আমার বাবার বিগ ব্যাঙ

আইনস্টাইন লোকটা মোটেও আইনের না। আমার আব্বার থিওরি অব রিলেটিভিটি পুরো হাপিস করে দিয়েছেন। আমরা সবাই সাক্ষী, থিওরি অব রিলেটিভিটি আমার আব্বার আবিষ্কার।

আব্বা আমাদের রিলেটিভ, মানে আত্মীয়স্বজনকে একদমই পছন্দ করতেন না। রংপুরে আমাদের বাড়িতে সব সময় আত্মীয়স্বজনের ভিড় লেগেই থাকত। বেশির ভাগ আত্মীয়ই যে ছিলেন আব্বার ‘নানার খালুর মামাতো ভাইয়ের ছোট শালার বড় ছেলের শ্বশুরের মামাতো ভাই’ টাইপ।

আব্বার থিওরি হলো, ম = ভপ২। গেস্ট মানেই ফালতু ‘কস্টে’র চূড়ান্ত, ফালতু কষ্টও। রিলেটিভদের নিয়ে আব্বার এই থিওরিটাই ঘষেমেজে আইনস্টাইন সাহেব দুটো থিওরি বানিয়ে ফেলেছেন। আব্বাকে থ্যাংক ইউ পর্যন্ত দেননি। এ নিয়ে আব্বার মেজাজ ভয়ংকর খারাপ। আমি অবশ্য আব্বাকে বোঝালাম, ‘হয়তো আপনাকে কল করছিল বলার জন্য। কিন্তু আপনি যে রকম মোবাইল হারান। আবারও তো হারাইছেন।’

আব্বার আসলেই হারানোর অভ্যাস। চশমা, ঘড়ি, মোবাইল—ছোটখাটো অনেক জিনিসই নিয়মিত হারান। আম্মার ধারণা, আব্বা কোনো দিন সঙ্গে করে ফ্রিজ নিয়ে বের হলে ওটাও হারিয়ে আসবেন। 

আব্বা এসব নিয়ে ভাবেন না। তাঁকে অনেক বড় বড় ব্যাপার নিয়ে ভাবতে হয়। যেমন বিগ ব্যাঙ থিওরি। আমি নিজে সাক্ষী, আব্বা সেই ১৯৯৭ সালে এই থিওরি দিয়েছিলেন।

তখন স্কুলে পড়ি। আমরা শহরে থাকি। আব্বা গ্রামে ফিরে গেছেন কৃষিবিপ্লব করবেন বলে। আমরা মাঝেমধ্যে গ্রামে আমাদের দাদুর বাড়িতে যাই, আব্বার সঙ্গে দেখা করতে। বৈপ্লবিক সব চিন্তাভাবনা আব্বার। একবার তাঁর মাথায় এল, প্রথমে ধানগাছ লাগাতে হয়। সেখানে ধান হয়। ধান সেদ্ধ করলে তবে পাওয়া যায় চাল। সেই চাল সেদ্ধ করলে হয় ভাত। লম্বা প্রসেস। সময়ের অপচয়, খরচও বেশি।

আব্বার কথা হলো, এমন একটা আবিষ্কার করতে হবে, ধানের বদলে মানুষ ভাতের চাষ করবে। ধানগাছে যেমন ধান ধরে, ভাতগাছে সরাসরি ধরবে ভাত। এ নিয়ে আব্বা এখনো ভাবছেন। আম্মা মাঝেমধ্যে আব্বাকে ভীষণ উত্সাহ দেন, ‘ওগো, একটা মুরগির গাছও লাগাও না। গাছ থেকে ডিম পেড়ে তোমাকে ভেজে দেব।’ আব্বার সরু চোখে তাকানো দেখে অবশ্য আম্মার উত্সাহ দেওয়ার সততা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

কিন্তু গবেষক-বিজ্ঞানীদের সব চেষ্টা তো আর সফল হয় না। এক কোটি ব্যাপার নিয়ে ভাবলে একটায় সাফল্য আসে। সাফল্য তো আর মোবাইল কোম্পানিগুলোর অফারের এসএমএস না—এমনিতেই আসবে। আব্বা কিন্তু বিগ ব্যাঙ থিওরিতে সফল হয়েছিলেন। আমি নিজ চোখে দেখেছি। 

একবার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখি সামনে লম্বা লাইন। আর সবার হাতে ধরা পলিথিনের প্যাকেট। লাইন এগোচ্ছে। পলিথিনের প্যাকেট আব্বার দিকে বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আব্বা টিপেটুপে দেখছেন। তাঁর চোখেমুখে অসন্তোষ। কখনো পকেট থেকে ৫ টাকা বের করে দিচ্ছেন, কখনো ১০ টাকা।

