সামনের দিনগুলোয় কী করব?

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

আমরা ২০২০ সালের মার্চ থেকে গৃহবন্দী। করোনা আমাদের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে। স্কুল-কলেজ বন্ধ। ঘরে বসে থাকতে থাকতে কোমরে খিল পড়ে যাচ্ছে! কী করা যায়!

আমার আশা, আমার প্রার্থনা, আগামী দু–তিন মাসের মধ্যে পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হবে। তারপর স্কুল-কলেজ খুলেও দেওয়া হতে পারে।

কিন্তু একটা জিনিস ঠিক। আগের মতো আমরা আর যা খুশি তা–ই করতে পারব না। আমরা নিউ নরমাল একটা জীবন পাব।

সামনের দিনগুলোয় আমরা কী করব?

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলব

  • আমরা সবাই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখব। মানে একজন আরেকজনের কাছ থেকে ছয় ফুট দূরে থাকার চেষ্টা করব।

  • ঘরের বাইরে গেলে মাস্ক পরব। বাড়িতে বানানো সুতির মাস্ক হলেও পরতে হবে। বাইরে থেকে ঘরে এসেই সেটা সাবান-পানি দিয়ে ধুতে দেব।

  • হাত ধোব। সাবান–পানি দিয়ে ভালোভাবে বিশ সেকেন্ড ধরে বারবার হাত ধোব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হাত ধোয়ার পদ্ধতি মেনে চলব।

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

থাকব এবার ঘরে

‘থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে’—কথাটা আপাতত মাথায় আনা যাবে না। আমাদের অনেক বেশি ঘরে থাকতে হবে। সে জন্য আমাদের অনেক পড়াশোনা, কাজকর্ম এখন ইন্টারনেটভিত্তিক হয়ে যাবে।

আগে যেমন একটা মিটিং করতে সবাই একটা অফিসের মিটিং রুমে সমবেত হতো। এখন সেটা সবাই নিজ নিজ বাসায় বসেই ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সেরে ফেলে। লেখাপড়ার ব্যাপারেও সেটা হবে। অনেক ক্লাস হয়তো ভিডিওতে সারা হবে। অনেক পরীক্ষা অনলাইনে হবে। মানুষের ভিড় আমাদের এড়িয়ে চলতে হবে।

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

বইপড়া

বেশি করে বই পড়ো। তোমার পাঠ্যবই পড়ো। যেসব পরীক্ষায় আসে, সেসব পড়ো। অঙ্ক করো। হাতের লেখা অনুশীলন করো। তোমাদের পাঠ্যবইয়ের সে অংশগুলো সিলেবাসে নেই, তা–ও পড়ে ফেলো।

কিন্তু বেশি করে বাইরের বই পড়ো। হাতে নিয়ে পড়ো কাগজের বই। আর কাগজের বই হাতের কাছে না পেলে অনলাইনে ই-বইও পড়তে পারো।

কী ধরনের বই পড়বে?

প্রথমে সাহিত্য। গল্পের বই। কবিতা। উপন্যাস। যা তোমার ভালো লাগে। তোমার যদি মুহম্মদ জাফর ইকবাল ভালো লাগে, পড়ে ফেলো। তিন গোয়েন্দা ভালো লাগে, ফেলুদা ভালো লাগে, পড়ো। সবচেয়ে মজা পাও হুমায়ূন আহমেদ পড়তে, পড়ো।

এরপর আস্তে আস্তে আরেকটু সিরিয়াস বই পড়তে থাকো। বাংলা সাহিত্যের ক্লাসিকগুলো, বিশ্বসাহিত্যের ক্লাসিকগুলো। শরৎচন্দ্র, মানিক, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম। সুকুমার রায়। জসীমউদ্‌দীন।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ক্লাসিকগুলো পড়ে ফেলো। আলোর পাঠশালা নামে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অ্যাপ আছে। সেটা নামিয়ে নিয়ে পড়তে পারবে দারুণ দারুণ বই।

বেশি করে ফিকশন পড়বে। মানে গল্প কবিতা উপন্যাস। এরপর নন–ফিকশন। জীবনী। বিজ্ঞান। গণিতের বই। অ্যাডভেঞ্চার। তারপর ইতিহাস, ভ্রমণকাহিনি।

বই পড়লে তুমি সুন্দর মনের একটা মানুষ হবে।

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

সিনেমা দেখো, গান শোনো

পৃথিবীর সেরা সিনেমাগুলো দেখে ফেলো। ইন্টারনেটে সার্চ দাও। পৃথিবীর সেরা এক শ ছবি। সেসব দেখো। যেমন আমি এবারের লকডাউনের দিনগুলোতে সত্যজিৎ রায়ের ছবি আর ঋত্বিক ঘটকের ছবিগুলো দেখেছি। বাইসাইকেল থিভস দেখলাম, যেমন দেখলাম ব্যালাড অব আ সোলজার। তোমরা তোমাদের রুচি অনুযায়ী ছবি দেখবে। এমন অনেক গান আছে, যেগুলো হয়তো তুমি শোনোনি। সেগুলো শুনে দেখো। কয়েক দশক আগের গানগুলো কেমন ছিল, সেগুলো শোনো। তবে তোমার মধ্য একটা গৌরববোধ থাকা দরকার, যে আমি পৃথিবীর সেরা ছবিগুলো দেখব, সেরা বইগুলো পড়ব, সেরা গান শুনব।

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলো

তুমি কিন্তু ঘরকুনো হয়ে থাকবে না। সবার সঙ্গে ফোনে কথা বলবে। শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে। বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলবে। আত্মীয়স্বজনের খোঁজ রাখবে।

