'ফ্রাঙ্কেনস্টাইন' বা আধুনিক প্রমিথিউসের গল্প

ঝোড়ো বৃষ্টির গভীর রাত, মরদেহে প্রাণ সঞ্চার হয়েছে, জেগে উঠেছে অশুভ কিছু, বিশাল তার দেহ, হলুদ ঘোলাটে চোখ, বীভৎস চেহারা নিয়ে ধেয়ে আসছে এক দানব নিরীহ সায়েন্টিস্টের দিকে, যেন তাকে ছুঁতে চায়! এ রকমই এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিলেন মেরি শেলি। আজ থেকে ২০০ বছর আগে এই স্বপ্নের পরিণতিতে সৃষ্টি হয়েছিল বিশ্বের প্রথম সায়েন্স ফিকশন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন।

মাত্র ১৯ বছর বয়সী কিশোরী মেরি শেলির মাথায় এ রকম অভূতপূর্ব আইডিয়া কীভাবে এসেছিল, তা রহস্যজনক। ১৮১৬ সালে গ্রীষ্মকালে সুইজারল্যান্ডের লেকসাইডে অবসর যাপনকালে তিনি সাহিত্যচর্চায় মন দেন। এ সময় মেরি শেলি, তাঁর স্বামী পার্সি বিশি শেলি, কবি লর্ড বায়রন এবং ডাক্তার জন পলিডরি বেশ মজার এক বাজি ধরেছিলেন যে কে কত ভালো ভুতুড়ে গল্প লিখতে পারেন। নিঃসন্দেহে সেই বাজিতে মেরি শেলি জিতেছিলেন! যদিও প্রথমে তাঁর মাথায় তেমন কোনো আইডিয়া আসেনি। তাঁর ভাষ্যমতে, এই ব্যাপারে ভাবতে ভাবতে তিনি ঘুমিয়ে যান এবং অদ্ভুত একটি স্বপ্ন দেখেন।

শেলির ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের প্রথম সংস্করণের প্রথম পাতা (ভলিউম-১)
শেলির ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের প্রথম সংস্করণের প্রথম পাতা (ভলিউম-১)

১৮১৮ সালে প্রথমবারের মতো ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তিন ভলিউমের সায়েন্স ফিকশন হিসেবে প্রকাশিত হয় লেখকের নাম ছাড়াই! বইটির পুরো নাম ছিল ফ্রাঙ্কেনস্টাইন অর দ্য মডার্ন প্রমিথিউজ। গ্রিক পুরাণমতে, দেবতা প্রমিথিউস কাদামাটি থেকে রক্তমাংসের মানুষ সৃষ্টি করতেন, যা এই ফিকশনের প্রধান চরিত্র ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের সঙ্গে মিলে যায়। অনেকেই ভাবতেন, ফিকশনটির লেখক পার্সি বিশি শেলি। কিন্তু ১৮৩১ সালে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণে মেরি শেলির নাম আসে এবং এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

এখন পর্যন্ত শতাধিক ভাষায় বইটি অনুদিত হয়েছে এবং ১৩০টির বেশি চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন–এর গল্প অনুসারে। ১৯১০ সালে টমাস এডিসন ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের ওপর প্রথম চলচ্চিত্র তৈরি করেন, যা ছিল নির্বাক এবং মাত্র ১২ মিনিটের। এ ছাড়া ইংরেজি সাহিত্যের অনেক চরিত্র ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ থেকে অনুপ্রাণিত। চার্লস ডিকেন্সের গ্রেট এক্সপেকটেশনস বা রবার্ট লুই স্টিভেনসনের ‘ড. জেকিল এবং মি. হাইড’–এর চরিত্রগুলো ফ্রাঙ্কেনস্টাইন–এর কাছে ঋণী হয়ে আছে।

ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ক্যাসেল
ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ক্যাসেল

‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ একটি জার্মান শব্দ। ‘Frank’ মূলত জার্মানির একটি উপজাতির নাম আর ‘Stein’ অর্থ পাথর। জার্মানিতে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন নামে একটি ক্যাসেল বা দুর্গও রয়েছে। যেখানে কোনার্ড ডিপেল নামের এক খ্যাপাটে বিজ্ঞানী ছিলেন, যে কিনা কবর খুঁড়ে মরদেহ বের করে গবেষণা করতেন। অনেকের মতে, মেরি শেলি জার্মানির এই ক্যাসেল এবং বিজ্ঞানী সম্পর্কে শুনেছিলেন, যদিও তিনি নিজে এই ব্যাপারে কিছু বলেননি।

চলচ্চিত্রে ড. ফ্রাঙ্কেনস্টাইন
চলচ্চিত্রে ড. ফ্রাঙ্কেনস্টাইন

এখনো কোনো ভয়ঙ্কর বা অশুভ কিছু বোঝাতে আমরা ফ্রাঙ্কেনস্টাইন শব্দটি ব্যবহার করি। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এই কাহিনির মূল চরিত্র যে বিজ্ঞানী, তারই পুরো নাম ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। আর কাহিনি অনুসারে তার সৃষ্ট দানবটির কোনো নাম উল্লেখ করা হয়নি। প্রকৃতির রহস্য পুরোপুরি উন্মোচিত করতে গেলে কেমনভাবে সবকিছু হারাতে হয়, তা এই কাহিনির বড় শিক্ষা। 


তথ্যসূত্র: দ্য ফ্যাক্ট সাইট, মেন্টাল ফ্লস