পরে কাহিনি পরিষ্কার হলো। সেবার আব্বা আমাদের পুকুরে আফ্রিকান মাগুর চাষ করেছেন। আব্বা নানা রকম খাবার ট্রাই করার পর বুঝলেন, সব সময় ভয়ংকর ক্ষুধার্ত এই মাছগুলো সবচেয়ে বেশি খায় ব্যাঙ। আব্বা তাই ঘোষণা দিলেন তিনি ব্যাঙ কিনবেন। এ নিয়ে আমাদের আশপাশের গ্রামেও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। ব্যাঙ জিনিসটা এর আগে ও পরে কখনো বিক্রি করার সৌভাগ্য গ্রামবাসীর হয়নি। বাংলাদেশ তবু চীন-কোরিয়া হলে কথা ছিল।

গ্রামের ছেলেপুলেরা মহা উত্সাহে ব্যাঙ ধরত। নিজ গ্রামের সব ব্যাঙ সাফ করে আশপাশের গ্রাম, বিল-ঝিলে চলে যেত। সেসব গ্রামের লোকজন অবাক হয়ে দেখত, শাহপাড়ার লোকেরা মাছ ধরে না, ধরে ব্যাঙ! সেই ব্যাঙ তারা প্যাকেটে পোরে এত উত্সাহে, যেন বোয়াল মাছ ধরেছে!

প্যাকেটভর্তি সেই ব্যাঙ সাপ্লাই দেওয়া হতো আব্বাকে। বড় ব্যাঙ হলে বেশি টাকা, ছোট ব্যাঙ হলে কম। বিগ ব্যাঙ বিগ মানি। এই হলো সহজ বিগ ব্যাঙ থিওরি।

অবশ্য মনের মতো সাইজের ব্যাঙ আব্বা পাননি। ‘আরেকটু বড় ব্যাঙ আনবার পারলেন না বাহে’—সবাইকে আব্বার এই এক কথা।

মাগুরগুলো এমন তুলতুলে ব্যাঙ খেয়ে-খেয়ে লোভী হয়ে গিয়েছিল। হাঙরের মতো। কয়েক দিনের মধ্যে সেগুলোর আকারও ছোটখাটো হাঙরের মতো হয়ে গেল। আব্বার বিগ ব্যাঙ থিওরি প্রায় সফলতার মুখ দেখতে চলেছে, এমন সময় বন্যা। ভেসে গেল পুকুর। সব আফ্রিকান মাগুর ছড়িয়ে পড়ল পাশের ধানখেতে!

কেউ আর ভয়ে ধানখেতে নামে না, সার নিড়ানি দেয় না। ধানগাছে ধান ধরতে লাগল ইচ্ছেমতো। আর সেবার বন্যায় কী যে হলো, ধানগুলো নিজে থেকে ফুলেফেঁপে ফেটে সাদা-সাদা হয়ে গেল। আব্বার দাবি, এ হচ্ছে তাঁর ‘ভাতগাছ’ থিওরির আরেক প্রাথমিক সফলতা।

সে যা-ই হোক, আব্বা এখন আর সেভাবে গবেষণা করেন না। তবে ‘লিজেন্ড নেভার রিটায়ার্স’।

গত মাসে বাড়ি গেছি আব্বার জন্য নতুন মোবাইল নিয়ে। আম্মা তখনো গজগজ করছেন। আব্বা বললেন, ‘মোবাইলের সাথে বলে এলা ম্যালা কিছু থাকে বাহে? টিবি, এডিও, ক্যামেরা।’ সব সময় হারান বলে আব্বাকে সাধারণ মোবাইল কিনে দেওয়া হয়।

পাশ থেকে আম্মা বললেন, ‘তোর আব্বাক চেনআলা মোবাইল কিনি দে। তাইলে আর হারাইবে না।’ আব্বা বিরক্ত হন। পৃথিবীর সব গবেষকের স্ত্রীকে যে কথাটা কয়েক ট্রিলিয়ন বার শুনতে হয়েছে সেটাই বলেন, ‘তুমি খালি কথা কও।’

রাতে আমরা একসঙ্গে বসে ভাত খাই। হঠাত্ দেখি আব্বা দেয়াল ঘেঁষে খাটের কোনায় ভাত ছিটিয়ে দিলেন। মুরগি নাকি? আম্মা আবারও গজগজ করেন, ‘মুরগি! তোর আব্বা জীবনে একটা কাজের কাজ কিছু করছিল? ভাত খাওয়াইতেছে একটা ব্যাঙকে।’

ব্যাঙ! আব্বা ব্যাঙ পোষেন নাকি! আব্বা দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ডাকে না ক্যান?’। ঠিক তখন খাটের নিচ থেকে বেশ কবার ঘ্যাঁ ঘোঁ ঘ্যাঁ ঘোঁ শব্দ ভেসে এল। আমি যেন পরিষ্কার শুনলাম ব্যাঙটা আমাকে বলছে, ‘ভাইজান, ভালা আছেন? আম্মাজানকে বলবেন ঝাল একটু কম দিতে। আমরা ব্যাঙেরা নরম স্বভাবের। ঝাল-গরম খাইতে পারি না।’

আব্বা, ব্যাঙ ভাত খায়! তাও ঘড়ি ধরে! পোকামাকড় খায় শুনছিলাম। আমার সন্দেহ কাটে না। আব্বা হাসেন, ‘খায় মানে, চাটি চাটি এক্কেবারে শ্যাষ করি দ্যায়।’ খাটের তল থেকে আবারও ঘ্যাঁ ঘোঁ ঘ্যাঁ ঘোঁ শব্দ ভেসে আসে। ঠিক ঘ্যাঁ ঘোঁ না। প্রথম দিককার নকিয়া মোবাইলের একটা রিংটোন ছিল না ব্যাঙের আওয়াজ টাইপের, ঠিক ও রকম। আম্মার রাগ উঠে যায় তুঙ্গে, ‘ব্যাঙ! ব্যাঙ কেউ পোষে? এর চায়া যদি একটা বিড়াল পুষতা, তাও তো হইত।’ আব্বা হাসেন, ‘ক্যাটও পাবা, ফিশও পাবা।’ রহস্যময় হাসিতে আমি কোনো নতুন পরিকল্পনার আভাস পাই।

আর কথা বাড়াই না। বর্ষা নয়, উত্তরবঙ্গের কঠিন শীতের রাত। তবু মাঝেমধ্যেই খুব কাছ থেকে ভেসে আসা ব্যাঙের ডাক, শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ি।

পরদিন ঢাকায় ফিরব। আম্মার একটাই কথা, ‘তুই বাবা খাটের তল থাকি ব্যাঙটা বাইর কর। কোন দিন ব্যাঙের দেখাদেখি সাপ ঢুকবে। আমার কথাটা শোন। আমিই ওইটাকে তাড়াইতাম। এমন কোনাব্যাঙের ব্যাঙ, খাটের তল থাকি একবারও বাইর হয় নাই। তুই একটা লাঠি নিয়া খাটের তলে ঢোক বাবা।’ 

আব্বা ভীষণ কষ্ট পাবেন। নিশ্চয়ই তিনি কল্পনায় বিরাট একটা ব্যাঙ দেখতে পান, তাঁর পেলে-পুষে বড় করা বিগ ব্যাঙ। কে জানে, আব্বা হয়তো আগে বিগ ব্যাঙের খামার করার পরিকল্পনা করছেন। এরপর বিগ ক্যাটফিশ!

আম্মার ধারণা আমি এখনো ছোট। এত বড় দেহ নিয়ে কোনোমতো খাটের ভেতরে ঢুকলাম। সেই ওই মাথায়, দেয়ালের দিকে নাকি আছে ব্যাঙটা। কোনো আওয়াজও করছে না। অন্ধকার ঘর। খাটের তলটা আরও অন্ধকার। ভয়ও লাগছে। না জানি ভাত খেয়ে খেয়ে কেমন সাইজ হয়েছে ব্যাঙটার! আর এরই মধ্যে সাপও যে চলে আসেনি, তারও বা কী গ্যারান্টি।

খাটের তলায় একগাদা জিনিসপত্র রেখেছেন আম্মা। কিছু দেখতে পাচ্ছি না। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলাম অনেক কষ্টে। নড়াচড়াই করা যাচ্ছে না ঠিকমতো। আলো জ্বালাব। ওই সময় হঠাত্ ডেকে উঠল ব্যাঙটা। আলো জ্বেলে তাকালাম ব্যাঙটার দিকে। কিসের ব্যাঙ? সেখানে পড়ে আছে আব্বার হারিয়ে যাওয়া সেই মোবাইল, প্রায় শেষ হয় হয় অবস্থার চার্জ নিয়ে। পাশে ভাতের স্তূপ। অ্যালার্মের টোন ভেসে আসছে—ঘ্যাঁ ঘোঁ, ঘ্যাঁ ঘোঁ, ঘ্যাঁ ঘোঁ।

অলংকরণ: নাইমুর রহমান