ ইন ডিপ সি, আইজ্যাক আসিমভ