সুন্দরবনে এক শ দিন

ছোটবেলা থেকেই আমি খুব দুরন্ত স্বভাবের। মাথার ভেতর ঘুরপাক খায় অ্যাডভেঞ্চারের নেশা। তাই ফেসবুকে যখন দেখলাম, স্বল্প মেয়াদের একজন গবেষণা সহকারী খুঁজছে ওয়াইল্ড টিম, আগ্রহী না হয়ে পারলাম না। ওয়াইল্ড টিম মূলত পরিবেশ নিয়ে কাজ করে। এর মধ্যে ইউএসএআইডির ‘বাঘ প্রজেক্ট’ অন্যতম। এই প্রজেক্টের কর্মীদের চার মাস সুন্দরবনে থাকতে হবে, কাজ করতে হবে বাঘের জন্য। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা লুফে নিলাম। ছোটবেলা থেকেই বাঘের প্রতি অন্য রকম একটা ভালোলাগা আছে আমার। বাঘের ছবি দেখলেই মনে হয়, কোলে তুলে নিয়ে আদর করি। এবার সত্যি সত্যি সুন্দরবন গিয়ে বাঘ দেখার সুযোগ! তাই বাসার কাউকে না জানিয়েই পাঠিয়ে দিলাম সিভি। তারপর শুধু অপেক্ষা। দিন যায়, সময় যায়, ডাক আর আসে না। ভাবলাম, আমি ব্যবসায় শিক্ষায় গ্র্যাজুয়েশন করেছি, তাই হয়তো ডাকবে না আমাকে। হঠাৎ একদিন অপরিচিত এক নম্বর থেকে ফোন এল। রিসিভ করতেই জানতে পারলাম আমাকে ওয়াইল্ড টিমের এই প্রজেক্টের জন্য ইন্টারভিউ দিতে যেতে হবে। আমি তো খুশিতে আত্মহারা। তারপর সেই শুভদিন এল। ইন্টারভিউ দিতে গেলাম। ইন্টারভিউ শেষে আবারও দিন গোনা। দিন যায়, সময় যায়, কল আর আসে না। এর কয়েক দিন পর আমাকে ফোন দিয়ে জানানো হলো, ‘ব্যাগ গোছান। সুন্দরবন আপনার অপেক্ষায়।’ খুশিতে চিৎকারর শুরু করলাম আমি। সন্ধ্যায় মা-বাবাকে বললাম আমি একটা চাকরি পেয়েছি। চার মাস সুন্দরবন থাকতে হবে। শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লেন মা-বাবা। সবকিছু খুলে বললাম, আম্মুর প্রশ্ন, কজন মেয়ে কাজ করবে? বললাম দুজন। শুনে আম্মুর এক কথা, যেতে দেবেন না। এতগুলো ছেলের মধ্যে মাত্র দুজন মেয়ে কাজ করবে, তা-ও বনে ঘুরে ঘুরে, কোনো নিরাপত্তা আছে কি না, এই সেই। কিন্তু আমি তো নাছোড়বান্দা। আমি যাবই। একটা মেয়ে ঘর থেকে বহু দূরে গিয়েও যে কাজ করতে পারে, সেটা প্রমাণ করে দিয়ে আসব আমি।

যেই ভাবা সেই কাজ। ব্যাগ গোছানো শুরু করলাম। আমার বড় বোন আম্মুকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করতে থাকল। আম্মু রাজি হলেন অবশেষে। এত কিছুর পরও আমাকে নানা কথা শুনতে হয়েছিল। কেউ কেউ বলেছে, এতগুলো ছেলের ভেতর তিথি (আমার ডাকনাম) কাজ করবে? সমাজ আছে, আশপাশের মানুষ আছে—এসব নানা কথা। আমি সবকিছু উপেক্ষা করে ওয়াইল্ড টিমের ক্যামেরা ট্র্যাপিং দলের সঙ্গে ২৫ নভেম্বর, ২০১৬ ঢাকা থেকে খুলনার উদ্দেশে রওনা হলাম। ২৭ তারিখ বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ‘অবসর’ নামের একটি জাহাজে চেপে আমরা যাত্রা শুরু করলাম সুন্দরবনের (সাতক্ষীরা অঞ্চল) দিকে। জীবনে প্রথমবারের মতো সুন্দরবন যাত্রা। আমরা যেদিকটায় যাচ্ছিলাম, সেদিকটায় কোনো ট্যুরিস্টও যেতে পারে না। সে জন্য আরও বেশি গর্ব হচ্ছিল। যেখানে কেউ যেতে পারে না, সেখানে আমি যাচ্ছি!

