উত্তরহীন প্রশ্ন

অলংকরণ: আপন জোয়ার্দার

চারদিকে নিকষ কালো আঁধার। হঠাৎ আম্মু বলল, অনেক জোরে চিৎকার শোনা যাচ্ছে। এটা নিঃসন্দেহে ফাল্গুনীর কণ্ঠ। তখন বাজে রাত ১: ৪৬। চিৎকার শুনে শ্রাবণী লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠে তাড়াতাড়ি ফাল্গুনীর ঘরে গেল। যথারীতি মা-ও উপস্থিত। দুজনেই এসে দেখে, ফাল্গুনীর চোখে পানি। ব্যাপার কী? কিছুই বুঝতে পারছে না। তখনই শুনতে পেল, ফাল্গুনী ফোনে তার বাবাকে বলছে, ‘আব্বু, আমি রুয়েটে চান্স পেয়েছি। সিরিয়ালও সামনের দিকে।’ ফাল্গুনীর কথা শুনে শ্রাবণী ও আম্মু খুব খুশি। এতক্ষণে শ্রাবণী বুঝল আসল ঘটনা কী! তবে এবার রাগ উঠল ওর। এটার জন্য কেউ এত রাতে এভাবে চিৎকার করে? কিন্তু মুহূর্তেই তার মনে প্রশ্ন জাগে, ‘এই রাগের কি কোনো অর্থ আছে?’ একবার মনে হলো অবশ্যই আছে। কষ্ট করেছে, তাই চান্স পেয়েছে। সামান্য ব্যাপার। এর জন্য এত রাতে চিৎকার দিয়ে মানুষের ঘুম ভাঙাতে হবে? আবার মনে হলো না, নেই। চান্স পাওয়াটা ফাল্গুনীর কাছে অবশ্যই একটা বিশাল ব্যাপার। কারণ, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার স্বপ্ন। ছোটবেলা থেকেই ফাল্গুনীর স্বপ্ন ইঞ্জিনিয়ার হবে। আজ তার সেই দিন, যেখানে সে স্বপ্নপূরণে এক ধাপ এগিয়ে গেল। তাই চিৎকার করাটা অস্বাভাবিক নয়‌। শ্রাবণী রীতিমতো দ্বিধায় পড়ে গেল। দুটিই যুক্তি মানে। বুঝতে পারছে না, আসল উত্তর কোনটা? কী করবে এখন সে? উত্তর খুঁজবে? নাকি শুয়ে পড়বে? ঘড়ির দিকে চোখ দিল সে। এখন বাজে ২: ১৫। অতএব শুয়ে পড়াই উত্তম। সে তার নিজের রুমে ফিরে গেল। চোখ বুজতে না বুজতে তার মনে আবার প্রশ্নরা নাড়া দেয়। এ মুহূর্তে আপির মনে কী রকম অনুভূতি হচ্ছে? তার মনে এখন কী চলছে? আনন্দের তুফান? নাকি আত্মবিশ্বাসের জোয়ার? নাকি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা? এসব প্রশ্নেরও উত্তর নেই তার কাছে।

স্রোতের মতো অবিরাম বয়ে চলা সময় কি আর আটকে থাকে! দেখতে দেখতে এক মাস কেটে গেল। এখন ফাল্গুনীর রাজশাহী যাওয়ার পালা। বেলা দুইটায় ট্রেন। ঠিক হলো মা ও বাবা যাবে তাকে ট্রেন পর্যন্ত এগিয়ে দিতে। স্কুল থাকায় যেতে পারবে না শ্রাবণী। স্কুল থেকে ফিরে এসে শ্রাবণী দেখল, ফাল্গুনীর ঘরে অন্ধকার। অদ্ভুত! রাত আটটা বাজে। আপি এখনো কেন ঘুমাচ্ছে? পরক্ষণেই তার মনে পড়ল, আজ তো আপি চলে গেছে। আচমকা শ্রাবণী লক্ষ করল, তার যেন একটু খারাপ লাগছে। কিন্তু কেন? ফাল্গুনী দূরে চলে যাওয়ার কারণে? অথচ সে চলে যাওয়ার আগে তার সঙ্গে শ্রাবণীর ঝগড়া হয়েছে। হিসাবমতো খারাপ লাগার কথা নয়। তাহলে এই খারাপ লাগাটা কেন? আচ্ছা, জীবন তো সব সময় হিসাবমতো চলে না। তাহলে জীবন কি সেই অঙ্ক, যা কষতেই থাকবে, কিন্তু হিসাবটা বরাবরই গরমিল? এবারও উত্তর পেল না সে।

শ্রাবণী সবে ক্লাস টেনে উঠেছে। বাসা থেকে স্কুল বেশ দূরে। কিন্তু ছোট থেকে যে অভ্যাস গড়ে উঠেছে, দূরত্ব তার কাছে প্রতিনিয়ত হার মেনেই নেয়। ব্যাচ-স্কুল-পড়ালেখা। প্রতিদিন এই চরকার মতো ঘোরা আর অসহ্যকর জার্নি; কষ্ট তো হয়ই, কিন্তু ব্যস্ততা ঠিক সব মানিয়ে ফেলে। নিয়মমাফিক রুটিন বিরামহীনভাবে চলতেই থাকে...