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

ঘাম ঝরাতে হবে

তোমার দিনরাত যেন শুয়ে–বসে না কাটে। সারা দিন অনলাইনে বসে থাকবে, মোবাইলে বা কম্পিউটারে গেমস খেলবে? না না। ওঠো। ঘরের মধ্যেই দৌড়াও। যখন বাইরে ভিড় কম থাকে, তখন বাইরেও দৌড়াতে পারো। অন্যের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে খেলতে পারো। প্রতিদিন অন্তত এক ঘণ্টা শরীরচর্চা করতেই হবে।

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

বাবা-মাকে সাহায্য করো

বাবা-মাকে তাদের কাজে সাহায্য করতে পারো। বাবার অনলাইন মিটিংয়ে ব্যাপারে তাঁকে তুমি সাহায্য করতে পারো, কারণ, কম্পিউটারটার ব্যবহার তুমি তাঁর চেয়ে ভালো জানো। আবার বাড়ির কাজেও একটু হাত লাগানো যায়।

গবেষণায় দেখা গেছে, বাসন মাজলে শরীর ও মন দুটোই ভালো থাকে। কাপড় কাচা বা ইস্তিরি করার কাজ যদি করতে পারো, তাহলে তো কথাই নেই। গাছে পানি দেওয়ার কাজ তো করাই যায়। মা–বাবার আদর্শ ছেলে বা মেয়ে হয়ে ওঠো।

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

সামাজিক কাজ করো

মানুষের সেবায় এগিয়ে আসো। একটা গরিব পরিবারের খোঁজ নাও। তাদের পাশে দাঁড়াও। তোমাদের গরিব আত্মীয়স্বজনকে সাহায্য করার চেষ্টা করতে পারো। এবার কিন্তু কিশোর আর তরুণেরা দারুণ কাজ করেছে। তারা অনেক বাড়িতে খাবার পৌঁছে দিয়েছে। অনেকেই আম্পানের পর ত্রাণকাজে অংশ নিয়েছে। তোমার নিজের বুদ্ধিতে তুমিও একটা নতুন উদ্যোগ নিতে পারো। আবার কোনো কার্যক্রমের সঙ্গে নিজেকে যুক্তও করতে পারো। তবে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।

ইংরেজি শেখো

নিজের উন্নতির জন্য কতগুলো কাজ করে রাখা যায়। যেমন অনলাইনে ইংরেজি শেখার কোনো ভিডিও দেখে নিয়মিত ইংরেজির চর্চা করো। অনলাইনে লেখাপড়ার অনেক ভিডিও আছে। সেসব দেখে লেখাপড়ার কাজটা এগিয়ে নাও। বিজ্ঞানের অনেক প্রজেক্ট আছে ইউটিউবেই। সেসবও চর্চা করতে পারো। রান্না করতে পারো।

নিজেকে উপস্থাপন করা শেখা

নিজেকে তুলে ধরতে পারতে হবে। আবার কানেকটিভিটি এই দুনিয়ায় খুব মূল্যবান। বড় বড় মানুষদের ই-মেইল করতে পারো, ফেসবুকে কানেক্টেড থাকার চেষ্টা করতে পারো। সেটা করার জন্য একটা উপলক্ষ লাগবে। তোমার কোনো একটা ভালো কাজ করছ, সেই ব্যাপারে তুমি ওই ক্ষেত্রের কোনো বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করতেই পারো।

এরপর যা করতে পারো, তাহলো ক্যামেরাভীতি দূর করার চেষ্টা। ফেসবুকে লাইভ করতে পারো। ছোট ছোট ভিডিও বানাতে পারো। তুমি হয়তো একটা বইয়ের রিভিউ করলে। সেটার ভিডিও ইউটিউবে প্রকাশ করলে। একটা বিজ্ঞানের প্রজেক্ট করলে। সেটার ভিডিও প্রকাশ করলে। এগুলো তোমাকে এগিয়ে নেবে সামনের দিকে।

আমরা নিউ নরমালের কথা বলছি। বলছি যে আগের দিনে আমরা ফিরতে পারব না। আমাদের হয়তো মাস্ক পরে চলাই অভ্যাস করতে হবে।

কিন্তু আরেকটা কথা ঠিক। আমরা আগের দিনগুলো চাই না। আগের দিনগুলো খুব নরমাল ছিল না। পৃথিবীতে বৈষম্য অনেক। পৃথিবীর বহু মানুষ এখনো রাতের বেলা খাবার না পেয়ে খালি পেটে ঘুমাতে যায়। বহু মানুষ খাবার পায় না। বহু মানুষ হাসপাতালের সুবিধা পায় না। সবাই এখনো শিক্ষার সুযোগের আওতায় আসেনি। বিশ্বের ৮০ ভাগ সম্পদ ২০ ভাগ মানুষের হাতে। ধনী–গরিবের পার্থক্য অনেক। আবার আমরা পরিবেশের অনেক ক্ষতি করেছি। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মানুষই দায়ী। আমরা নতুন নরমালে একটা সুন্দর পৃথিবী চাই, যেখানে বৈষম্য কম থাকবে। সবাই খেতে পাবে, সবাই শিক্ষা পাবে, স্বাস্থ্যসুবিধা পাবে। আর যেখানে কার্বন নিঃসরণ কম হবে। যেখানে উন্নয়ন নীতি হবে সবুজ।

আমরা যদি সেই সুন্দর পৃথিবী কায়েম করতে না পারি, তোমরা করবে।

(কিশোর আলোর জুলাই ২০২০ সংখ্যায় প্রকাশিত)