স্বাধীনতার কথা বলে যে জাদুঘর

ইদানীংকালের আড্ডা যেমন হয়, তেমনই হচ্ছিল সেদিন। হাসিঠাট্টার মাঝে চোখ বোলাচ্ছিলাম ফেসবুকের নিউজফিডে। হঠাৎ চোখ আটকাল অদ্ভুত সুন্দর আলোতে তোলা এক ফোয়ারার ছবিতে। সঙ্গে লেখা, ‘মিউজিয়াম অব ইনডিপেনডেন্স’। স্থাপত্যকলার সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে যাওয়ার মতো শিল্পবোধ আমার একেবারেই নেই। কিন্তু ছবিটাতে কেন যেন চোখ আটকে গেল। বন্ধুদের দেখাতেই একজন বলে বসল, ‘এটা বাইরের কোনো দেশে তোলা, দেখেই বোঝা যায়।’ জায়গাটা কোথায়, ভাবতে ভাবতেই চোখ পড়ল ছবির মন্তব্যগুলোয়। একজনের মন্তব্যের উত্তরে লেখা হয়েছে এটা নাকি রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে!

বলে কী! এত কাছে এমন সুন্দর ফোয়ারা, জানিই না? সঙ্গে সঙ্গে আমরা পাঁচজন দল বেঁধে শুরু করলাম ফোয়ারা দেখার যাত্রা। তখনো আমরা জানি না, আমাদের জন্য আরও কী অপেক্ষা করছে। সঙ্গে থাকা পাঁচজনের দুজন তখন ‘ছবিটা ফিল্টার দিয়ে তোলায় এত সুন্দর হয়েছে’ টাইপ আলোচনায় ব্যস্ত। বাকি দুজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেরই বাসিন্দা। তাই ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এমন দারুণ একটা জায়গা থাকবে, একটা আস্ত জাদুঘর থাকবে আর তারা জানবে না এটা কীভাবে হয়’, এ নিয়ে তর্ক জুড়ে দিল আমার সঙ্গে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল স্বাধীনতাস্তম্ভ। আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিরন্তর। আগেও এখানে এসেছি, কিন্তু কখনো জাদুঘর চোখে পড়েনি। এমনকি কোনো সাইনবোর্ডও না। একটু এগিয়ে জিজ্ঞেস করলাম হন্তদন্ত হয়ে হাঁটতে থাকা একজনকে—কিছুই বলতে পারলেন না। এক বন্ধু ততক্ষণে সিঁড়ি পেরিয়ে স্তম্ভের দিকে পা বাড়িয়েছে। হঠাৎ দেখি স্তম্ভের একটু পাশেই একটি ছোট দরজা। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজনকেই কিছু জিজ্ঞেস করছে ও। ওর ইশারা পেয়েই এগোলাম আমরা।

দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখি টিকিট কাউন্টার। বাংলাদেশি ও সার্কভুক্ত দেশের নাগরিকদের জন্য টিকিটের দাম ২০ টাকা। বিদেশিদের জন্য ১০০ টাকা। কংক্রিটের ঘোরালো পথটা ধরে যখন নিচে নামছি, তখনো আমাদের আলোচনার একমাত্র বিষয়, ‘এখানে সত্যিই একটা জাদুঘর কীভাবে আছে!’

প্রবেশপথের ওপরে নীল রঙের স্বচ্ছ ছাউনি দেওয়া। সূর্যের আলো আর নীল রং মিলে বেশ আধিভৌতিক এক অনুভূতি! নিচে নেমে গেছে সিঁড়ি। সঙ্গে থাকা স্বঘোষিত ‘বাংলাদেশ বিষয়াবলি’ বিশেষজ্ঞ বন্ধু জানাল, যদি সত্যিই এই সিঁড়ির পর কোনো জাদুঘর থাকে, তবে সেটিই বাংলাদেশের প্রথম আন্ডারগ্রাউন্ড জাদুঘর।

সিঁড়ির শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে অবাক হতেই হলো। চারদিকে কংক্রিটের দেয়াল। অনেক উঁচুতে ছাদ। মৃদু হলুদ আলোর নিচে সারি সারি কাচের দেয়ালে সাঁটা দৈনিক আজাদ, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, সানডে টাইমস, দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পত্রিকার কাটিং। সবই ১৯৭১ সালের পত্রিকা থেকে নেওয়া। কোনোটির বিষয়বস্তু সে সময়কার রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, আবার কোনোটির মুখ্য বিষয় তৎকালীন জনগণের প্রতিবাদ। কোথাও বাংলার জনগণের প্রতিবাদকে তুলনা করা হয়েছে ভিসুভিয়াসের সঙ্গে। আছে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণনীতির কট্টর সমালোচনাও। মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়তে পড়তে এগোচ্ছিলাম। কানে আসছিল ফোয়ারার পানির শব্দ।

জাদুঘরের এ অংশে আছে কালো গ্রানাইটে মোড়ানো মেঝে, দেয়াল। নরম নীল আলোতে দেখলাম দেয়ালজুড়ে সাজানো অসংখ্য সাদাকালো ছবি। ছবিগুলো দেখে শিউরে উঠছিলাম বারবার। গণহত্যার বিভিন্ন দৃশ্য ফ্রেমবন্দী করে রাখা হয়েছে জাদুঘরের এ অংশে। স্থাপত্যশৈলী বা আলোকসজ্জা বিশেষজ্ঞ নই আমি। তবে সেই দুঃসহ স্মৃতি প্রদর্শনের যথোপযোগী আবহ যে তৈরি করা হয়েছে, এটুকু নিঃসন্দেহে বলতে পারি।

বাঁ দিকে একটু মোড় নিতেই দেখা মিলল বহুল প্রতীক্ষিত সেই ফোয়ারার। ছাদের একটা অংশ গোল করে কাটা। সেটিই ফোয়ারার পানির উত্সস্থল। সূর্যের আলোও সেই একই পথে এসে আলোকিত করেছে পানির ধারা আর ঘরটিকে। আধো আলোর মাঝে ফোয়ারার অবিশ্রান্ত পানি ঝরার দৃশ্য বেশ মনোমুগ্ধকর। কালরাত্রির নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ছবিগুলো দেখে যখন বিষণ্ন লাগছিল, তখন এমন স্নিগ্ধ আবহ মনে করিয়ে দিল, সেই কালো অধ্যায় আমরা জয় করেছি ৪৫ বছর আগেই। এখন শুধু এগোনোর পালা। বেশ কিছু ছবি তুলে পা বাড়ালাম সামনের দিকে।

ভেতরে রয়েছে যুদ্ধকালের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ছবি।

আবারও সারি সারি কাচের দেয়ালে পেপার কাটিং সেঁটে রাখা একটা কক্ষ। এই অংশের কাটিংগুলোতে উঠে এসেছে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, যুদ্ধকালের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, একাত্তরের শেষ দিকে বাংলাদেশকে দেওয়া বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতির খবর। মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি তো আছেই, আছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের ছবিও। আত্মসমর্পণের সাক্ষী টেবিলটার রেপ্লিকাও আছে এখানে। হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার প্রতিবাদস্বরূপ আঁকা কামরুল হাসানের জনপ্রিয় কার্টুনসহ মুক্তিযুদ্ধকালের বিভিন্ন পোস্টার যেন এক মুহূর্তের জন্য আমাদের নিয়ে যায় সেই সময়টায়। শহীদজননী জাহানারা ইমামের সন্তান শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রুমীর একটি হাস্যোজ্জ্বল ছবির সামনে এসে থমকে গেলাম। মনে পড়ল ক্লাস ফোরে পড়ার সময় একাত্তরের দিনগুলি পড়তে পড়তে কতবার রুমীর জন্য চোখ ভিজে উঠেছে! পাশ থেকে এক বন্ধু বলে উঠল, ‘একেবারে আমাদের বয়সী এক তরুণ দেশকে ঠিক কতটা ভালোবাসলে এমন হাসতে হাসতে প্রাণবাজি রাখতে পারে?’ জাদুঘর আছে কি না সেই তর্ক তখন শেষ। শোক আর গর্বের মিশ্র অনুভূতি তখন গ্রাস করেছে আমাদের। শহীদ আজাদ, রুমী, জুয়েলের আত্মত্যাগের কথা মৃদু স্বরে বলতে বলতে বেরিয়ে এলাম আমরা।

আবারও কংক্রিটের সেই ঘোরানো পথ। এবার মাথার ওপরের স্বচ্ছ ছাদে বৃষ্টি ঝরছে। বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করতে করতে কাউন্টারে বসা কর্মীর কাছে জানতে চাইলাম কিছু তথ্য। তিনিই জানালেন স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী ও মেরিনা তাবাস্সুমের যৌথ ডিজাইনে ৬৭ একর জায়গার ওপর নির্মিত হয়েছে স্বাধীনতা জাদুঘরটি। এতে আছে ৩০০টি ঐতিহাসিক ছবি। পেপার কাটিং সংরক্ষণের জন্য ১৪৪টি কাচের দেয়াল। এ ছাড়া একটি মাল্টিমিডিয়া প্রজেকশন থিয়েটার, অ্যাম্ফিথিয়েটার আর ১৫৫ সিটের একটি অডিটোরিয়ামও রয়েছে। জাদুঘর বন্ধ থাকে বৃহস্পতিবার ও অন্যান্য সরকারি ছুটির দিনে। অক্টোবর থেকে মার্চের সময়সূচি অনুযায়ী শনি থেকে বুধবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত প্রদর্শনী চলে জাদুঘরে। তবে শুক্রবার জাদুঘর খোলা থাকে বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের সময়সূচি পাল্টে যায়। তখন শনি থেকে বুধবার জাদুঘর খোলা থাকে সাড়ে ১০টা থেকে সাড়ে ৫টা, আর শুক্রবার প্রদর্শনী চলে বিকেল তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত।

বৃষ্টি থামতেই বের হলাম আমরা। আবার দেখলাম স্বচ্ছ কাচের তৈরি স্বাধীনতাস্তম্ভ। পেছনে টেরাকোটার ম্যুরালে ছবি আর কবিতার পঙিক্ত। ৫০ মিটার উঁচু কাচের টাওয়ারটি রাতে রূপ নেয় আলোর স্তম্ভে। দেখে সত্যিই মুগ্ধ হতে হয়। কিন্তু লাখো প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া যে স্বাধীনতা, তার জন্য তৈরি স্তম্ভ এমন স্বচ্ছ, দীর্ঘ আর ঋজু হওয়ার যথার্থতা সেদিনই প্রথম উপলব্ধি করলাম।

(কিশোর আলোর ডিসেম্বর ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত)