৩০ বছরের পথচলা

১৯৯২ থেকে ২০২২। পাক্কা ৩০ বছর। কীভাবে যে এতটা সময় পেরিয়ে গেল, বুঝতেই পারিনি। ’৯২ সালের জানুয়ারিতে বেরিয়েছিল অয়ন-জিমিকে নিয়ে প্রথম বই কালকুক্ষি, আমি তখন নিতান্তই এক কিশোর, দশম শ্রেণির ছাত্র, পড়ি কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজে। আর এখন ২০২২ সালের জানুয়ারিতে যখন সেবা প্রকাশনী থেকে সিরিজের নতুন বই পাইন রিজের ভ্যাম্পায়ার আর কিশোর আলোয় ‘বরফ বিভীষিকা’ প্রকাশিত হচ্ছে, আমি নিজেই তখন দশম শ্রেণিপড়ুয়া এক কন্যার পিতা। কী আশ্চর্য ব্যাপার!

মনে পড়ে যাচ্ছে লেখক হয়ে ওঠার সব স্মৃতি। ছোটবেলায় গল্পের বইয়ের পোকা ছিলাম, বিশেষ করে ছোটদের জন্য লেখা রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনির ছিলাম মস্ত ভক্ত। এক্কেবারে শিশুকাল থেকেই, বলতে গেলে সাত-আট বছর বয়স থেকে, লেখার ভূত চাপল মাথায়। সময় পেলেই বসে যেতাম কাগজ-কলম নিয়ে। ছোট ছোট বইয়ের আকৃতির খাতা বানিয়ে গল্প লিখতাম, ছবি এঁকে প্রচ্ছদ বানাতাম, এমনকি বইয়ের গায়ে দামও লিখে দিতাম। সেসব গল্পের কোনোটাই উল্লেখযোগ্য নয়, সবই শিশুমনের বিচিত্র খেয়াল আরকি! তবে এভাবে লিখতে লিখতে একদিক থেকে লাভ হলো। লেখার ক্ষমতার উন্নতি হলো, গল্পও সাজাতে শিখলাম নিজে নিজে। অষ্টম বা নবম শ্রেণিতে যখন পড়ি, তত দিনে মোটামুটি মানসম্মত লিখতে শিখে গেছি। ছাপানোর জন্য সেসব লেখা কোথাও পাঠাইনি বটে, কিন্তু আমার ক্যাডেট কলেজের বন্ধুরা নিয়মিত পড়ছে আমার হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি, উৎসাহ জোগাচ্ছে, প্রশংসা করছে, আবার ভুলও ধরিয়ে দিচ্ছে। ফলে আত্মবিশ্বাস বাড়ছিল আমার।

বলে রাখা ভালো, তত দিন সেবা প্রকাশনীর বই পড়তে শুরু করেছি। আমার সামনে খুলে গেছে রহস্য-রোমাঞ্চ সাহিত্যের এক নতুন জগৎ। সেবার বইগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় ছিল কিশোর থ্রিলারের বইগুলো। কাজেই একদিন ভাবলাম, নিজেই ও রকম কিছু লিখতে পারি কি না, চেষ্টা করে দেখি। কয়েক দিন ধরে বসে বসে একটা প্লট সাজালাম, সেটা অয়ন-জিমির কোনো কাহিনি নয়। প্লটটা ছিল দুঃসাহসী এক কিশোরকে নিয়ে, মুক্তিপণের জন্য তাকে কিডন্যাপ করে একদল লোক, বুদ্ধি খাটিয়ে কীভাবে সে মুক্ত হয় এবং লোকগুলোকে ধরিয়ে দেয়, তা-ই নিয়ে লেখার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু এক রাতে যখন কাগজ-কলম নিয়ে বসলাম, সবকিছু বদলে গেল। কিডন্যাপিংয়ের ঘটনা দিয়ে গল্প শুরু হলো ঠিকই, কিন্তু তার সঙ্গে যোগ হয়ে গেল লুকানো টাকা, ধাঁধা, দুই দল ভিলেনসহ আরও অনেক কিছু। গল্পের নায়কও হয়ে গেল দুজন—অয়ন আর জিমি। চরিত্র দুটোর মধ্যে আমার নিজের এবং বন্ধুদের অনেক কিছু ঢুকে পড়ল। নিজেও ওদেরই বয়সী ছিলাম কি না, তাই দুই বন্ধুর মধ্যকার খুনসুটি, হাতাহাতি, কথার প্যাঁচ, অ্যাডভেঞ্চারের নেশা—সবই নিয়েছিলাম জীবন থেকে। গল্পের বাকি সবকিছু অবশ্য কাল্পনিক, নিজে নিজে বানিয়ে লেখা। লেখাপড়ার ফাঁকে টানা কয়েক মাস লিখলাম উপন্যাসটা। যখন শেষ হলো, ওটা পড়ে আমার বন্ধুরা উচ্ছ্বসিত। বলল, কাহিনিটা বই হিসেবে বের হওয়ার মতো। আর তা থেকেই উৎসাহিত হলাম পাণ্ডুলিপিটা সেবা প্রকাশনীতে জমা দিতে।

কিছুদিন পর ছুটিতে বাসায় এলাম। ব্যাগের মধ্যে কালকুক্ষির পাণ্ডুলিপি। কী করব বুঝতে পারছি না। ছোট্ট একটা ছেলের পক্ষে একাকী সেবায় গিয়ে লেখা জমা দেওয়া সম্ভব নয়। ঠিকানাই জানি না। ভয়ে ভয়ে আমার ভাই–বোন আর মাকে জানালাম ইচ্ছাটা। শেষমেশ আমার বাবা তাদের কাছ থেকে ব্যাপারটা জানতে পেরে নিজেই আমাকে নিয়ে গেলেন সেবা প্রকাশনীতে। জমা দিলেন পাণ্ডুলিপিটা। এরপর অনেক দিন কোনো খবর নেই। পরেরবার ছুটিতে আসার পর পেলাম ফোন। পাণ্ডুলিপি মনোনীত হয়েছে। আবার গেলাম সেবায়। দেখা হলো কাজী আনোয়ার হোসেন, মানে শ্রদ্ধেয় কাজীদার সঙ্গে। তিনি প্রশংসা করলেন লেখাটার, যেসব ভুলত্রুটি আছে, সেগুলো সংশোধনের জন্য পরামর্শ দিলেন। সবকিছু ঠিকঠাক করে বই বেরোল ১৯৯২ সালের জানুয়ারিতে। মজার ব্যাপার, বই প্রকাশের আগে যতবার সেবায় গেছি, ওখানকার লোকজন আমাকে লেখক বলে চিনতেই পারেনি, বরং আমার বাবাকে ভেবেছে বইয়ের লেখক! কেউ কেউ আবার ভেবেছে, আমি ওখানকার কিশোর পত্রিকার জন্য ছড়াটড়া জমা দিতে গেছি।

ইসমাইল আরমান যখন দশম শ্রেণির ছাত্র

যাহোক, প্রথম বই প্রকাশের পরপরই বেশ সাড়া পড়ে গেল। পাঠকেরা বেশ পছন্দ করল অয়ন-জিমিকে। প্রচুর চিঠি এল সেবায়। ওদের নিয়ে আরও বই লেখার জন্য। কিন্তু আমি তখন লেখাপড়া নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত, একে একে অবতীর্ণ হলাম মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায়। লেখাপড়ার পাট চুকানোর পর ব্যস্ত হয়ে গেলাম চাকরিতে ঢুকে। এত সব ঝামেলার কারণে প্রায় সাত বছর লেগে গেল সিরিজের দ্বিতীয় বই বেরোতে। লেখা অবশ্য পুরোপুরি থামাইনি। অধুনালুপ্ত কিশোর পত্রিকা আর কিশোর তারকালোক–এ লিখেছি অয়ন-জিমির গল্প। সেসব গল্প পরে সংকলন আকারে ছাপা হয়েছে। সেই সঙ্গে ছাপা হয়েছে উপন্যাস। তবে সবই অনিয়মিত। লম্বা বিরতি পড়ে যেত একেকটা লেখার মধ্যে। ৩০ বছর হয়ে গেলেও তাই লেখার সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। একপর্যায়ে তো প্রায় থামিয়েই দিয়েছিলাম সিরিজটা। মনোযোগ দিয়েছিলাম ভিন্ন ধরনের লেখালেখিতে।

অয়ন-জিমি আবার শুরু হওয়ার পেছনে কিশোর আলোর ভূমিকা না বললেই নয়। বলতে গেলে এই পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনুরোধ আর চাপেই কয়েক বছর আগে আবার লিখতে শুরু করলাম ওদের নিয়ে। শুরুটা ছোট আকারের উপন্যাস দিয়ে, আর সেগুলো পড়ে পাঠকদের উচ্ছ্বাস লক্ষ করে সেবা প্রকাশনীও উৎসাহী হয়ে উঠল সিরিজটা আবার চালু করতে। এখন মোটামুটি নিয়মিতই লিখছি অয়ন-জিমির বই আর গল্প। প্রতিক্রিয়া দেখে বুঝতে পারছি, পাঠকদেরও ভালো লাগছে লেখাগুলো।

দেখতে দেখতে ৩০ বছর পেরিয়ে গেল। অয়ন-জিমির তো বটেই, আমার লেখকজীবনেরও। যখন শুরু করি, আমি ছিলাম ওদেরই বয়সী। ৩০ বছর পর ওরা আগের জায়গায়ই আটকে আছে, আমি হয়ে গেছি চল্লিশোর্ধ্ব এক মানুষ। তবে মনের দিক থেকে আজও অয়ন-জিমির মতোই আছি আমি। ওদের সঙ্গে, ওদের নিয়েই বেড়ে উঠেছি কিনা! আমি এখন অনেক ধরনের লেখা লিখি, কিন্তু আজও সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাই অয়ন-জিমিকে নিয়ে লিখে। এই আনন্দটুকুর জন্যই লিখে চলেছি ওদের নিয়ে একের পর এক কাহিনি। যত দিন পারি, লিখে যেতে চাই।