ডায়েরির শেষ পাতা

কোন দিনটা মায়ের বকুনি ছাড়া শুরু হয়? রাত আড়াইটা পর্যন্ত পড়ার পর ছয়টায় ডেকে দিয়েছে আবার। তিন ঘণ্টা ঘুমালে চলবে কীভাবে! রোজ এভাবে ঘুম থেকে উঠেই পড়তে বসতে হয়। তারপর স্কুল। পড়ালেখার চাপ! ফিজিকস, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি, বাংলা, অঙ্ক কোচিং করে মনে হয়, কেউ যদি রোজ আমার কাঁধে সিমেন্টের বস্তা চাপিয়ে কাজ করাত, তা-ও আমি পারতাম। কিন্তু যে বোঝা আমার কাঁধে চাপানো হচ্ছে, তা অসহনীয়। চাপ সামলাতে গিয়ে স্বপ্নের কথাই ভুলে গেছি। ইংরেজি সাহিত্যে পড়ার স্বপ্ন ছিল। ‘আর্টস’ পড়ার ইচ্ছেটারই বা কী হলো! সায়েন্স পড়লে তো মা ডাক্তার বানিয়েই ছাড়বে! মানুষের কি নিজস্ব কিছু ইচ্ছা থাকে না? কেন মায়ের ইচ্ছাকে নিজের ইচ্ছায় পরিণত করতে যাচ্ছি? সায়েন্স পড়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও কখনো হয়নি। কিন্তু মা কি বুঝবে? স্কুল থেকে ফিরলেই তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী গোসল, লাঞ্চ করে কোচিংয়ে যাই। ফিরি সন্ধ্যায়। তখন বুয়েটের এক ভাইয়া এসে নয়টা পর্যন্ত পড়ান। এভাবেই রাত গড়িয়ে দিন শুরু হয় আমার।

শুধু মা নয়, আমার প্রিয় শিক্ষকও সেদিন বললেন, ‘সায়েন্স না পড়লে জীবনে কিছুই করতে পারবে না।’

তারা কি বোঝে না যে আমি আর পারছি না? কেন আর্টস পড়তে দিল না? আর্টস কি খারাপ? বাবা বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই আর্টস পড়তে পারতাম আমি। বাবা ছাড়া কাউকে মনের কথা বলার সাহস কখনো হয়নি। তাই ডায়েরিতে লিখে কষ্ট জমাই। আমি এখনো ছোট, কিন্তু স্বপ্ন দেখতে তো বাধা নেই। বাধা দেয় পরিস্থিতি, বাধা দেয় কাছের মানুষগুলো।

ফিজিকস ভালো লাগে না। মাথায়ও ঢোকে না। সহপাঠী ফিজিকসে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে ২০-এ ১৮। আমি পেয়েছি ১৬। মা বলছে, ‘তোমার পেছনে এত ছোটাছুটি করেও কোনো লাভ হয় না। ও ১৮ পায়, তুমি কেন ১৬ পাও? তোমাকে কোন সুবিধাটা দেওয়া হচ্ছে না? ৮ হাজার টাকা দিয়ে বাসায় টিচার পর্যন্ত দিলাম, তারপরও গরজ হয় না, তা-ই না? একেবারে পিটিয়ে ছাল-চামড়া তুলে দেওয়া উচিত।’ আমার হৃদস্পন্দন যাচ্ছিল। আর কত চেষ্টা করব? কত দিন টিভির রিমোট ধরিনি, গানের ‘গ’ও দাওনি শুনতে। সেদিন পড়া মুখস্থ হয়নি বলে গালে দুটো চড় মেরেছে মা, খুব লেগেছিল। অবশ্য এসব এখন রোজকার পাওনা। কাল ফিজিকস কোচিংয়ে পরীক্ষা। মা বলেছে ‘হাইয়েস্ট’ না পেলে সবার সামনে চড় মারবে। কী হবে তা ভাবতে ভাবতেই ১০টা বেজে গেল। পড়া হয়নি, কী করি এখন! মাখা ঘুরছে, বমি আসছে। মনে হচ্ছে এখনই পড়ে যাব। মাকে বললে বলবে যে এসব আমার পরীক্ষা না দেওয়ার যত অজুহাত। কিন্তু পরীক্ষায় ভালো না করলে যে সর্বনাশ হয়ে যাবে!

মা, প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো। এখন তুমি আমায় বুঝতে পারলে না, কেন এত চাপে রাখলে আমাকে? এই সায়েন্স, স্কুল কোচিংয়ের পড়ালেখার চাপ আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না মা!