অভির মনটা খুবই খারাপ। আজ পরীক্ষার রেজাল্ট দেবে। সে এমনিতে ভালো ছাত্র। তবে এবার গণিত পরীক্ষা খুবই খারাপ হয়েছে। এক থেকে দশের মধ্যে আসার কোনো সম্ভাবনাই নেই। কষ্টে ওর চোখে পানি এসে গেল। এখন বাজে আটটা। ১০টার মধ্যে স্কুলে রেজাল্ট দিয়ে দেবে।
তখনই ওর রুমের জানালায় এসে বসল একটা নীল পাখি। ইশ্! ও যদি একটা পাখি হয়ে যেতে পারত। তাহলে কোনো চিন্তা থাকত না। শুধু নীলাকাশে উড়ে বেড়ানো। কেন যে সে মানুষ হলো!
‘পাখি হতে চাও?’—অভি চমকে ওঠে। আরে, পাখিটা কথা বলছে! নীল পাখি ঠোঁট নেড়ে আবার বলে ওঠে, ‘পাখি হতে চাও নাকি?’ অভি কিছু না বুঝেই মাথা নাড়ল। ‘সত্যি? কিন্তু কেন?’
‘আজ পরীক্ষার রেজাল্ট দেবে। খুবই খারাপ পরীক্ষা হয়েছে, তুমি কি সত্যিই আমাকে পাখি বানাতে পারবে? তাহলে আম্মুর ধমক থেকে বাঁচা যায়! বানিয়ে দাও না, প্লিজ।’
‘কিন্তু তোমার মা তো খুব কষ্ট পাবে।’
‘তাতেই তো ভালো! কষ্ট পেলে তো আর বকতে পারবে না, আমি ঠিক দুদিন পরেই ফিরে আসব। আমাকে দেখে আম্মু এতই খুশি হবে যে বকার কথা মাথাতেই আসবে না।’
নীল পাখিটা ঠিক মানুষের মতো হাসল। আর দেখতে দেখতেই হঠাত্ উধাও হয়ে গেল সিনেমার দৃশ্যের মতো।
এরপরই অভি লক্ষ করল ওর শরীর নীল আর ছোট হয়ে যাচ্ছে। ওর হাত দুটোও কী সুন্দর ডানা হয়ে গেল!
২
টিচার সব ছাত্রের রেজাল্ট কার্ড নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন ক্লাসরুমে। প্রত্যেক ছাত্রের ফলাফল অভিভাবকের হাতে দেবেন। আর তখন জানালায় একটা নীল পাখি বসে ডাকতে থাকে। এর কারণেই কিনা কে জানে, এক ছাত্রের গণিতের নম্বর ৫৯-এর বদলে ৯৯ হয়ে গেল!
৩
অভি অনেকক্ষণ উড়ে হয়রান হয়ে গেছে। বাসা থেকে তিন মাইল দূরের হিজলগাছটায় বসল বিশ্রাম নিতে। আর বসতেই ওর গা ঘেঁষে ভোঁ করে উড়ে গেল একটা বড় ইটের টুকরো। ও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, দুটো ছেলে ওকে লক্ষ্য করেই গুলতি থেকে ইট ছুড়ছে। অভি ভয় পেয়ে যেই ডানা ঝাপটে উড়তে গেল, তখনই একটা ইট এসে ঠিক ওর বাঁ পায়ে আঘাত করল। মট করে কাঠির মতো ভেঙে গেল ওর পা। ইশ্! এখন যদি অভি মানুষ হতো তাহলে দেখিয়ে দিত বাচ্চাগুলোকে! অভি অনেক কষ্টে ভাঙা পায়ের ব্যথা নিয়েই উড়ে ছেলেদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরে গেল। কিন্তু তখনই উদয় হলো আরেক বিপদ। ওর মাথার ওপরে একটা বড় চিল উড়ছে। আর দেখতে দেখতেই চিলটা বাতাস কেটে বুলেটের মতো ওর দিকে আসতে লাগল। হায় হায়! পাখিটা কি ওকে মারার তালে আছে নাকি? ওর ধারণাই ঠিক। পাখিটা সোজা ওর বাঁ পাখায় ঠোকর মারল উড়ে এসে। অভি টাল সামলাতে না পেরে নিচে ঝোপের মাঝে পড়ে গেল। ঝোপটা পুরো কাঁটায় ভরা। কিন্তু তাতেই কাজ হলো। পাখিটা আর ঝোপের দিকে আসছে না। তবে ওপর দিয়ে চিলটা এখনো গোল গোল হয়ে ঘুরছে। ঘুরতে থাক! ওকে আর পাবে না।
কিন্তু বিপদ তখনো শেষ হয়নি। কোথা থেকে ফোঁস করে একটা সাপ এসে পড়ল ঠিক তার পাশেই। অভি আতঙ্কে পা আর ডানার ব্যথার কথা না ভেবেই ডানা ঝাপটে দিল। কাঁটার ঝোপ পার হয়ে সামান্য উড়ে গিয়ে আটকে পড়ল শুকনো ডোবার কাদার মধ্যে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আর দিনের শেষ আলোতেই অভি দেখতে পেল, তুমুল বেগে আকাশ আর মাটি দিয়ে আসছে ওর শিকারিরা। ওর চোখ দুটো এমনিতেই বন্ধ হয়ে গেল। ইশ্! কেন যে মানুষ হলো না এখন!
৪
আরে! অভি চমকে উঠল। ও নিজের বিছানায় শুয়ে আছে! আর একদম মানুষরূপে! দড়াম করে সে বিছানা থেকে উঠে বসে। আর তখনই ওর চোখে পড়ে রেজাল্ট কার্ড। কার্ডটা খুলে ওর অবাক হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। সে ফার্স্ট হয়েছে! আর...আর গণিতে ৯৯!
পাশের রুম থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে। অভি রেজাল্ট কার্ড রেখে পাশের রুমে গিয়েই দেখে তার আম্মু চিন্তিত মুখে এক পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলছে। আর মা খালার পাশে বসে ক্রমাগত কাঁদছে। মায়ের কান্না দেখে অভি আর থেমে থাকতে পারল না। দৌড়ে গিয়ে শুয়ে পড়ল মায়ের কোলে। মায়ের কোলে থাকলে তার কোনো বিপদ নেই! কোনো ভয় নেই! মানুষের জীবন কত সুন্দর!
অভির মনের এই কথাটাকে সমর্থন করতেই যেন বাসার পাশের গাছ থেকে ভেসে উঠল একটা পাখির ডাক। অভি এই পাখিটাকে চেনে!