আরও বেশি গর্ব হচ্ছিল। যেখানে কেউ যেতে পারে না, সেখানে আমি যাচ্ছি!

সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা গণনা করার দুটি পদ্ধতি আছে। একটি হলো খাল সার্ভে, আরেকটি ক্যামেরা ট্র্যাপিং। সংক্ষেপে বলি, খাল সার্ভেতে বাঘের পায়ের ছাপ যাচাইয়ের জন্য গণনা করা হয় বাঘের সংখ্যা। আর বনের বিভিন্ন স্থানে বাঘের গতিবিধি অনুমান করে ক্যামেরা স্থাপন করা হলো ক্যামেরা ট্র্যাপিং। ক্যামেরায় ধারণকৃত বাঘের ছবি দেখেই গণনা করা যায় বাঘের সংখ্যা।

সুন্দরবন যেখান থেকে শুরু, সেখান থেকেই শুরু হয় রোমাঞ্চ। এই বুঝি বাঘ দেখা যায়, এই বুঝি হরিণ দেখা যায়। যেতে যেতে হঠাৎ দূরে দেখতে পেলাম, একটা হরিণ পাতা খাচ্ছে। তখন ভাবলাম ইশ্! বাঘ বসে থাকলে কত মজা হতো। রাতে দোবেকীতে থাকলাম আমরা। আমরা দোবেকী থেকে শুরু করে কাকা দোবেকী, পুষ্পকাঠি, মান্দারবাড়িয়া, বেহালা, জলঘাটা, কালিরচর, নোটাবেকি, হলদিবুনিয়াসহ বেশ কিছু জায়গা চষে বেড়িয়েছি। পুষ্পকাঠি, মান্দারবাড়িয়া আর হলদিবুনিয়া এত্ত সুন্দর, এত্ত সুন্দর, মনে হয় যেন স্বর্গ! শুরু হলো আমার জঙ্গলের জীবন।

দিন নম্বর ৫: সুন্দরবনের মাটি কাদার ঘাঁটি

আজ প্রথম সুন্দরবনের মাটিতে নামলাম। এত নরম কাদা, পা দিলেই দেবে যাচ্ছিল। কিছু দূর হেঁটে প্রথমবারের মতো বাঘের পায়ের ছাপ দেখলাম। কী রোমাঞ্চকর অনুভূতি! সেই সঙ্গে চোখের সামনে বাঘ দেখার তীব্র ইচ্ছা! বাঘের পায়ের ছাপের পাশাপাশি হরিণ, শূকর, ফিশিং ক্যাটের ছাপও দেখেছিলাম।

দিন নম্বর ৭: হরিণের ডাক

কাজ সেরে ঘুমাতে ঘুমাতে মধ্যরাত। হঠাৎ শুনি, কিসের যেন ডাক। পরে আবিদ ভাইয়া বললেন হরিণ ডাকছে। এই প্রথম হরিণের ডাক শোনা।

ক্যামেরা দেখে হরিণরাও পোজ দিতে ভুল করলো না

দিন নম্বর ১৭: ডলফিন!