শ্রাবণী ভেবেছিল ফাল্গুনী রাজশাহী চলে যাওয়ায় তাদের মধ্যে যোগাযোগ কমে যাবে। কিন্তু তা সত্যি হয়নি। দিন শেষে তারা দুজনেই অল্প সময়ের জন্য হলেও কথা বলে। ভাগাভাগি করে তাদের প্রতিদিনের নিয়মের বাইরে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো। কখনো কখনো গুছিয়ে নেয় নিজেদের জীবনের সিদ্ধান্তহীনতায় আটকে পড়া গল্পগুলো।

কিছুদিন পর সবার কল্পনার জগৎকে শূন্য নম্বর দিয়ে মার্চ মাসে দেখা দেয় ‘করোনা’ মহামারি। পুরো পৃথিবী যেন হঠাৎ করে প্রচণ্ড ধাক্কায় থেমে যায়। মরুভূমির বালুর মতো সীমাহীন পর্দায় ঢাকা পড়ে প্রত্যেকটা মানুষের অন্তরের স্বপ্নগুলো। প্রতিনিয়ত টুকরা টুকরা হতে থাকে ভালোবাসাগুলো। যার কারণে দেশের সব স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি ১৫ দিনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফাল্গুনী ঢাকায় চলে আসে। শ্রাবণী কখনো ভাবেইনি এই ১৫ দিন, ১৫ মাসকেও ছাড়িয়ে যাবে।

ফাল্গুনী কলেজে ওঠার পর থেকে দুই বোন সেভাবে একসঙ্গে সময় কাটাতে পারত না। কারণটা? ব্যস্ততা। তারা যেন ব্যস্ততা নামের খাঁচায় বন্দী পাখি। তাই করোনার বন্ধ তাদের অনেকটা সময় তৈরি করে দিয়েছিল। পরিবারের সবাইকে সময় দেওয়ার পাশাপাশি দুজনে একসঙ্গে বেশ ভালোই সময় কাটাত। যুক্ত হতো তাদের খালাতো বোন কাজল ও ছোট বোন চৈত্রীও। তৈরি হতো ছোট ছোট সুন্দর স্মৃতির ট্রেন এবং উত্তর না থাকা প্রশ্নের। কবে সব ঠিক হবে? কবে সবাই আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবে? কবে স্বপ্নারা আবার দেখা দেবে? উড়াল দেবে সাদা মেঘের পাশ দিয়ে সীমাহীন আকাশটায়? কবে সবাই আবার প্রাণ খুলে বাঁচবে? নিশ্বাস নেবে দ্বিধা ছাড়াই?

দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটে ১৭ মাস পর। সবকিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। আগের মতো? না, নতুন করে। সেই সঙ্গে অবসান ঘটে ব্যস্ততাহীন দিনগুলোর এবং বলতে না পারা কিছু অসহ্যকর অনুভূতিগুলোর। শুরু হয় ব্যস্ততার পালা। তার সঙ্গে সঙ্গী হয় বিদায়ের বেলা। ভার্সিটি খুলে যাওয়ার কারণে ফাল্গুনীকে তো রাজশাহী যেতেই হয়। এবার তাকে ট্রেন পর্যন্ত এগিয়ে যেতে যায় তার মা। তবে বাবা অফিসের কাজে আটকা পড়ায় যেতে পারে না। বাবার পরিবর্তে যায় শ্রাবণী ও কাজল। স্টেশনের উদ্দেশে বেরিয়ে সহসা শ্রাবণী বুকের মধ্যে কষ্ট অনুভব করে। আনমনে খোলা আকাশে প্রশ্ন ছোড়ে, ‘বিদায়বেলাটা কেন কষ্টের হয়? বাস্তবতাকে কি সে মানতে রাজি নয়?’ অস্বস্তি হচ্ছে তার। উত্তর নেই যে!

ঠিক বেলা ১টা ৩০ মিনিটে তারা স্টেশনে পৌঁছাল। ট্রেনের সময় বেলা দুইটা। ফলে দাঁড়িয়ে অপেক্ষমাণ ফাল্গুনী এবং তাকে বিদায় জানাতে আসা লোকজন। নাহ্‌, ভুল হলো; ‘প্রিয়জন’। দুটো পেরিয়ে ৩০ মিনিট। অথচ ট্রেনের দেখাই নেই। খোঁজ নিয়ে জানা যায় ট্রেন আসতে দেরি। বেড়ে যায় অপেক্ষার প্রহর। ৩টা ৩ মিনিটে স্টেশনে হাজির হয় ট্রেনটি। সমাপ্তি ঘটে অপেক্ষার। সঙ্গে সঙ্গে শোনা যায় মাইকের আওয়াজ। খুব জলদি ট্রেন ছাড়ার ঘোষণা। দেরি না করে ফাল্গুনী ট্রেনে উঠে পড়ে। যথারীতি ট্রেন ছেড়েও দেয়। ফাল্গুনীকে বিদায় জানানোর পর শ্রাবণীর চোখ যায় লাইনের ওপারে খেলা করা দুটি বিড়ালের বাচ্চার দিকে। কয়েক মুহূর্ত পর সে ঘুরে তাকায় মায়ের দিকে। মা এখনো ওদিকে তাকিয়ে আছে। ট্রেন চলে গেছে অনেকক্ষণ। বিন্দুমাত্র পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। অথচ মায়ের দৃষ্টি অনড়। শ্রাবণী হঠাৎ আবিষ্কার করল, মায়ের চোখে পানি। তার জানতে ইচ্ছা করল, এখন মায়ের ঠিক কেমন অনুভূতি হচ্ছে? শ্রাবণী বোঝার চেষ্টা করল। পারল না। কিন্তু কেন? কেন মানুষ চোখে দেখতে পেয়েও অন্যের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো বুঝতে পারে না? কেন অনুভব করতে পারে না সামনের মানুষটির অন্দরমহলে বয়ে যাওয়া অবিরাম জোয়ার-ভাটা কে? বরাবরের মতো আবারও শ্রাবণীর মনে ভিড় জমছে উত্তরহীন প্রশ্নের।