হোজ্জা, তুমি কার?

হোজ্জা হলেন সবচেয়ে রহস্যময় মানুষ। হোজ্জা কে ছিলেন, কী করতেন, কোথায় ছিলেন, কোথায় জন্ম, কোন দেশের মানুষ, কোথায় মারা গেছেন; এর সবকিছু নিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ করেন পণ্ডিতরা। তুর্কি থেকে আরব, রাশান থেকে চীনা; সবাই দাবি করেন নাসিরুদ্দিন তাঁদের লোক। বহু জায়গায় নাসিরুদ্দিনের কবর বলে দাবি করা হয়, বহু জায়গায় তাঁর জন্মস্থান বলে উৎসব করা হয়। আলবেনিয়ান, আর্মেনিয়ান, আজারবাইজানি, বসনিয়ান, বুলগেরিয়ান, চায়নিজ, ইতালিয়ান, কুর্দিশ, পশ্তু, পার্শিয়ান, তুর্কি, রোমানিয়ান, সার্বিয়ান, রাশিয়ান ও উর্দু ভাষায় তাঁর ‘মৌলিক’ গল্প শোনা যায়। অন্তত এক ডজন দেশ দাবি করে, নাসিরুদ্দিন তাদের দেশের লোক। এবং এই প্রতিটা ভাষায় তাদের নিজেদের মতো করে নাসিরুদ্দিনের নামের আগে-পেছনে বিশেষণ ব্যবহার করা হয়।

তবে পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় নাসিরুদ্দিন গবেষক প্রফেসর মিকাইল বাইরাম ও আরও অনেকে মনে করেন যে পশ্চিম আজারবাইজানে জন্ম হয়েছিল এই পণ্ডিত মানুষটির। পুরো নাম ছিল নাসির উদ্দীন মাহমুদ আল-খোয়ি। তিনি খোরাসানে বিদ্যালাভ করেন এবং কালক্রমে একজন লোকজ ও ধর্মীয় দার্শনিকে পরিণত হন। একপর্যায়ে বাগদাদের খলিফার সুনজরে আসেন হোজ্জা। খলিফা তাঁকে আনাতোলিতে কাজি হিসেবে নিয়োগ দিয়ে পাঠান। সেখানে মোগল আগ্রাসনের সময়ে হোজ্জা আরেক পণ্ডিত রুমির প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ান বলেও গবেষকেরা দাবি করেন। আনাতোলিতে হোজ্জা দ্বিতীয় কায়কায়ুসের মন্ত্রী হিসেবেও নিয়োগ পান।

তবে এসব রহস্যময়তা হোজ্জাকে ম্লান করতে পারেনি। বরং দিনকে দিন তাঁর আবেদন বেড়েছে। এখনো প্রতিবছর ৫ থেকে ১০ জুলাই আখসিরে নাসিরুদ্দিন হোজ্জা উৎসব হয়। ইউনেসকো ১৯৯৬-৯৭ সালকে আন্তর্জাতিক নাসিরুদ্দিন বর্ষ বলে ঘোষণা করেছিল। এখনো পৃথিবীজুড়ে শত ভাষায় প্রতিনিয়ত নাসিরুদ্দিনের সংকলন প্রকাশিত হয়। তাঁকে নিয়েই বিশেষ ম্যাগাজিন প্রকাশ হয়। আমাদের এই বাংলাতে স্বয়ং সত্যজিৎ রায় হোজ্জার কৌতুক সংকলন করেছেন।

নাসিরুদ্দিন হোজ্জার দশটি গল্প

হোজ্জা একবার স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর জন্য এক হেকিমের কাছ থেকে ওষুধ নিয়েছিলেন।

কয়েক মাস পর হোজ্জা তাঁর হেকিমের কাছে গেলেন ওই ওষুধ আনার জন্য।

‘আচ্ছা, গতবার তোমাকে কী ওষুধ দিয়েছিলাম, একেবারেই মনে করতে পারছি না।’

‘তাহলে ওই ওষুধ এখন থেকে আপনি নিজেই খাবেন’, হোজ্জা বিনীত গলায় বললেন।

হোজ্জা একবার উটের গাড়িতে চড়েছেন মাত্র। গাড়িচালক হোজ্জার কাছে ভাড়া চাইল। শুনে হোজ্জা হুড়মুড় করে গাড়ি থেকে নেমে যেতে উদ্যত হলেন। চালক বাধা দিয়ে বলল, ‘ভাড়া না দিয়ে আপনি যাচ্ছেন কোথায়?’

‘আমি হলাম বাদশার খাস বন্ধু। আমার কাছে তুমি ভাড়া চাইছ!’

‘ঠিক আছে, আপনিই যে হোজ্জা, তার প্রমাণ কী?’

হোজ্জা বললেন, ‘তুমি কি আমাকে গাড়িতে উঠতে দেখেছ?’

‘নিশ্চয়ই দেখেছি।’

‘তুমি কি আমাকে চেনো?’

‘না, চিনি না।’

‘তাহলে কী করে জানলে যে আমি গাড়ি থেকে নেমে যাচ্ছি?’

হোজ্জা তাঁর বন্ধুকে চিঠি লিখছিলেন। একজন উৎসুক প্রতিবেশী চুপিচুপি হোজ্জার পেছনে এসে চিঠিতে কী লেখা হচ্ছে, তা পড়তে থাকে।

এদিকে হোজ্জার সামনে ছিল একটা আয়না। ওই আয়নাতেই হোজ্জা লোকটাকে দেখতে পেলেন। তিনি পুরো ব্যাপারটা পাত্তা না দিয়ে চিঠি লিখতে লাগলেন: ‘অনেক কিছুই লেখার ছিল। কিন্তু পারলাম না। ঠিক এই মুহূর্তে একজন অভদ্র ও নির্লজ্জ লোক আমার পেছনে দাঁড়িয়ে চিঠি পড়ছে।’

লোকটা রেগেমেগে অভিযোগ করল, ‘হোজ্জা, আপনি এসব কী লিখছেন? আমি কখন আপনার পেছনে দাঁড়িয়ে চিঠি পড়েছি?’ জবাবে হোজ্জা বললেন, ‘তুমি যদি আমার পেছনে দাঁড়িয়ে চিঠি না পড়তে, তাহলে জানলে কী করে চিঠিতে আমি কী লিখেছি?’

হোজ্জার এক প্রতিবেশী শিকারে গিয়ে নেকড়ের কবল থেকে এক ভেড়াকে বাঁচিয়ে বাড়ি নিয়ে আসে, পালবে বলে। শিকারির যত্নে ভেড়াটি দিন দিন নাদুসনুদুস হয়ে উঠল। একদিন শিকারির লোভ হলো ভেড়ার মাংস খাওয়ার জন্য। তাই জবাই করতে উদ্যত হতেই ভেড়াটি ভয়ে বিকট শব্দে চিৎকার জুড়ে ছিল। ভেড়ার চিৎকারে হোজ্জার ঘুম গেল ভেঙে। ব্যাপারটা বোঝার জন্য সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেশীর বাড়িতে ছুটে গেলেন হোজ্জা।

হোজ্জাকে দেখে শিকারি প্রতিবেশী লজ্জিত গলায় বললেন, ‘এই ভেড়াটার প্রাণ বাঁচিয়ে ছিলাম একবার।’

‘তাহলে ও তোমাকে গালি দিচ্ছে কেন?’

‘গালি দিচ্ছে?’

‘ভেড়া বলছে, “তুমি একটা নেকড়ে।’

একদিন বাদশা হোজ্জাকে বললেন, ‘হোজ্জা, কাল থেকে আমি আর আয়নায় নিজের চেহারা দেখব না। আমার চেহারা যে এত বিচ্ছিরি, তা এত দিনে জানলাম।’

জবাবে হোজ্জা বললেন, ‘হুজুর, মাফ করবেন, আয়নায় নিজেকে দেখে বলছেন আপনি দেখতে বিচ্ছিরি। কিন্তু এই এত দিন সবাই আয়না ছাড়াই আপনাকে দেখতে বাধ্য হয়েছে।’

হোজ্জা একটা দোকান খুলে ওখানে নোটিশ টাঙিয়ে দিলেন, ‘যেকোনো বিষয়ে দুই প্রশ্নের জবাবের বিনিময়ে পাঁচ পাউন্ড।’

একজন পথচারী হন্তদন্ত হয়ে তাঁর কাছে এসে টাকাটা হাতে দিয়ে বলল, ‘দুটো প্রশ্নের জন্য পাঁচ পাউন্ড, একটু বেশি নয় কি?’

‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন’, হোজ্জা বললেন, ‘এর পরের প্রশ্ন?’

হোজ্জার গ্রামে যমজ ভাই ছিল। একদিন শোনা গেল, ওই যমজ ভাইদের একজন মারা গেছে।

রাস্তায় ওই যমজ তাদের একজনকে দেখে হোজ্জা দৌড়ে গেলেন তার দিকে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কোনজন মারা গেছে, তুমি নাকি তোমার ভাই?’

মধ্যরাতে হোজ্জা রাস্তা দিয়ে একা একা হেঁটে যাচ্ছিলেন। গার্ড তাঁকে জিজ্ঞেস করল, ‘এত রাতে রাস্তায় কী করছেন, হোজ্জা?’

‘আমার ঘুম হারিয়ে গেছে, তাকে খুঁজতে এসেছি।’

হোজ্জা এক বিধবাকে বিয়ে করলেন, বিয়ের পাঁচ দিন পর নতুন বউ একটি ছেলেসন্তান জন্ম দিল। হোজ্জা তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে বাজারে গিয়ে স্কুলের ব্যাগ, বই থেকে শুরু করে সব কিনতে শুরু করলেন। মানুষজন তাঁকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি এসব কিনছেন কেন?’

জবাবে হোজ্জা বললেন, ‘আমার বাচ্চা যদি নয় মাসের সফর পাঁচ দিনে শেষ করতে পারে, তাহলে তো সে স্কুলে যাওয়ার জন্য যেকোনো সময় প্রস্তুত হতে পারে।’

১০

একদিন হোজ্জা গাধার পিঠে লবণ বোঝাই করে বাজারের দিকে রওনা দিলেন। পথে একটা নদী পড়ল। গাধাসহ নদী পার হলেন। কিন্তু নদীর পানিতে লবণ গলে একাকার। পণ্য হারিয়ে হোজ্জা বিরক্ত। গাধা তো মহা খুশি বোঝা থেকে বেঁচে গিয়ে।

এর পরের বারও হোজ্জা ওই পথ দিয়ে গেলেন, তবে এবার তুলা বোঝাই করে। গাধা যখন নদী পার হলো, তখন তুলা ভিজে ওজন বেড়ে গেল। গাধা ওজনদার মাল নিয়ে টলমল পায়ে এগিয়ে যেতে লাগল।

‘হাহ্!’ হোজ্জা চেঁচিয়ে বললেন, ‘ভেবেছিলি প্রতিবার পানি দিয়ে গেলে পিঠের ওপরের মালের ওজন কমে যাবে, তাই না?’