আজকে জীবনে প্রথমবারের মতো নিজের চোখের সামনে ডলফিন দেখেছি। দুইটা ডলফিন আমাদের নৌকার কিছু দূরে পানির ভেতর ডুব দিয়ে আবার ভেসে উঠে আমাদের খেলা দেখাচ্ছিল।

দিন নম্বর ২১: চরবন্দী

আজকে আমাদের কাজ ছিল সমুদ্রপারের দিকে। সমুদ্রপারের সুন্দরবন এত্ত সুন্দর, ভাষায় বলে বোঝানো সম্ভব নয়। সমুদ্রের এক পারে বিশাল সবুজে ঘেরা বন, অপর দিকে শুধু পানি আর পানি। কাজ শেষে একটা টিমের জন্য অপেক্ষা করছিলাম আমরা। দুটো সাম্পান চরের কাছাকাছি বাঁধা ছিল। সুন্দরবনে জোয়ার-ভাটার হিসাবটা মাথায় রাখতে হয়। একটু ভুল হলেই ভাটার সময় চরে বা খালে আটকা। আমার একটা বাসনা ছিল, কোনো একদিন একটা চরে আটকা পড়ব। সকাল গড়িয়ে দুপুর হবে, বিকেল হবে, সন্ধ্যা হবে, তারপরও আমাদের কেউ উদ্ধার করতে আসবে না। সে ইচ্ছা আজ পূরণ হলো। সাম্পানগুলো যেখানে বাঁধা ছিল, হঠাৎ করে পানি সরে গিয়ে চরে আটকে পড়ল সাম্পান দুটো। তখন বাজে বেলা তিনটা। কী করা যায় ভাবতে ভাবতে দলের এক সদস্য বললেন, কাদা কেটে সাম্পান বের করতে হবে। নাহলে আটকে থাকতে হবে রাত নয়টা পর্যন্ত। জোয়ার শুরু হবে রাত নয়টায়। আমার বেশ মজা লাগছিল। রাত পর্যন্ত আটকে থাকব! যেই ভাবা সেই কাজ। সবাই কাজে নেমে গেল। দা, কোদাল দিয়ে মাটি কাটা শুরু করল। মাটি কাটার ফলে আস্তে আস্তে পানিতে ভরতে শুরু করল কিছু জায়গা। তারপর সাম্পানে দড়ি বেঁধে সবাই মিলে হেইও হেইও করতে করতে বহু কষ্টে একটা সাম্পান পানিতে ফেলতে সক্ষম হলো। এভাবে নামানো হলো অন্য সাম্পানটাও। আমিও দড়ি ধরে সাহায্য করেছি তাঁদের। দুই সাম্পান পানিতে নামাতে নামাতে সন্ধ্যা ছয়টা। দারুণ মজা হয়েছিল সেদিন। আমি ভাবছিলাম, হয়তো বনের ভেতর থেকে বাঘগুলো আমাদের দেখে হাসতে হাসতে বলছিল, ‘আহা রে মানুষের দল!’

দিন নম্বর ২৮: তোমায় নাম দস্তখত শেখাতে চাই

আজকের দিনটা আমার জন্য বিশাল একটা দিন ছিল। আমাদের সঙ্গে যাঁরা ভিটিআরটির (ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম: লোকালয়ে বাঘ ঢুকে গেলে যারা এলাকাবাসীকে সচেতন করে এবং বাঘটা যেন নিরাপদে জঙ্গলে ফিরে যেতে পারে তার ব্যবস্থা করে) সদস্যরা ছিলেন, তাঁদের অ্যাটেনডেন্স শিটে স্বাক্ষর নিতে হতো। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন ফরাজি কাকা। উনি লিখতে জানতেন না। আমি ওনাকে তাঁর নাম লিখতে শিখিয়েছি। বেশ কিছুদিন লেগেছিল শিখতে। যখন পুরোপুরি শিখে গিয়েছিলেন, তখন খুব খুশি হয়েছিলেন তিনি। আর বলেছিলেন, বাসায় গিয়ে ওনার স্ত্রীকে দেখাবেন যে উনিও লিখতে পারেন।

দিন নম্বর ৩০: আমি হলাম মাঝি

আজকে আমি প্রথম ইঞ্জিনের নৌকা চালানো শিখি। আমাদের একটা খোলা নৌকা ছিল। সেই নৌকা নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছিলাম আমরা। আমি তখন নৌকা চালাব বলে চিৎকার করছিলাম। তখন নাইম ভাইয়া আমাকে নৌকা চালাতে দিয়ে ডিরেকশান দিতে থাকেন। আমিও খুব সুন্দর করে নৌকা চালিয়ে অনেক দূর চলে গিয়েছিলাম। আবার সেখান থেকে আমাদের জাহাজের কাছে এসে ল্যান্ডিংও করি সুন্দরভাবে। এরপর থেকে প্রায়ই নৌকাটা চালাতাম আমি।

মাঝে মঝেই নৌকা চালাতাম আমি

দিন নম্বর ৩৪: ফসকে গেল বাঘ

দিনটা খুব খারাপ ছিল। খুব ঠান্ডা ছিল আজ। স্পিডবোটে চেপে কাজে যেতে হয়েছিল আমাদের। ঠান্ডা বাতাসের তোড়ে চোখমুখ ঢেকে মাথা নিচু করে বসে ছিলাম আমি। হঠাৎ তানভির ভাই ‘বাঘ বাঘ’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠলেন। আমিও মাথা তুলে তাকালাম। কিন্তু ইতিমধ্যে স্পিডবোটটা এগিয়ে গিয়েছিল বেশ খানিকটা। ঘুরিয়ে আবার সেই জায়গায় আনতে আনতেই উঠে চলে গেল বাঘটা। আমি দেখতে পারলাম না। কষ্টে আমি কেঁদেই ফেলেছিলাম প্রায়। যার জন্য এখানে আসা, তাকেই দেখতে পেলাম না। এত কষ্ট লাগল বলার মতো না। আমার প্রথম বাঘ দেখার গল্প মিস হয়ে গেল। সেদিন থেকে বুঝলাম, সুন্দরবনে এলে চোখ-কান-মুখ সব খোলা রাখতে হবে।

দিন নম্বর ৪৭: ডাকাতের অপেক্ষায়

বেশ মজার ছিল আজকে রাতটা। রাত একটার দিকে একটা শোরগোল পড়ে গেল জাহাজে। রাতে জাহাজে যারা পাহারায় থাকে, দূরে একটা ইঞ্জিন নৌকার শব্দ পেয়েছে তারা। আমাদের জাহাজ থেকে সেদিকে আলো জ্বালতেই সেই ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল। সবার ধারণা, ওটা ডাকাতের নৌকা। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে জাহাজে। ঘুম থেকে জেগে দুশ্চিন্তা শুরু করল সবাই। ডাকাত আসলে কী হবে, সেটা নিয়ে সবাই আলাপ করছেন। কড়া পাহারা বসানো হলো জাহাজের চারদিকে। আমরা জেগে থাকব কী করে ভাবতে ভাবতেই আবিদ ভাইয়া বললেন, উনো খেলে সময় কাটাই। তারপর সবাই উনো খেলতে বসে গেলাম। উনো খেললাম রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত। ডাকাতের কোনো হদিস নেই। শেষে ‘ধুর ডাকাতি হবে না’ ভেবে সবাই ঘুমাতে চলে গেলাম। সকালে উঠে জানলাম, সেটা একটা ক্যাম্পের নৌকা ছিল!

দিন নম্বর ৫৭: আবারও ফসকাল বাঘ

আজকে দ্বিতীয়বার বাঘ দেখার সুযোগ হাতছাড়া হলো। কাজ করতে যখন বনের ভেতর ঢুকি, তখন জেনারুল ভাই দেখতে পান একটা বাঘ দূরে হেঁটে যাচ্ছে। উনি ‘বাঘ বাঘ’ করে এগোতে থাকলেন। আমিও গেলাম তাঁর পিছু পিছু। আমাদের টিম লিডার তানভির ভাইয়া কড়া গলায় সবাইকে ডেকে নিয়ে উঠে বসেন সাম্পানে। কিছুক্ষণ পর আমরা যখন আবার সেই জায়গায় নামলাম, তখন বুঝলাম বাঘটা এখানে বসে রোদ পোহাচ্ছিল। তানভির ভাইয়া না ডাকলে হয়তো আরেকটু ভেতরে গেলেই বাঘটাকে দেখতে পেতাম আমরা। কিন্তু আমাদের কাজের ব্যাপারে একটা বড় ইস্যু ছিল নিরাপত্তা।

