ছোট মামা বলল, একটা জায়গায় যাবি?
ছোট মামা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। মামা যখন এ রকম চোখ বড় বড় করে তাকায়, তখন আমার ভয় হয়। খুব অদ্ভুত কোনো বিষয় নিয়ে মেতে উঠলেই মামার চোখের এ অবস্থা হয়। শেষবার হয়েছিল গত ঈদে। চাঁদরাতে মামার চোখ হঠাৎই বড় বড় হয়ে গেল। বলল, চল ছাদে যাই! ছাদে একটা মজার জিনিস আছে!
আমরা গেলাম হইচই করতে। মজার জিনিস দেখতে কারই না ভালো লাগে। ছাদে একটা খরগোশ আর কচ্ছপ। কোথা থেকে নিয়ে এসেছে কে জানে! মামা বলল, যখন ছোট ছিলি তখন গল্প পড়েছিলি না...কচ্ছপ আর খরগোশের দৌড় প্রতিযোগিতা?
আমরা মাথা নাড়ালাম। মামা বলল, আজকে সেই প্রতিযোগিতা দেখবি!
মামা হুইসেলে ফুঁ দিল। আর আমাদের অবাক করে কচ্ছপ আর খরগোশটা হাঁটতে শুরু করল। ঘটনা ভালোই এগোচ্ছিল, কিন্তু এরই মধ্যে বাবা চলে এল ছাদে। আমাদের কাণ্ড দেখে প্রাণী ও প্রাণ ইত্যাদি নিয়ে বিরাট একটা লেকচার দিয়ে আমার কান মুচড়ে, রিয়াদের মাথায় চাঁটি মেরে, মামাকে বিস্তর বকাঝকা করে নিচে নেমে গেল। আমাদের চাঁদরাতের খুশি ভেজা পটকার মতো হয়ে গেল... ফুসসসস!
অতএব ছোট মামা কিছু বললে, বিশেষত চোখ বড় বড় করে কিছু বললে, আমার ভয় হয়। আমি আরও সাবধান হয়ে যাই।
কিন্তু রিয়াদ আর টুসি তো আমার মতো চালাক না। মামা বলতেই তারা অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পেয়ে গেল। যাওয়ার জন্য লাফাতে শুরু করে দিল। আমি একটু মিনমিন করে বললাম, আসলে যাচ্ছি কোথায়?
মামা কিছু বলল না। হাসল শুধু।
২
এদিকটা নির্জন। শুধু কুলকুল পানির আওয়াজ। দাঁড়িয়ে আছি হাতিরঝিলে। আমি, রিয়াদ, টুসি আর আমাদের ছোট মামা। টুসি সবার ছোট বলে তার ভয় লাগছে না। রিয়াদটা বোকা...সে কারণে তারও যে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে, তা বলা যাচ্ছে না। কিন্তু ভয় লাগছে আমার। কেমন থমকানো আবহাওয়া। দূরের রাস্তার গাড়ির আওয়াজ ভেসে আসছে অল্পসল্প। কিছুদিন থেকে একটানা বৃষ্টি হচ্ছে বলে অনেক পানি ঝিলের ভেতর দিয়ে নেমে যাচ্ছে। ছোট মামা কিছুক্ষণ পরপর মোবাইলে সময় দেখছে। আমি যে তার দিকে তাকিয়ে আছি, সেটা বুঝতে পেরেই বলে উঠল—ঠিক আটটা চল্লিশে আসে, বুঝলি!
‘কী আসে?’
‘আরে আছে আছে...এলেই বুঝতে পারবি!’
আমিও আমার মোবাইল বের করে সময় দেখে নিলাম চট করে। আটটা ছত্রিশ বাজে। মানে আরও চার মিনিট। কিন্তু এই নির্জন জায়গায় চার মিনিটও যে কতক্ষণে পার হবে কে জানে!
চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি অনেকক্ষণ। আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি। এই বৃষ্টি ভয়ংকর। কিছুতেই ছেড়ে যাবে না। আমি বললাম, মামা ভিজে যাচ্ছি তো!
ছোট মামা বলল, বৃষ্টি হচ্ছে, ভিজবিই তো। এটা আবার বিতং করে বলার কী আছে? টুসি রুমাল নিবি মাথায়?
টুসি বলল, না মামা। বৃষ্টিতে ভিজতে তো আমার খুব ভালো লাগছে।
ছোট মামা আমার দিকে ভ্রু নাচাল। যেন বলতে চাইছে, টুসির মতো ছোট্টজনও ভিজতে পারে, আর তোর মতো আস্ত ষাঁড় বৃষ্টিতে কাবু হয়ে যাচ্ছে?
আমি রিয়াদকে ফিসফিসিয়ে বললাম, এখানে ভাল্লাগছে না রে! চল...যাই…
রিয়াদ বলল, কী বলো ভাইয়া, মামা না কী দেখাবে!
রিয়াদেরও চোখ বড় বড় হয়ে গেল। গাধা একটা। মামার মতোই সব কিছুতেই তার উত্তেজনা।
৮টা ৪২ বেজে গেল!
আমি বললাম, কই মামা… কিছুই তো এল না। এবার চলো!
মামা বলল, আরেহ দাঁড়া না!
‘বলবে তো কী আসবে?’
‘বুঝবি বুঝবি। এলেই বুঝবি!’
মামার আরাধ্য জিনিস আসুক না–আসুক বৃষ্টি আরও জোরে আসা শুরু করল। আমি বললাম, থাকো তোমরা! এই রাতের বেলা বৃষ্টির মধ্যে তোমরা যারই অপেক্ষায়ই থাকো, আমি আর থাকছি না! আমি গেলাম…
চলেই যাচ্ছিলাম কিন্তু তখন একটা সড়সড় আওয়াজ। বাঁয়ে তাকাতেই দেখি কী জানি একটা উঠে আসছে ঝিলের পাড় থেকে। বৃষ্টির মধ্যে ঠিক ঠাওরও করা যায় না। একটা ছায়ার মতো। হঠাৎই দেখি আমাদের সামনে। ধড়াস করে উঠল বুকটা। একটা মানুষ। কিন্তু ছোট মানুষ। অনেক ছোট। উচ্চতায় টুসির চেয়েও ছোট। কিন্তু বয়সে অনেক বড়। মুখের চামড়ায় কোঁচকানো ভাব। তাকে ঘিরে কেমন আঁশটে একটা গন্ধ!
মামা লাফিয়ে উঠল—এসে গেছে...জুজু এসে গেছে!
জুজু?
কী ঘটছে, কিছুই বুঝলাম না। মামা খুব তাড়াতাড়ি পকেট থেকে কী যেন বের করে দিল মানুষটার হাতে। মানুষটা খিলখিল করে হেসে উঠল। অদ্ভুত হাসি। কোনো কারণ ছাড়াই আমার গা শিউরে উঠল। মামা বলল, কী...বলেছিলাম না, খুব অদ্ভুত জিনিস!
‘একে দেখার জন্যই এই বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি?’
মামা বলল, ও কে…জিজ্ঞেস কর না!
কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মানুষটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার নাম জুজু। জুজু! জুজু!
এবার মামা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। টুসিও হাসল, রিয়াদও। গাধা আর কাকে বলে!
আমাদের একপলক দেখেই লোকটা আবার সাঁৎ করে নেমে গেল। ধাপুস ধুপুস আওয়াজ করে একেবারে ঝিলের পাড়ে। মামা মাথা নাড়িয়ে বলল, ভেরি ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার। ওকে নিয়ে খবর হওয়া দরকার!
বৃষ্টিতে ভিজে আমাদেরই খবর হয়ে গেছে...এই খবর মামাকে কে দেয়। কিন্তু মামা কি আর থামবে...
‘শোন, হয়েছে কী...একদিন এ রকম সময়েই বসে ছিলাম এখানে। বাদাম খাচ্ছিলাম বসে বসে। হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হলো এই জুজু। মানে ও বলল ওর নাম নাকি জুজু।’
টুসি বলল, গল্পের জুজু মামা?
‘হুম। সেই জুজু। সেদিন আমার হাতে বাদাম ছিল। বাদাম খেতে খেতে কত গল্প করল। বাদাম বোধ হয় খুব পছন্দ তার!’
রিয়াদ গাধাটা বলল, মামা, জুজু না ধরে নিয়ে যায় সবাইকে?
‘যায়ই তো। সে বলেছে, যাকে তার পছন্দ হয়, তাকেই ধরে নিয়ে যায়!’
আমি বললাম, বলেছে তোমাকে...আসলে একটা বামন...তা–ই না?
মামা বলল, হুম! আসলে নিজের দাম বাড়ানোর জন্য এ রকম নাম বলে বোধ হয় সবাইকে! ওর সঙ্গে আমার দোস্তি হয়ে গেছে। প্রতি রাতে এখানে আসি…৮টা ৪০–এর দিকে আসে সে। বাদাম খায়। গল্প করে। আজ তোরা থাকায় বেশিক্ষণ থাকল না অবশ্য!
‘কী গল্প করে?’
‘কত গল্প। তার বয়স নাকি ৩৫১ বছর। হাতিরঝিলের নিচে মাটিতে গর্ত করে নাকি থাকে পুরো পরিবার। বাবা-মা, ভাইবোন...মজা না?’
আমি বললাম, মোটেও কোনো মজা না। এবার চলো…
মামা বলল, তুই ভয় পেয়েছিস, না?
‘মোটেও না।’
রিয়াদ আর টুসিও হাসতে শুরু করল। সব কটা গাধা। আমি রাস্তায় এসে অটো খুঁজতে শুরু করলাম। মামা বলল, জুজু আর কী বলে জানিস?
‘জানি না। জানার দরকারও নেই।’
‘শোন না। ওরা নাকি আসে দুপুরে...তারপর টক টক টক করে টোকা দেয় দরজায়। তিনবার। কেউ যদি খোলে, তাকেই ধরে নিয়ে যায়!’
‘তুমি না বললে যাকে পছন্দ করে, তাকে ধরে নিয়ে যায়?’
‘আরে, যাকে পছন্দ করে তার বাড়িতেই তো যায়! টোকা শুনে সে যদি দরজা খোলে...তাহলে ধরে নিয়ে যায়! আর যাকে পছন্দ করে তার পকেটে নাকি দিয়ে দেয় লাল কাপড়!’
অটো পাওয়া গেছে। আমি অটোতে চেপে বসলাম। মামা টুসিকে কোলে নিয়ে বসে ফিকফিক হাসতে থাকল।
৩
শোয়ার আগে খুব ভালো করে পকেট হাতড়ালাম। মামা যতই হাসাহাসি করুক। এসব নিয়ে আমার অনেক ভয়। কিন্তু না, দেখলাম না পকেটে কোনো লাল কাপড়। বাইরে এখনো বৃষ্টি। রিয়াদ এসে বলল, ভাইয়া, জুজু কি সত্যি আছে?
‘না।’
কথাটা রিয়াদকে বললাম নাকি নিজেকে, কে জানে!
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। ঘুম ভাঙল কিসের জানি শব্দে। বিছানায় উঠে বসলাম। শুনছি টক টক টক টক শব্দ। আমার আত্মা শুকিয়ে যাওয়ার দশা। জুজু নেই। জুজু নেই। আবার টোকা দরজায়। বৃষ্টি এখনো হচ্ছে। নিশ্চয়ই আমি ভুল শুনছি। জুজু নেই। আবার টোকা। জুজু নেই...আর যদি থাকেও তাহলে রাতে আসবে নাকি? মামাই না বলল জুজু আসে দুপুরে! আবার টোকা। কতবার হলো? তিনবার? আমি উঠে দরজার কাছে গেলাম। শব্দ হচ্ছে। সঙ্গে খসখস আওয়াজ। কি-হোলে চোখ রাখলাম...
নাহ! কেউ নেই।
একটা শ্বাস বেরিয়ে এল। পেছন থেকে মামা বলে উঠল, কী রে! জুজু দেখছিস?
আমি ঘুরে তাকালাম। মামা হাসছে।
আমি বললাম, না না। জুজু না। এমনিতেই এমনিতেই…
মামা হা হা করে হেসে উঠে রাতটাকে প্রায় ভেঙে ফেলল।
৪
বেলা তিনটা।
বাসায় কেউ নেই। আমি টিভি দেখছি। একটু পরেই দেখি ঘর থেকে রিয়াদ বেরোল। বলল, ভাইয়া, এটা কী?
রিয়াদ প্যান্টের পকেট থেকে একটা লাল কাপড় বের করেছে। আমি বললাম, মামার সঙ্গে দল বেঁধে আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস তোরা, না? কিসের কাপড় এটা?
রিয়াদ বলল, জানি না। প্যান্টের পকেটে পেলাম! মামা বলছিল জুজু…
রিয়াদ কথা শেষ করতে পারল না। দরজায় টোকা—টক টক টক…! আমি ঝটকায় রিয়াদের দিকে তাকালাম। বললাম, শব্দ শুনেছিস?
রিয়াদ দ্রুত মাথা নাড়াল। আমি ছুটে গিয়ে কি-হোলে গিয়ে চোখ রাখলাম। কেউ নেই। এবারও কেউ নেই। সবই মনের ভুল। আর তখনই ঘুরে দেখলাম ঠিক রিয়াদের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে জুজু। হাতে তার যে প্যান্ট, সেটা আসলে আমারই। আমার মনে পড়ল, রিয়াদ সকালেই বেরিয়েছিল তার বন্ধুর বাসায় যাওয়ার জন্য! আরও মনে পড়ল একটা আঁশটে গন্ধ আসলে সকাল থেকেই আমি পাচ্ছিলাম।
কিন্তু এখন এসব মনে পড়েই বা আসলে কী লাভ!