সাকিয়ার চোখে বাংলাদেশ

তখন ঢাকা মেডিকেলে তৃতীয় বর্ষে পড়েন সাকিয়া হক। কমিউনিটি মেডিসিনের মৌখিক পরীক্ষায় পরীক্ষক জানতে চাইলেন, ‘বলো তো, ম্যালেরিয়া কোথায় বেশি হয়?’

তিনি জবাব দিলেন, ‘বান্দরবান।’

পরীক্ষক আবার প্রশ্ন করলেন, ‘বান্দরবান কোন দিকে?’

তিনি আমতা আমতা করে জবাব দিলেন, ‘উত্তর দিকে।’

পরীক্ষক রেগেমেগে বেরই করে দিলেন তাঁকে। বাংলাদেশ সম্পর্কে জ্ঞান শূন্য-এসব বলে বন্ধুরা খ্যাপাতে শুরু করল। সাকিয়া বেশ লজ্জা পেলেন, আসলেই ঢাকা আর জন্মভূমি খুলনার বাইরে তেমন কোথাও যাওয়া হয়নি তাঁর। বাড়ি ফিরে বসলেন দেশের মানচিত্র নিয়ে। দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, নানান জেলা–উপজেলা সম্পর্কে জানতে শুরু করলেন। যতই জানলেন, ততই আগ্রহ বাড়ল নিজ চোখে সব দেখার। একরকম ঝোঁকের বশেই প্রতিজ্ঞা করে বসলেন, দেশের সব কটি জেলা ঘুরে দেখবেন তিনি।

কিন্তু ৬৪ জেলা ঘুরে দেখা কি মুখের কথা? মা–বাবার আদরের একমাত্র মেয়ে সাকিয়া। ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে ছিল পড়ালেখার ব্যাপারে ভীষণ কড়াকড়ি। মাকে খুব ভয় পেতেন তিনি, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বেড়াতে যাওয়ার কথা কখনো মুখ ফুটে বলতে পারেননি। রক্ষণশীল পরিবার হওয়ার কারণে পুরুষ বন্ধু আছে, এমন দলের সঙ্গে দূরে বেড়াতে যাওয়া ছিল বারণ। কিন্তু মেডিকেলের পড়াশোনার চাপ আর ব্যস্ততার কারণে কোনো বান্ধবীই রাজি হলো না সঙ্গে যেতে। তাই শেষমেশ সাহস করে একদিন বেরিয়ে পড়লেন একাই, সেই থেকে শুরু। পড়াশোনার প্রচণ্ড চাপের মধ্যেও ছুটি পেলেই বেরিয়ে পড়তেন দেশের আনাচকানাচে বিভিন্ন প্রান্তে। ধীরে ধীরে ফেসবুকের বিভিন্ন ট্রাভেল গ্রুপের সঙ্গেও ঘুরতে শুরু করেন তিনি। ইভেন্ট দেখলেই বেশি ভাবনাচিন্তা না করে গুছিয়ে ফেলতেন ব্যাকপ্যাক।

এভাবে বেশ কিছু জেলা ঘুরে দেখার পর ২০১৬ সালে তিনি বিভিন্ন দেশের মেয়েদের নিয়ে গঠিত এক ট্রাভেল গ্রুপে পোস্ট দেন, গ্রুপের সদস্যদের আহ্বান জানান বাংলাদেশ ঘুরে দেখতে, সঙ্গে জুড়ে দেন দেশের চমৎকার কিছু ছবি। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুইজারল্যান্ডের এক নারী সত্যি সত্যি পাড়ি জমান বাংলাদেশে। তাঁকে নিয়ে সুন্দরবন, কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে দেখেন সাকিয়া। সেই সুইস নারী ফেরত চলে যাওয়ার পরও থেমে থাকেনি তাঁর পথচলা। সাজেক, নাফাখুম, কেওক্রাডং ইত্যাদি দর্শনীয় স্থান তো বটেই, চাঁপাইনবাবগঞ্জ বা মাগুরার মতো জেলাও বাদ গেল না তাঁর তালিকা থেকে। একপর্যায়ে তাঁর সঙ্গে যোগ দেন ছোটবেলার বান্ধবী মানসী সাহা, স্কুল–কলেজ একসঙ্গে পড়ার পর মেডিকেলেও পড়ছিলেন একসঙ্গেই। দুই বান্ধবীর জুটি দেখে বাড়ি থেকে এরপর আর আপত্তি রইল না, যখন যাঁকে পেতেন, তাঁকে সঙ্গে নিয়েই এরপর থেকে বেরিয়ে পড়তেন দুজনে। চলে যেতেন বান্দরবানের একদম গহিনে কিংবা রাঙামাটিতে পাহাড়ের ওপর, মারমা পাড়ায়। যাওয়ার আগে প্রতি জেলায় পরিচিত মানুষ খুঁজে বের করতেন তাঁরা। যত ঘুরতেন, তত নিত্যনতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হতো, পরের ভ্রমণগুলো হতো আরও সহজ।

দেশ সম্পর্কে ধারণা বদলাতে শুরু করল সাকিয়ার। আগে ভাবতেন, নির্দিষ্ট কিছু স্থান ছাড়া দেশে ঘুরে দেখার মতো জায়গা নেই। ধীরে ধীরে আবিষ্কার করলেন, প্রতিটি জেলাতেই দেখার মতো কিছু না কিছু আছে, সেই সঙ্গে আছে নিজ নিজ স্থানীয় ঐতিহ্য। আর যদিও বাংলাদেশে একা চলাফেরা করা মেয়েদের জন্য অতটা নিরাপদ নয়, তবে আত্মবিশ্বাস থাকলে আর পর্যাপ্ত সাবধানতা অবলম্বন করলে মেয়ে হয়েও ঘুরে দেখা সম্ভব দেশের যেকোনো প্রান্ত। এই ভাবনা থেকেই ২০১৬ সালের ২৭ নভেম্বরে খুললেন শুধু মেয়ে ভ্রমণকারীদের জন্য ফেসবুক গ্রুপ ‘ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ’। এই গ্রুপের সদস্যসংখ্যা এখন প্রায় ২৭ হাজার। ভ্রমণে গিয়ে থাকা–খাওয়া থেকে শুরু করে গাইড ম্যানেজ করা—সব ব্যাপারে সাকিয়া ও তাঁর বন্ধুরা সাহায্য করেন এই গ্রুপের সদস্যদের।

প্রায় ৩৫টি জেলা ভ্রমণ শেষে ২০১৭ সালে বান্ধবী মানসী সাহাকে সঙ্গে নিয়ে শুরু করলেন নারী ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্যে নতুন এক প্রজেক্ট। নাম দিলেন ‘নারীর চোখে বাংলাদেশ’। দুটি বাইক নিয়ে বিভিন্ন জেলায় যান তাঁরা, প্রতি জেলার অন্তত একটি স্কুলের মেয়েদের সঙ্গে কথা বলেন মুক্তিযুদ্ধ ও বয়ঃসন্ধিকালের সমস্যা নিয়ে, সেই সঙ্গে শেখান আত্মরক্ষার কৌশল। এভাবে ২০১৮ সালে সাকিয়ার ভ্রমণ করা জেলার সংখ্যা বেড়ে হলো ৫৩। এরপর ২০১৯ সালের ১২ জানুয়ারি থেকে ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা ১৭টি জেলা ভ্রমণ করার পর এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াল ৬৩–তে। সবশেষে ১৯ মার্চ ৬৪তম জেলা হিসেবে কিশোরগঞ্জে পা রেখে সব কটি জেলা ঘুরে দেখার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করলেন সাকিয়া হক।

প্রতিটি জেলা নিয়েই সাকিয়ার ঝুলিতে জমেছে অসংখ্য গল্প। তবে তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মনে হয়েছে সাধারণ মানুষের অতিথিপরায়ণতা। কিশোরগঞ্জ গিয়ে এক বেলাও নিজের খরচে খেতে হয়নি, কারও না কারও বাড়িতে দাওয়াত ছিলই। নওগাঁয় রীতিমতো পিঠাপুলির আয়োজন করে তাঁদের বরণ করে নিয়েছে স্থানীয় মানুষ। খুলনায় অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য জমেছিল বিশাল ভিড়। এমনকি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পা ছুঁয়ে সালাম করেছে একজন! তবে অপ্রীতিকর ঘটনারও মুখোমুখি হতে হয়েছে কয়েকবার। নানান মানুষের নানান মন্তব্য, ইভ টিজিং ইত্যাদিতে কখনো দমে যাননি তিনি। একবার নিঝুম দ্বীপে অনুমতি ছাড়া তাঁদের ভিডিও করছিল এক উটকো লোক, তাকে সোজা তুলে দিয়েছিলেন পুলিশের হাতে। তবে ঘুরেফিরে ভ্রমণের ইতিবাচক দিকগুলোই বারবার বললেন, জানালেন আবারও যেতে চান অনেক জেলায়, ঘুরে দেখতে চান আরও ভালোভাবে।

দেশের বাইরেও ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, নেপালসহ মোট আটটি দেশ ঘুরে দেখেছেন সাকিয়া। তবে আপাতত তিনি চান নিজের কর্মজীবনে মনোযোগ দিতে, পাশাপাশি তাঁর লক্ষ্য বাইকে চড়ে দেশের পুরো ৬৪ জেলায় ‘নারীর চোখে বাংলাদেশ’ প্রজেক্টকে পৌঁছে দেওয়া। সেই লক্ষ্যও যে অচিরেই পূরণ হতে চলেছে, তা নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না!