দিন নম্বর ৬০: হ্যাটট্রিক

টানা তৃতীয়বারের মতো বাঘ দেখার সুযোগ মিস। মান্দারবাড়িয়ার দিকে কাজ শেষ করে মাছ ধরতে নামি আমরা। অসম্ভব রকমের কাদা ছিল জায়গাটায়। প্রায় কোমরসমান কাদায় দেবে যায় এমন অবস্থা। তানভির ভাইয়া পানি থেকে একটু দূরে তাঁদের কাছাকাছি হাঁটতে বলেছিলেন আমাকে। আমাদের টিমের একজন মুরব্বি ছিলেন শাহাদাত কাকা। উনি আমাকে বনের পাশ দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। একটু পর তানভির ভাইয়া আমাদের কাছে চলে এলেন, সাম্পানে উঠতে বললেন দ্রুত। আমরা সবাই সাম্পানে উঠলে উনি সাম্পান চালিয়ে চলে যেতে বললেন তিনি। জাহাজে ফিরে রাতে উনি ধমক দিলেন। বললেন, কেন আমি বনের এত পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম! সেখানে একটা বাঘ ছিল। আমাদের ফলো করে করে এগোচ্ছিল। ভাগ্যিস বাঘটা কিছু করেনি! কিন্তু আমার দুঃখ একটাই, তখন উনি সাম্পান না চালিয়ে বাঘটা দেখালেই পারতেন! কী আর এমন হতো, বাঘ তো জানেই আমরা তার ক্ষতি করব না!

দিন নম্বর ৬৮: হঠাৎ আঘাত

আজকে একটা বিরাট দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফিরেছি। আমরা কাজ শেষে স্পিডবোট নিয়ে জাহাজের দিকে ফিরছিলাম। হঠাৎ স্পিডবোটটা কিসের সঙ্গে যেন বাড়ি খেয়ে কাত হয়ে গেল একপাশে। আমরা যে পাশে ছিলাম সে পাশের সবাই উল্টো পাশের মানুষের ওপর গিয়ে পড়লাম। একটা পাক খেয়ে আবারও কাত হয়ে গেল স্পিডবোট। দুই পাশ থেকে পানি ঢুকে গেল স্পিডবোটের ভেতর। আমাদের বোটম্যান আলমগীর ভাই দক্ষ চালক। ঠিকই ব্যালান্স করে স্পিডবোটটা সোজা করলেন তিনি। সবাই যখন চিন্তা করছি কিসের সঙ্গে ধাক্কা খেল, তখন সামনে তাকিয়ে দেখি একটা ভাঙ্গাল মাছের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে এই অবস্থা! মাছটা জাহাজে নিয়ে এলাম আমরা। সাড়ে তিন কেজি ওজনের মাছ। খুব মজা করে খেয়েছিলাম সবাই।

দিন নম্বর ৬৯: চিহ্ন

কাজ করতে করতে হঠাৎ একটা গেওয়াগাছের সঙ্গে আমার নাকের ডান পাশে বাড়ি খায়। গাছের কিছু হয়নি, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নাক ছিলে যায় আমার। রাতে দেখি দাগও পড়ে গেছে। এখনো সেই দাগ বহাল আছে। এটা সুন্দরবনের উপহার আমার জন্য। সারা জীবন যেন তাকে মনে রাখি!

দিন নম্বর ৭২: ছুটি এবং ফেরা

সবাইকে ৭ দিনের ছুটি দেওয়া হয়েছে। কিছু করার নেই তাই আমিও ঢাকা চলে এলাম। ৫ দিন খুব অস্থির ছিলাম ঢাকায়। মনে হচ্ছিল কবে জঙ্গলে যাব। তারপর আবার যখন জাহাজে ফিরলাম, মনে হচ্ছিল হারিয়ে যাওয়া কিছু ফিরে পেয়েছি।

দিন নম্বর ৮৬: গোপন অভিযান

আজ একটা গোপন অভিযানে বের হয়েছি আমরা। প্রায় ২০০-৩০০ বছর আগে লবণ বানানো হতো সুন্দরবনে। সেই লবণের আইটের কিছু ধ্বংসাবশেষ আছে এখনো। সেগুলোই খুঁজতে যাওয়া। মোট ছয়জনের একটি দল বনের ভেতর দিয়ে হেঁটে তিনটা ছোট ছোট খাল পার হয়ে সেই জায়গায় গিয়েছি। খালগুলোতে ছিল গোড়ালিসমান পানি। কিন্তু ফিরে আসার সময় হলো বিপত্তি। খালগুলো জোয়ারের পানিতে পূর্ণ হয়ে কোমরসমান পানি হয়ে গেল। জাফর ইকবাল স্যারের দস্যি ক’জন বইটার কথা মনে হলো আমার। একদম ঠিক ঠিক বইয়ের কাহিনির সঙ্গে আমাদের ঘটনা মিলে গেল। কোমরসমান পানির দুটি খাল পার হলাম। কিন্তু ৩ নম্বর খালে গলাসমান পানি। একে তো সাঁতার জানি না, তার ওপর কুমিরের ভয়। শেষ পর্যন্ত তানভির ভাইয়া একটা গেওয়াগাছ কেটে এই পার থেকে ওপারে সাঁকো বানিয়ে দেন। আমরা সেই সাঁকো পার হয়ে অপর পাশে গেলাম। দারুণ অ্যাডভেঞ্চারপূর্ণ দিন।

দিন নম্বর ৯৯: মধুর দিন

আজকের দিনটাও অ্যাডভেঞ্চারপূর্ণ। প্রথমবারের মতো মধু কাটা এবং মধু প্রসেসিং দেখলাম। বনের একটা জায়গায় মৌমাছির চাক দেখেছিলাম আমরা। মধু হলেই কাটা হবে। আজকে বেরিয়েছিলাম মধু কাটতে। আমাদের টিমের সদস্য জেনারুল ভাই আর শাহাদাত কাকা মুখে কাপড় বেঁধে ধোঁয়া দিয়ে কাটা শুরু করলেন চাক। আমি আর তানভির ভাইয়া কাছাকাছি দাঁড়িয়ে দেখছিলাম সেটা। আমাদের মুখেও কাপড় বাঁধা, যাতে মৌমাছি কামড় দিতে না পারে। যখন ধোঁয়া দিয়ে মৌমাছি তাড়ানো হচ্ছিল তখন মৌমাছিগুলা ধেয়ে আসছিল আমাদের দিকে। খুব ভয় লাগছিল, এই না কামড় দিয়ে বসে! প্রায় দুই মিনিটের মতো সময় লাগল চাক কাটতে। চাক কেটে আমরা জাহাজে নিয়ে এলাম। তারপর শাহাদাত কাকা চাক থেকে টিপে টিপে মধু বের করলেন। খাঁটি মধু এত্ত মজা! এ স্বাদ জীবনেও ভোলা সম্ভব না।

দিন নম্বর ১০০: সেঞ্চুরি

সুন্দরবনে থাকার ১০০ দিন পূরণ হলো আজ। সে জন্য আমরা আজকে কেক কেটে বেশ ভালোভাবে উদ্যাপন করলাম সন্ধ্যাটা। বেশ ভালো খাওয়াদাওয়াও ছিল আজকে। সবাই আমার খুব প্রশংসা করছিলেন। একজন মেয়ে হিসেবে সুন্দরবনে টানা ১০০ দিন থাকা একটা রেকর্ড। বাংলাদেশে আগে কখনো কোনো মেয়ে টানা ১০০ দিন সুন্দরবনে থাকেনি। এটা আমার জন্য বিরাট অর্জন।

দিন নম্বর ১০২, ১০৩, ১০৪: ক্যামেরা ট্র্যাপ

এ দিনগুলো মিডিয়ার সঙ্গেই গেছে। তিনটি টিভি চ্যানেল থেকে সাংবাদিক এসেছিলেন আমাদের কাজ শুট করার জন্য। আমাকে তিনটি চ্যানেলেই ইন্টারভিউ দিতে হয়েছিল। এবার নিজেই ক্যামেরার ট্র্যাপে পড়লাম। ওয়াইল্ড টিম থেকেও আমাদের কাজ শুট করা হয়েছিল। সেখানেও ইন্টারভিউ দিতে হয়েছিল আমাকে। এত নার্ভাস ছিলাম, ক্যামেরা তাক করলেই ভুলে যেতাম সব। কিছুই বলতে পারতাম না। তারপরও ভালোই লেগেছিল। তবে আমার ধারণা হলো, ইন্টারভিউ দেওয়ার চেয়ে বাঘের সামনে পড়া ভালো।

দিন নম্বর ১০৬: ঝড়

আমরা ছিলাম আঠারোবেকি নামে একটা জায়গায়। দুই পাশেই বন। রাতের দিকে হঠাত্ করে মেঘে মেঘে ঝগড়া শুরু হলো আর সেই সঙ্গে বিজলির চমকানিতে পুরো সুন্দরবন আলোকিত। দমকা বাতাসে জাহাজ খালি দুলছিল। নোঙরটাও আটকে রাখতে পারছিল না জাহাজটাকে। ভয়াবহ অবস্থা। হঠাৎ করে এক দমকা বাতাসে নোঙর ছুটে গেল, আর বাতাসের ঝাপটায় নদীর মাঝখান থেকে পারে গিয়ে বাড়ি খেল জাহাজ। জাহাজের মধ্যে উত্তেজনা! এমন বাতাস চললে সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। আর আমি ভাবছিলাম এখন যদি একটা বাঘ জাহাজে উঠে এসে বলে, ‘বৃষ্টির পানিতে পুরো সুন্দরবন কাদা হয়ে গেছে। আজকে রাতে আমাকে এখানে থাকতে দাও।’ তারপর একটা ঘরে গিয়ে ঘুমাতে শুরু করল! কী মজা। যাই হোক, বাতাস একটু কমলে আবারও নদীর মাঝখানে গিয়ে নোঙর করা হলো জাহাজ।

দিন নম্বর ১০৭: বিদায়

আজ থেকে বিদায়ের কাউন্টডাউন শুরু। সব কাজ শেষ করে, মালপত্র গুছিয়ে বিদায়ের প্রস্তুতি সম্পন্ন। মালপত্র সব খুলনা অফিসে রাখলাম। ১৬ মার্চ, ২০১৭। একে একে বিদায় নিলাম সবাই। বিদায় আসলেই খুব কষ্টের। ১১৩ দিনের যে ভালোবাসা, মায়া, মমতা জন্ম নিয়েছে জাহাজের প্রতিটি মানুষের প্রতি, যা বিসর্জন দিয়ে ইটপাথরের শহরে চলে আসতে হবে ভেবেই কাঁদলাম। একে একে চলে গেলেন সবাই। মায়া খুব খারাপ জিনিস। সবার এত এত ভালোবাসা পেয়েছি যার প্রতিদান কোনো কিছু দিয়েই পূরণ করা সম্ভব না।

আমাদের জাহাজে তিন ধরনের মানুষ ছিলেন। ওয়াইল্ড টিম, ভিটিআরটি এবং বন বিভাগ। সবাই একটা পরিবারের মতো হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। ফিল্ড কিংবা জাহাজ, যে কারও সমস্যায় এগিয়ে আসতাম সবাই। বিশেষ করে ভিটিআরটির সদস্যরা এত ভালো, বনে নেমে কখনো বাঘের ভয়টাই অনুভব করিনি। জানতাম যদি কখনো বাঘের মুখোমুখি হইও, ওঁরা কখনো আমাদের ছেড়ে যাবেন না। গভীর বনের ভেতর কাজ করতাম আমরা। সব সময় চাইতাম, একটা বাঘ যেন দেখতে পাই। সত্যি বলতে, এত বড় একটা বন, যেখানে আমাদের রয়েল বেঙ্গল টাইগার বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায়, সে বনে নামতে আমার একদমই ভয় করত না। তবে কাজ না থাকলে দিন পার হতো খুব কষ্টে। আমার মনে হতো, জাহাজে থাকার চেয়ে বনে ঘোরাঘুরি করা অনেক ভালো। তবে কাজ না থাকলে খালে খালে নৌকা নিয়ে ঘুরতাম আমরা। ইঞ্জিন বন্ধ করে শুনতাম পাখির কোলাহল আর বনের নিস্তব্ধতা। আর অপেক্ষা করতাম বাঘ দেখার। বিকেলে চলত ক্যারামবোর্ড প্রতিযোগিতা। রাতে দাবা, লুডু, তাস আর উনো। মাঝে মাঝে গান গাইতাম। অমাবস্যা কিংবা পূর্ণিমায় জাহাজের ডেকে বসে একটার পর একটা গানের সুর। আহা! কী জীবন! দল বেঁধে ফরেস্ট ক্যাম্পের পুকুরে গিয়ে কাপড় ধুতাম, গোসল করতাম। খালে মাছ মারতাম জাল দিয়ে। কিছু ক্যাম্প আছে পরিত্যক্ত। সেসব ক্যাম্পে ঘোরাঘুরির অনুভূতিও ছিল অন্য রকম। সুন্দরবনের ভেতরের ক্যাম্পগুলা এত সুন্দর! ক্যাম্পের পুকুরে পানি খেতে আসে বাঘ। আর সুন্দরবনের পূর্ণিমা তো অসাধারণ! চাঁদের আলোয় প্রতিটি ঢেউ যেন গোনা যায়। জাহাজের ছাদের ওপর শুয়ে লাখো কোটি তারা গোনা আমাদের জীবনের চাওয়া ছিল যেন। রাতে গাছগুলো হয়ে যেত ক্রিসমাস ট্রি। হাজার হাজার জোনাকি পোকা জ্বলজ্বল করত গাছগুলো ঘিরে। কী যে অসাধারণ লাগত! আমরা বিজয় দিবসে জাতীয় সংগীত গেয়েছি সবাই মিলে। গান গেয়েছি ২১ ফেব্রুয়ারিতেও। গ্রামের কাছাকাছি এলে পুরো গ্রাম চষে বেড়ানো ছিল আমাদের নেশা।

সুন্দরবনে আমি ছিলাম মুক্ত পাখির মতো

১১৩ দিনের এই স্বর্গবাসে আমি ছিলাম দুরন্ত এক পাখি। কী না করেছি! যখন ইচ্ছে হয়েছে সাম্পান চালিয়েছি, মাছ ধরেছি, কাদায় মাখামাখি করেছি, গাছে উঠেছি—কেউ কোনো কিছুতে বাধা দেয়নি আমাকে। তবে সবাইকে যন্ত্রণাও দিয়েছি অনেক। ভাত খাব, খিদে নেই, রাগ হয়েছি, বলে বলে কতবার যে অভিমান করেছি, তার হিসাব নেই। দিন শেষে শিখেছি অনেক কিছু। আগে জানতাম বাঘ একটা কিউট প্রাণী। কিন্তু এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বুঝলাম বাঘ আসলে কেমন! সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এবং ভালোবাসা। তাঁদের জন্যই ১১৩ দিনের যাত্রা আমার জন্য সহজ, সুন্দর এবং সাবলীল হয়েছিল। ধন্যবাদ অবসরের সব ক্রুকে এবং বিশেষ ধন্যবাদ ওয়াইল্ড টিমকে, আমাকে এত বড় একটা সুযোগ দেওয়ার জন্য। তবে আফসোস একটাই, বাঘের সঙ্গে দেখা হলো না। ব্যাপার না, এবার হয়নি তো কী হয়েছে? বাঘের সঙ্গে দেখা করতে আবার যাব সুন্দরবনে। সুন্দরবন এমনই এক নেশা, একবার যে গিয়েছে, বারবার যেতে হবে তাকে।

(কিশোর আলোর মে ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত)