সাইকেলে চেপে বিশ্বভ্রমণ

রুমের কোনায় সাজিয়ে রাখা সাইকেলটা নিয়ে তুমি কত দূর যেতে পারো? স্কুল, বাজার, পাশের এলাকা? খুব বেশি হলে দূরের একটি শহরে? কিন্তু এই সাইকেলে চড়েই গোটা বিশ্বের অ্যাডভেঞ্চার উপভোগ করতে বেরিয়ে পড়েছেন অনেকে। ইতিহাসে এমন ভ্রমণপিপাসু বাঙালির নাম কিন্তু কম নয়। আজ তাহলে শোনা যাক তেমন–ই একজন বাঙালির গল্প, যিনি গোটা বিশ্বকে বশে এনেছিলেন প্যাডেলের চাপে, দুই চাকার ঘূর্ণিতে।

১৮৯৪ সাল। ভারতের আসামের বানিয়াচং গ্রাম। যা এখন বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার অন্তর্ভূক্ত। বাবা বিরজানাথ বিশ্বাস আর মা গুণময়ী দেবীর কোল আলো করে জন্মালেন একমাত্র পুত্র রামনাথ বিশ্বাস। পরিবারের অভাব–অনটনের মধ্যে দৈনিক দুমুঠো খাবার জোটানোই বেশ কঠিন বিরজানাথের জন্য। তবু ছেলেকে বানিয়াচংয়ের হরিশ্চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করাতে পেরেছিলেন তিনি।

অভাবের এই সংসারে বাবার জীবনাবসান ঘটলে পড়াশোনার ইতি ঘটিয়ে হবিগঞ্জের জাতীয় ভান্ডার সমিতির ম্যানেজার পদে যোগ দেন তিনি। সেখানে কাজ করতে গিয়ে মোটর চালানোর সুযোগ হয়। আর এরপরই একদিন হাতে পান সাইকেল। দুই চাকা, ব্রেক আর চেইনের অপরূপ এই যানবাহনই রামনাথের সেরা শখে পরিণত হয়। চালাতে চালাতে সেটার খুঁটিনাটিও সেরে নিতে শিখে নেন তিনি।

এরপর শুরু হয়ে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। সবার সঙ্গে রামনাথও যোগ দেন এই যুদ্ধে। বাঙালি পল্টনের সঙ্গে তিনি মেসোপটেমিয়ায় যান। সেখানে ১৯২৪ সালে তিনি মালয়ে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর একটি চাকরিতে যোগ দেন। যুদ্ধের ভয়াবহতা আর নতুন সময়ের বিপ্লব দেখে তিনি বুঝতে পারেন যে এখনো গোটা বিশ্বের অনেক কিছু দেখা বাকি তাঁর।

সব ভেবেচিন্তে, ১৯৩১ সালের দিকে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন রামনাথ। সঙ্গে একজোড়া চটি, চাদর আর সেই প্রিয় সাইকেল। নিজের জন্য আর কিছু না নিলেও সাইকেলের মেরামতের জন্য নিয়ে নিলেন সাইকেল টুল–বক্স। প্রিয় সাইকেলটার গায়ে লিখে নিলেন ‘রাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড, হিন্দু ট্রাভেলার’। ৭ জুলাই সিঙ্গাপুরের কুইন স্ট্রিট থেকে এই বিশ্বযাত্রা শুরু করেন রামনাথ বিশ্বাস। শহরের পরিচিত সবাই সেদিন সাধুবাদ জানাতে এসেছিল ভ্রমণপিপাসু এই মানুষটিকে। সাইকেলে চেপে রামনাথ একে একে ঘুরে বেড়ান মালয়, শ্যাম, ইন্দোচীন, চীন, কোরিয়া, জাপান। সবশেষে কানাডা হয়ে নিজ জন্মভূমিতে ফিরে আসেন তিনি। তিন বছর সাইকেলে চড়ে এমন ভ্রমণ শেষে গ্রামে ফিরতেই অজস্র মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হন রামনাথ বিশ্বাস। তখনকার ঐতিহাসিক এড়ালিয়া মাঠে এক বিশাল সংবর্ধনার আয়োজন করা হয় তাঁর সম্মানে। সেখানে তাঁর বিশ্বভ্রমণের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি নিজের জন্মভূমিকেই বৃহত্তম গ্রামের পরিচয় দেন।

যাত্রাপথে চলতে গিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে রামনাথ জানতে চেষ্টা করতেন ওই দেশের ইতিহাস ও সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে। তিনি যখন কোরিয়া ভ্রমণ করেছিলেন, তখন সেখানে জাপানের শাসন চলছে। তাই ভ্রমণ শেষে ফিরে এসে নিজের ভ্রমণকাহিনি প্রকাশের উদ্যোগ নেন রামনাথ।

তবে সামান্য এই কয়েকটা দেশ ঘুরে যেন মন ভরে না রামনাথ বিশ্বাসের। কয়েক মাস পেরোতেই নিজের সাইকেলটা নিয়ে আবার বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন তিনি। এবার যাত্রা শুরু হয় আফগানিস্তান থেকে। একে একে পারস্য, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, তুরস্ক, বুলগেরিয়া, যুগোস্লাভিয়া, হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, জার্মানি, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স হয়ে তিনি ব্রিটেন পৌঁছান। এবারের যাত্রাপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তবু নিজের মনোবল অটুট রেখে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ডও তিনি সাইকেলে পরিভ্রমণ করেন। এবার দুই বছরের মাথায় লন্ডন থেকে জাহাজে মুম্বাই ফিরে আসেন তিনি। এরপর কিছুটা সুস্থ হয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে যান রামনাথ বিশ্বাস। বিশ্বের নানা জায়গায় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা জমিয়ে নতুন মানুষ হয়ে ওঠেন রামনাথ।

তবে বিশ্বের আরও কিছু দেশ দেখার বাসনা যেন তখনো জেঁকে বসেছিল রামনাথের মনে। সাইকেলের প্যাডেল টেনে দেশের পর দেশ আর নতুন মানুষের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করে যেন এক নতুন দুনিয়ার খোঁজ পেয়েছিলেন তিনি। রোমাঞ্চকর এই অনুভূতি উপভোগ করতে তিনি বারবার সাইকেলে চেপে বেরিয়ে পড়েছেন অ্যাডভেঞ্চারের নেশায়। ১৯৩৮ সালের দিকে আবার সব গুছিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়েন অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে। এবার তাঁর যাত্রা শুরু হয় আফ্রিকা মহাদেশের দিকে। মুম্বাই থেকে জাহাজে মোম্বাসায় পৌঁছান তিনি। সেখান থেকেই বাকিটা পথ তাঁর শুরু হয় সাইকেলে চেপে। কেনিয়া, উগান্ডা, নায়াসাল্যান্ড, রোডেসিয়া হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছান রামনাথ বিশ্বাস। ভারতীয় এক ভ্রমণপিপাসু বাঙালি এভাবে সাইকেলে চেপে গোটা বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন শুনে অনেকেই আলাপ জমাতে আসেন তাঁর সঙ্গে। আফ্রিকার পথে–প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে তিনি হিয়ে হাজির হন যুক্তরাষ্ট্র। সেখান থেকেই আবার নিজের জন্মভূমিতে ফিরে আসেন তিনি। ১৯৪০ সালে সাইকেলে চেপে বিশ্বভ্রমণের এই বিশাল যাত্রার সমাপ্তি ঘটে রামনাথ বিশ্বাসের।

যাত্রাপথে চলতে গিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে রামনাথ জানতে চেষ্টা করতেন ওই দেশের ইতিহাস ও সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে। তিনি যখন কোরিয়া ভ্রমণ করেছিলেন, তখন সেখানে জাপানের শাসন চলছে। তাই ভ্রমণ শেষে ফিরে এসে নিজের ভ্রমণকাহিনি প্রকাশের উদ্যোগ নেন রামনাথ। কিন্তু কোনো প্রকাশক তাঁর এই লেখা প্রকাশে আগ্রহ দেখায়নি। তাই নিজেই পর্যটক প্রকাশনা ভবন নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা খুলে নিজের বই প্রকাশ করতে শুরু করেন। নিজের শেষ জীবনে কলকাতায় থাকাকালীন আনন্দবাজার পত্রিকায় তার এই ভ্রমণকাহিনিগুলো প্রকাশিত হতে থাকে। এ ছাড়া এগুলো বই আকারেও বাজারে আসে। কলকাতায় বসবাসকালে রামনাথের ভ্রমণকাহিনি আনন্দবাজার পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতো। পরে তা গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয়। তার রচিত গ্রন্থের সংখ্যা তিরিশের ওপর। এগুলো মধ্যে রয়েছে: অন্ধকারের আফ্রিকা, আজকের আমেরিকা, জুজুৎসু জাপান প্রভৃতি। তাঁর লেখা উপন্যাস আগুনের আলো বেশ কয়েকটি মহাদেশের প্রেক্ষাপটে লেখা হয়েছে। উত্তর আমেরিকায় গল্প শুরু হয়ে ব্রিটেন হয়ে এশিয়ার মালয়ে এসে কাহিনি শেষ হয়েছে।

সে যা–ই হোক, সাইকেলে চেপে এই সারা বিশ্ব ঘুরে দেখতে গিয়ে বাঙালিকে এক নতুন সম্ভাবনায় পৌঁছে দিয়েছিলেন রামনাথ বিশ্বাস। গ্রামের মেঠো পথে খঁটখঁটিয়ে চালানো সাইকেলের চাকাকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন আফ্রিকার গহিন জঙ্গলের পথে। রোমাঞ্চকর এসব অভিযান সম্পর্কে জানতে পড়ে ফেলতে পারো তাঁর বইগুলো। আর নিজেও সাইকেলে ঘুরে আসতে পারো দূরের কোনো শহরে, কোনো নতুন অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে।