সাইফুল হরিণ ও সর্বনাশা আইলার গল্প

‘স্যার হরিণ দেখবেন? হরিণ?’ ঊর্ধ্বশ্বাসে আমাদের মোটরসাইকেলের পেছনে ছুটছে আর চিৎকার করে বলছে একটি ছেলে। আমরা তখন নিঝুম দ্বীপের হরিণ অভয়ারণ্যের কাছাকাছি।

২০০৯-এর ৭ জানুয়ারি, শীতের সূর্য তখন পশ্চিমে হেলতে শুরু করেছে। পাতাহীন বিবর্ণ গাছের মধ্যে ঝুপড়ি বসতি দেখতে দেখতে আর বনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করতে করতে কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমি এবং আশরাফ, হাতিয়ার একটি সংস্থার উন্নয়নকর্মী, পৌঁছে গেছি বহুল প্রতীক্ষিত, দেশের সর্বদক্ষিণের পলল দ্বীপের আকর্ষণীয় স্থানটিতে।

বনের কিনারে মোটরসাইকেল রেখে ভেতরে কিছুদূর যেতেই দেখলাম সেই ছেলেটি। সোৎসাহে আমাদের দিকে আসছে। তখন থেকে দৌড়াচ্ছে আমাদের পেছনে! কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘স্যার হরিণ দেখবেন? আমি দেখাব।’

‘তুই কীভাবে দেখাবি’, আশরাফ বলল, ‘যা আমরা নিজেরাই পারব।’

ছেলেটি হাল ছাড়ল না। নানাভাবে আমাদের সঙ্গী হতে চেষ্টা করতে লাগল। কীভাবে আগন্তুককে বোঝাতে হয় তা ৯-১০ বছরের জীবনেই রপ্ত করে ফেলেছে ও। হরিণের গতিবিধিও ওর নখদর্পণে।

‘স্যার দুরপে ইহানে হরিণ থানা—হরিণ দেখতে অইলে উহানে যাইতে অইর,’ আঙুল দিয়ে দেখাল।

ওর বুদ্ধিদীপ্ত মুখ আর কথার জাদুতে মুগ্ধ হতে সময় লাগল না।

‘ঠিক আছে, চল, দেখা আমাদের হরিণ’ বললাম আমি।

এই কথায় সাইফুল, মানে আমাদের খুদে গাইড, মহাখুশি। আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল ও। আমরা ওকে অনুসরণ করে শ্বাসমূলের হাত থেকে পা বাঁচিয়ে এগিয়ে চললাম বনের গহ্বরে।

‘শি-স-স’, হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে মুখে তর্জনী ঠেকিয়ে শব্দ করতে বারণ করল আমাদের। গলা নিচু করে বলল ‘ঐত্য দে যা!’

প্রথমে একটি, ভালো করে খেয়াল করতে দুটি, এরপর তিনটি, এমন করে অনেকগুলো হরিণ গোচরে এল। গোটা একটি হরিণের পাল! ছোট, বড়, মাঝারি—চঞ্চল, কৌতূহলী, নির্ভীক অনেক ধরনের হরিণ! বিমুগ্ধ আমরা। এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আগে দেখিনি। ফ্রেমবন্দী করলাম দৃশ্য। একটু অগ্রবর্তী হতেই কী ভেবে একটি হরিণ ভোঁ-দৌড়। দেখাদেখি অন্যগুলোও।

‘স্যার আরেক কানা খান, আরও ম্যালা দেখামু। ওরা হানি খাইত আইব,’ বলল সাইফুল।

ওরা পানি খেতে কোথায় আসে? প্রশ্ন করতেই সাইফুল জানাল ‘ওই দিকে, প্রজেক্টে’। প্রজেক্ট মানে পুকুর ওর ব্যাখ্যায় পষ্ট হলো।

পুকুরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে সাইফুলের পারিবারিক তথ্য জানতে চাইলাম। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সাইফুল দ্বিতীয়। ওর বড় এক বোন। বাকি তিনজনের একজন ভাই, অন্য দুজন বোন।

‘তোমার বাবা কী করেন?’ আশরাফের এই প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গেই আবার ‘শি-স-স’। তাকিয়ে দেখলাম হরিণেরা কুয়োমতো দেখতে, প্রায় শুকিয়ে যাওয়া পুকুরের কালো পানি পানে মগ্ন। আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে এবারও পড়িমরি দৌড়।

এবার আমার ঝোঁক পুকুরের দিকে। শুনেছি হরিণের পানিসংকট নিরসনে এ রকম কয়েকটি পুকুর খনন করা হয়েছে এই কৃত্রিম বনে। এই পুকুরগুলোতে জমে থাকা বৃষ্টির পানি খেয়ে বেঁচে থাকে এই হরিণকুল। কিন্তু এই তার হাল! গাছের পাতা পড়ে পানি পচে কুচকুচে কালো রং ধারণ করেছে। ‘এর থেকে ভালো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় না?’ নিজেকেই প্রশ্ন করলাম।

পুকুরের পাড়ে এখানে-ওখানে হাড়গোড় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। ‘এগুলো হরিণের’ জানাল সাইফুল। হঠাৎ দেখি শিকারির মতো সন্তর্পণে ঝোপের আড়ালে হাঁটাহাঁটি করছে বাদামি রঙের এক তাগড়া কুকুর। যেন বাঘের খুদে সংস্করণ।

‘দ্যাকছেন স্যার কী মোডা? হরিণ খায়া এমুন অইছে। আমরা না খায়া কেমুন কাহিল অইয়া গেছি, আর অগোর গায় কী তেল!’ আমি কী ভেবে উদোম গায়ের হাড় জিরজিরে সাইফুলকে দেখলাম।

আশরাফ তার জবাব না পাওয়া প্রশ্নটি আবার করল। এবার সাইফুল মনোযোগ দেয়।

‘স্যার আর বাবা আছে, আবার নাইও ধরতে পারেন। আরেকটা মহিলারে বিয়া করইয়া আমাগোর লগে থাহে না।’

পরের প্রশ্নটি করতে হলো না। সাইফুল বলল, ‘আমি এই হানে হারা দিন হুকনা লাকড়ি টোকাই। আর মাথাত করি বাজারে নিয়া বেচি। এ ছাড়া আমনেগো মতন লোক যহন এহানে আইয়ে তাদের হরিণ দেহাই। তারা খুশি অইয়া টিয়া দেয়।’

লাকড়ি বেচে তুমি দিনে কত টাকা পাও?

‘কত, এই ধরেন ১০-১৫ টিয়া। এহানে লাকড়ি খুবই হস্তা। ওচখালি বাজারে অইলে বেচলে ৩০-৪০ টিয়া পাইতাম।’

‘আর বাইরের মানুষদের হরিণ দেখিয়ে কত পাও?’

‘খুশি অইয়া যে যা দেয় তা-ই নিই। মনে করেন কেউ দিল ৫ টিয়া; আবার কেউ কেউ ৫০ টিয়া পর্যন্ত দেয়। তয় পত্যেক দিন মানুষ ধরতে পারি না।’

‘এই দিয়ে তোমার সংসার চলে?’

‘স্যার আমরা খায়া না খায়া থাহি। আইজকার কথাই ধরেন, সহালে এক মুট পান্তা খাইছি। আর কিছুই খাই নাই।’

‘বলো কী? এখন তো বিকেল চারটা!’

‘আমাগোর এভাবেই চলে। আর রাইতে খামু। খালি ভাত আর মরিচ পোড়া। অনেক মজা।’

‘তোমার মা বইন কী করে?’

‘মাইনষের বাড়ি এটা-সেটা করে দেয়। খুশি অইয়া কিছু খাইতে দেয়। সেগুলো বাড়ি এনে ভাগাভাগি করে খাই। আবার খেতে-খামারেও কাজ করে। যখন যা পায় তাই করে।’

সাইফুলের এই উপাখ্যান বিরল নয়। শুধু নিঝুম দ্বীপ কেন, দেশের আনাচকানাচে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে এমন বেশুমার সম্ভাবনাময় সাইফুল। যারা পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক আর প্রাকৃতিক দুর্যোগকে সঙ্গী করে বেঁচে থাকে।

যাহোক হরিণ আর নিঝুম দ্বীপের সৌন্দর্য দেখা শেষে আমরা বিকেল পাঁচটা নাগাদ সাইফুলের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। বকশিশ হিসেবে যা পেল মনে হলো খুশি। শেষ বিকেলের সোনালি আলোয় ভোঁ ভোঁ শব্দে মোটরসাইকেল দাবড়ে আমাদের গন্তব্যের পথে ফিরতে শুরু করলাম। পেছনে পড়ে রইল ‘ফুলের মতো’ সাইফুল আর ‘মানচিত্রের টিপ’ নিঝুম দ্বীপ।

এ গল্পটি লেখা হতো না। যদি না আশরাফ আমাকে নিচের গল্পটি বলত। সত্যি বলতে কি, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।

নিঝুম দ্বীপ দেখা মেলে এমন চিত্রল হরিণদের
ছবি: জুনায়েদ আজিম চৌধুরী

২৫ মে ২০০৯। আমাদের ভ্রমণের ঠিক সাড়ে তিন মাস পরের ঘটনা। এক ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এল নিঝুম দ্বীপবাসীর জীবনে।

প্রতিদিনের মতো সাইফুল লাকড়ি কুড়াতে যায় বনের ভেতর। লাকড়ি বিক্রি করে চাল কিনে তবেই ফিরবে—রুটিন অনুযায়ী তা-ই হওয়ার কথা। কিন্তু ঘটল অন্য কিছু।

সাইফুল বা নিঝুম দ্বীপবাসী সকালের সূর্য দেখে মালুম করতে পারেনি দুপুরে কী ঘটতে যাচ্ছে তাদের জীবনে। যদিও ঘূর্ণিঝড়ের সিগন্যাল নম্বর ৬ চলছিল। কিন্তু সবার মধ্যে যেন একটা গা ছাড়া ভাব। এ আর নতুন কী? বছরে এমন সিগন্যাল অনেকবার ওঠে। সিগন্যাল ফ্ল্যাগ ওঠানো হলো। মাইকে সবাইকে সতর্ক করা হলো। দুপুরের দিকে যখন বাতাস বইতে শুরু করল অনেকে তখনো আমলে নিল না। কেননা সিগন্যাল নম্বর মাত্র ৬! কেউ কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে এল। কিছু হবে না ভেবে এল না অনেকেই।

তখন বেলা আনুমানিক একটা। এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেল বাতাসের প্রলয়নৃত্য। জোয়ার থাকায় ভয়ংকর হয়ে উঠল জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা। ফুঁসে ওঠা নীল দরিয়া ফণা তোলা সাপের মতো ছোবল মারতে শুরু করল। নিঝুম দ্বীপের নিস্তব্ধতা ভেঙে হলো খান খান। চারদিকে ভয়ার্ত মানুষের আর্তচিৎকার। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে সবার ছোটাছুটি। জীবন বাঁচানোর প্রাণপণ লড়াই। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না অনেকেরই। মায়ের হাত থেকে হারিয়ে গেল প্রিয় সন্তান। নিজের জীবন বাঁচাতে বৃদ্ধ মায়ের হাত ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো জোয়ান ছেলে। গরু-মহিষ, গাছপালার সঙ্গে ভেসে গেল অনেক মানুষ।

সাইফুলের পরিবারের অন্য সবাই কোনোমতে আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়ে জীবন বাঁচাল। কিন্তু সাইফুল? সে কোথায়? ওর মা-বোন এখানে-ওখানে খোঁজে পাগলের মতো। ব্যাকুল হয়ে একে জিজ্ঞেস করে, ওকে জিজ্ঞেস করে, ‘সাইফুলকে দেখেছ?’

উত্তর একটাই, কেউ দেখেনি। সাইফুল কোথাও নেই।

অবশেষে খবর মিলল ২৬ মে। আইলার কাছে পরাস্ত হয়েছে লড়াকু সাইফুল। নিজের চেনা জগতে, প্রিয় হরিণদের সঙ্গে ‘শহীদ’ হয়েছে সে। বনের ভেতর গাছের ডালে আটকে থাকা হাড় জিরজিরে ছোট্ট সাইফুলের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।

অতটুকু একটি ছেলে যে অচেনা আগন্তুকদের পথ দেখাত, সুযোগ করে দিত সৌন্দর্য উপভোগ করার। তার এ পরিণতি! ভাবলে আজও কষ্টেরা বুকে মোচড় দেয়।

ফুল হয়ে ফুটে ওঠার আগে কুঁড়িতে ঝরে যায় অনেক সাইফুল। আমরা কিছু করতে পারি না। গলদ কোথায়? সাইফুল চলে গেছে। আর কোনো দিন আমাদের মতো আগন্তুকদের পেছনে ছুটবে না। বলবে না, ‘স্যার হরিণ দেখবেন? হরিণ?’

  • লেখক: টিম লিডার, কেয়ার বাংলাদেশ

(কিশোর আলোর জুন ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত)