ঐশীকে একটা বই পড়তে দিয়েছিল বন্ধু মাহাতাব। ফেরত নেওয়ার সময় জানতে চাইল, কী রে দোস্ত, কেমন লাগল বইটা?
দারুণ, কিন্তু...
কিন্তু কী?
এত হাসির একটা উপন্যাস অথচ পুরো বইয়ের কোথাও একটা স্মাইলি খুঁজে পেলাম না!
ঐশীর এমন অদ্ভুত কথা শুনে ভ্রু কোঁচকানোর আগে একবার ভাবো তো, মজার কোনো বাক্যের শেষে একটা হাসি হাসি মুখের ছবি না দেখলে তোমারও কি মনে হয় না ‘রয়ে গেল তো পুষ্টি বাকি?’
এমনটা মনে হয়েছিল সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী জোহানেস ভি জেনসেনেরও। প্রকাশক আর্নেস্ট বোজেসেনের কাছে সেই ১৯০০ সালের এক ডিসেম্বরের বিকেলে চিঠি লিখতে বসে তাতে স্মাইলি জুড়ে দিয়েছিলেন এই খেয়ালি লেখক। তাই সাহিত্যকর্মের পাশাপাশি স্মাইলি ব্যবহারকারী প্রথম ব্যক্তি হিসেবেও ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি।
বাণিজ্যিকভাবে স্মাইলির প্রথম ব্যবহার হয় ১৯১৯ সালে। নিউইয়র্কের বাফেলো স্টিম রোলার কোম্পানি তাদের রসিদে স্মাইলি জুড়ে দিয়ে ধন্যবাদ জানাত ক্রেতাদের। সে স্মাইলির অবশ্য ভ্রু, নাক, এমনকি থুতনিও ছিল! তাদের কাছ থেকে উদ্বুদ্ধ হয়েই কি না কে জানে, ১৯৪৮ সালের পোর্ট অব কল সিনেমায় বেরিট নামের এক চরিত্রকে দেখা যায় আয়নায় লিপস্টিক দিয়ে স্মাইলি আঁকতে। এরপর পঞ্চাশ দশকের ‘লিলি’ ও ‘গিগি’ নামক দুটি সিনেমার প্রমোশনাল ক্যাম্পেইনেও করা হয় স্মাইলির ব্যবহার।
তখনো কিন্তু মানুষ স্মাইলির সঙ্গে এতটা পরিচিত হয়নি। ১৯৬২ সালে নিউইয়র্কের ডব্লিউএমসিএ রেডিও স্টেশন ঠিক করল, যেসব শ্রোতা ফোন কলের উত্তর দেবে তাদের প্রত্যেককেই দেওয়া হবে একটি স্মাইলি আঁকা সোয়েটার। যেই ভাবা সেই কাজ। দেখা গেল নিউইয়র্ক শহরের প্রচুর মানুষ স্মাইলি সোয়েটার পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে! তবে সেই স্মাইলিও কিন্তু এখনকার স্মাইলির মতো ছিল না। বাঁকা হাসির একটা দুষ্টুমি ভঙ্গি ছিল তাতে।
এখন ফেসবুক কিংবা হোয়াটসঅ্যাপে যে স্মাইলি আমরা ব্যবহার করি, তার স্রষ্টা হলেন হার্ভে রস বল, এক আমেরিকান গ্রাফিক আর্টিস্ট। হলুদ বৃত্তে দুখানা চোখের ফোঁটা আর এগাল-ওগাল জোড়া হাসি। ১৯৬৩ সালে স্টেট মিউচুয়াল লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানিকে দশ মিনিটের মাঝে এই ডিজাইন করে দিয়ে তিনি পেয়েছিলেন ৪৫ ডলার, যা এখনকার মূল্যমানে প্রায় ৩৫০ ডলারের সমান। এরপর সারা পৃথিবীতে সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ কোটি স্মাইলি আঁকা ব্যাজ বিক্রি হয়। স্মাইলির জনক বলতে তাই বোঝানো হয় রস বলকেই। তবে ১৯৬৭ সালে সিয়াটলের গ্রাফিক আর্টিস্ট জর্জ টেনাগিও প্রায় একই রকম স্মাইলি ডিজাইন করেন, যা বিভিন্ন ক্যাম্পেইনসহ ব্যবহার হয় সেখানকার নির্বাচনী প্রচারণাতেও।
স্মাইলি আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সত্তরের দশকে, ফিলাডেলফিয়া ব্রাদার্সের কল্যাণে। তাদের বিক্রীত স্মাইলি আঁকা মগ, টি-শার্ট ও স্টিকারের চাহিদা বাড়তে থাকে দিন দিন। ১৯৭২ সালের ভেতরেই বিক্রি হয় প্রায় পাঁচ কোটি স্মাইলি ব্যাজ।
সে বছরই ফরাসি সম্পাদক ফ্র্যাঙ্কলিন লৌফ্রেনি তার পত্রিকার ভালো খবরগুলো স্মাইলি দিয়ে চিহ্নিত করতে শুরু করেন। স্মাইলিকে ‘স্মাইলি’ বলে প্রথম ডাকা আরম্ভ করেন তিনিই। চালু করেন স্মাইলি কোম্পানিও। পরে এই কোম্পানির দায়িত্ব নেন তাঁর ছেলে নিকোলাস লৌফ্রেনি। কোম্পানির পরিসর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একসময় স্মাইলির জনক রস বলের সঙ্গে স্বত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব্ব বাধে তাঁর। নিকোলাসের দাবি, স্মাইলির এমন কী কঠিন ডিজাইন যার স্বত্ব নিয়ে কোমর বেঁধে ঝগড়া করতে হবে? প্রাচীন গুহামানবেরাও তো নানা ধরনের স্মাইলি এঁকে গেছে! পরবর্তী সময়ে দ্বন্দ্ব বাধে জনপ্রিয় কোম্পানি ওয়ালমার্টের সঙ্গেও। স্বত্ব নিয়ে আট বছর ধরে মামলা চলার পর অবশেষে তাদের মধ্যস্থতা হয় ২০১০ সালে। কী ছিল সেই মধ্যস্থতার দাবিগুলোয়? কেউ জানে না!
এ তো গেল অফলাইনের ইতিহাস। ইন্টারনেটে প্রথম স্মাইলির উল্লেখ করেন কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটির ছাত্র স্কট ফেলম্যান। ১৯৮২ সালে তাঁর লেখাতেই কোলন চিহ্নের সঙ্গে ব্র্যাকেট জুড়ে দিয়ে স্মাইলির ব্যবহার প্রথম পাওয়া যায়। এরপর উইন্ডোজ তার অপারেটিং সিস্টেমে নিয়ে আসে Alt+1 কিংবা Alt+2 টাইপ করে সাদাকালো স্মাইলি তৈরির অপশন। সময়ের সঙ্গে একে একে তৈরি হলো দুঃখ, রাগ, বিরক্তি, কান্না আরও নানা ভঙ্গির স্মাইলি, যাকে বলে ইমোজি কিংবা ইমোটিকন। আজকাল ফোনের টেক্সট কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের চ্যাটবক্স, সবখানেই চলে স্মাইলির ব্যবহার। স্মাইলি ব্যবহার করে কথা না বলেও বলে ফেলা যায় অনেক কিছু। ধরো কোনো হাসির কিছু পোস্ট করেছ ফেসবুকে। দেখবে বন্ধুরা আর কিছু লিখুক বা না লিখুক, একগাদা কোলন পি আর কোলন ডিতে ভরে গেছে কমেন্ট বক্স!
তবে সব জায়গায় স্মাইলি দেওয়ার অভ্যাসটা যে খুব সুবিধার নয় তা জানিয়ে রাখি! ভাবো তো, স্কুল বা কলেজের কোনো আবেদনপত্রে যদি লাইনের শেষে অভ্যাসবশত স্মাইলি দিয়ে ফেলো, কেমন গোলমেলে হয়ে যাবে ব্যাপারটা? :)