‘মামণি, তুমি চাচির সঙ্গে থাকো। ভয়ের কিছু নেই। পাপা সকালেই মাকে নিয়ে চলে আসবে।’ নাকের ডগায় চলে আসা চশমাটা ঠেলে উঠিয়ে বলল বাবা।
বাবার কথায় থ হয়ে গেল মুনিয়া। সকালে মানে? মাকে ছাড়া সারা রাত সে একা থাকবে কীভাবে? আর মাই–বা ওকে ছাড়া কীভাবে থাকবে?
মুনিয়ার মন প্রচণ্ড খারাপ। কয়েক দিন ধরে ওর মা খুব অসুস্থ। মুনিয়ার সঙ্গে লুকোচুরি, রাতে গল্প শোনানো, বিকেলে ঘুরতে বের হওয়া—কিছুই করতে পারছে না। আজ সন্ধ্যায় তো আরও অসুস্থ হয়ে পড়ল। আব্বু আর চাচ্চুরা মিলে নিয়ে গেল হাসপাতালে। মুনিয়া ভেবেছিল, তাকেও বুঝি যেতে হবে সঙ্গে। তিনটা টেডি বিয়ার আর স্কুলব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল সে। মাকে নিয়ে ব্যস্ততার কারণে কেউ নজরই দিচ্ছিল না এতক্ষণ। শুধু ঘর থেকে তড়িঘড়ি করে বের হওয়ার সময় একসঙ্গে সবার মনে পড়ল মুনিয়ার কথা।
অথচ কয়েক দিন ধরে মুনিয়াই গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে মাকে। আর এখন তাকে রেখেই হাসপাতালে যাচ্ছে সবাই! খুব রাগ হলো মুনিয়ার। কিন্তু চাপা ক্ষোভে কিছু বলতেই পারল না সে। বাবার কাজ দেখে গলা ধরে এল ওর। শুনতে পেল চাচ্চু বলছে, ‘হাসপাতালে গেলে ও ভয় পাবে। না নেওয়াই ভালো।’
ভয়? ভয় কেন পাবে মুনিয়া? মা বলে, হাসপাতাল খুব সুন্দর জায়গা, স্টেশনের মতো। ওখান থেকে কেউ পৃথিবীতে আসে আবার কেউ পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। কই, সেবার দাদুবাড়ি যাওয়ার সময় স্টেশনে তো ভয় লাগেনি। তাহলে আজ কেন?
কিছু বলার আগেই চলে গেল আব্বু আর চাচ্চু। বাইরে দাঁড়ানো অ্যাম্বুলেন্সটা যখন লালবাতি আর সাইরেন বাজিয়ে রাস্তা ধরে ছুটে গেল, তখনই মুনিয়া টের পেল, বুকের ভেতর কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। শুধু ছুটে যেতে ইচ্ছা করছে আম্মুর কাছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল মুনিয়া। ঠান্ডা বাতাসে ভেসে যাচ্ছে ঘর, বাতাসে কেমন একটা গন্ধ। মা এটাকে বলে মাটির ঘ্রাণ। চোখ বন্ধ করে জোরে একটা নিশ্বাস নিল ও। চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইল জানালার পাশে। হঠাৎ একফোঁটা বৃষ্টি মুখে পড়তেই চোখ খুলে ফেলল। এমন দিন এলেই গান গাইতে শুরু করে মা। আবার মনে পড়ে গেল মায়ের কথা। এভাবে তো থাকা যাবে না, যে করেই হোক যেতে হবে মায়ের কাছে।
চাচিকে একবার বলে দেখবে? একটু কান্নাকাটি করলে উপায় হতে পারে। কিন্তু চাচি কী ভাববে কে জানে। থাক, দরকার নেই।
বারান্দায় চলে এল মুনিয়া। দমকা হাওয়া আরও বেড়েছে, সঙ্গে বৃষ্টি। বাতাস ঘরের দিকে আসায় বারান্দা ভিজে যাচ্ছে দ্রুত। চাচি বোধ হয় রাতের জন্য রান্না করছেন। হঠাৎ চমকে উঠল মুনিয়া। মনে হলো কেউ দাঁড়িয়ে আছে কোনায়, অন্ধকারে শুধু ছায়াটা বোঝা যায়। ফিসফাস কথা শোনা যাচ্ছে, কিন্তু মুনিয়া ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না, কী কথা। ভয় কাটাতে জোরে বলে উঠল, ‘কে? কে ওখানে?’ সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল ফিসফিসানি। কোনো শব্দ নেই। এমন সময় আকাশে বিদ্যুৎ চমকে উঠল। সেই আলো বারান্দায় পড়তেই একমুহূর্তের জন্য দেখা গেল পুরো বারান্দা। কোনায় দাঁড়িয়ে দুজন। বড় বড় চোখ দিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে মুনিয়ার দিকে। ওদের সবুজ রঙের শরীরটা একেবারে ছোট হলেও মাথা অনেক বড়, তরমুজের সাইজ। মাথায় কোনো চুল নেই। থুতনিতে সাদা একগোছা দাড়ি। কানগুলো ছোট ছোট। হাড়–জিরজিরে হাতে ইয়া লম্বা নখ।
মা অনেকবার এদের কথা বলায় একবার দেখেই চিনে ফেলল মুনিয়া—বোগার্ট। চেহারা নিরীহ হলেও বড় দুষ্টু, সুযোগ পেলেই ক্ষতি করে সবার। মায়ের কথাই ঠিক হলো। প্রতিদিন এদের মতো অনেকের কথাই মা শোনাত মুনিয়াকে। কীভাবে সবার দেখা পাবে জিজ্ঞেস করলেই বলত, ‘মন খারাপের রাতে...’ আজকের চেয়ে মন খারাপ করা রাত আর আসেনি মুনিয়ার জীবনে। ওদের দেখতে পাওয়া তাই খুব স্বাভাবিক। আরও অনেক কিছুই হয়তো অপেক্ষা করে আছে সামনে।
‘তুমি চাইলেই তোমার মায়ের কাছে যেতে পারো।’ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর অন্ধকারেই বলে উঠল একটা বোগার্ট।
চিকন রিনরিনে গলা শুনে চমকে উঠল মুনিয়া। একটু ভেবে বলল, ‘কীভাবে? চাচি আমাকে নেবে না।’ বলতে বলতেই গলা ধরে এল কষ্টে। ওপাশ থেকে শোনা গেল খিক খিক হাসি। ওর কথায় দুলে দুলে হাসছে বোগার্ট দুটো।
‘চাচিকে কেন লাগবে? তুমিই চলে যাও একা একা। রাস্তায় কাউকে জিজ্ঞেস করলেই হাসপাতাল দেখিয়ে দেবে, খুব বেশি দূরে নয়।’
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল মুনিয়া। কান্নার দমকে ঠিকঠাক কিছু ভাবতেও পারছে না। তবে মায়ের কাছে যাওয়ার এটাই বোধ হয় সবচেয়ে সহজ উপায়। ‘কিন্তু চাচি তো আমাকে যেতে দেবে না।’
আবার খিক খিক হাসি।
‘সমস্যা নেই। আমরা ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি। তুমি যাও, শুধু মনে রেখো, আজ কিন্তু সোমবার বৃষ্টির রাত।’
বলেই বোগার্ট দুটো মিচকে শয়তানের মতো হা হা করে হাসল। সেই হাসি শুনেই ভয় লাগল মুনিয়ার। বারান্দা দিয়ে একবার অন্ধকার রাস্তায় তাকিয়ে ঢোঁক গিলে বলল,
‘তোমরা একটু আমাকে পৌঁছে দেবে?’
‘না না, আজকে তো ভালে। ওখানে যেতে হবে আমাদের।’
কথা শেষ হতে না হতেই তুড়ি বাজাল ওরা, সঙ্গে ধপ করে একটা শব্দ। চমকানো আলোতে দেখা গেল, বারান্দায় কেউ নেই। মুনিয়ার আর জিজ্ঞেস করা হলো না, বোগার্টগুলো কীভাবে জানল ও আম্মুর কাছে যেতে চায়।
সাতপাঁচ না ভেবে হাঁটতে শুরু করল সদর দরজার দিকে। মাঝখানের ঘর থেকে শোনা যাচ্ছে চাচির নাক ডাকার আওয়াজ। নিজেদের কাজ করেছে বোগার্টরা। পা টিপে টিপে দরজা খুলে রাস্তায় আসতেই মুনিয়া টের পেল, একটা বড় ভুল হয়েছে। সঙ্গে করে ছাতা আনা হয়নি। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। সঙ্গে মেঘের গম্ভীর গুড়ুম আওয়াজ। ঠান্ডা বৃষ্টির পানি কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে গায়ে। ছাতা নিতে আর বাসায় গেল না মুনিয়া। ভিজতে ভিজতেই এসে দাঁড়াল বাসস্ট্যান্ডে। প্রতিদিন এখান থেকেই ভ্যানে করে স্কুলে যায় ও, ভ্যান ছাড়ার একটু আগে মা ওকে পাশে ডেকে দুই গালে দুটো চুমু দেয়। আর কানে ফিসফিস করে বলে, ‘লক্ষ্মী আমার দস্যি মেয়ে, আডুম বাডুম ফুস।’
বৃষ্টিতে বরং সুবিধাই হলো, চোখের পানি মুছতে হলো না আর। ইশ্, কত দিন মা আর চুমু দেয় না ওকে। কানের কাছে বলে না ছড়া। শুধু দুর্বলভাবে হাত নেড়ে বিছানার পাশে ডেকে বসায়। আর চুপচাপ তাকিয়ে থাকে ওর চোখের দিকে। মুনিয়া বোঝে, মায়ের শরীরটা বড্ড খারাপ। নইলে বরফ–পানি খেলায় যাকে কেউ হারাতে পারে না, সে কি বিছানায় শুয়ে থাকার মানুষ?
বৃষ্টি একটু কমে এসেছে। মুনিয়া আশপাশে তাকাল। একটা মানুষও নেই। পুরো রাস্তা খালি। কাকে জিজ্ঞেস করবে হাসপাতালের কথা? হু হু করে কাঁদতে শুরু করল।
‘কী বাছা, কাঁদছ কেন? কে তুমি?’
টানা প্রশ্ন শুনে মুনিয়া সামনে তাকাল । চোখ মুছে দেখল, ঝাড়ুর ওপর বসে আছে একটা বুড়ি, মাথায় টুপি, টোল পড়া গালে তিল। সঙ্গে সঙ্গেই তাকে চিনে ফেলল, এই মহিলা ডাইনি না হয়ে যাই-ই না।
‘তুমি কি ডাইনি?’
ঝাড়ুটাকে আরেকটু ওপরে তুলল বুড়ি।
‘তা বলতে পারো বাছা। তবে আমি জাদুমন্তর পারি না। “উড়াও সার্ভিস”–এ কাজ করি। সবাইকে এদিক–ওদিক পৌঁছে দিই...’
‘আমাকে আমার মায়ের কাছে নিয়ে চলো।’
‘তা তো সম্ভব নয়।’ মাথা নাড়ল ডাইনি। আজ আমাদের ভালে। দ্রুত ওখানে যেতে হবে। সার্ভিস বন্ধ।’
আবার কাঁদতে শুরু করল মুনিয়া। ভালো মেয়েরা কখনোই এভাবে কাঁদে না, তবে আজ কাঁদা ছাড়া উপায় নেই।
হতাশ হলো বুড়ি। বিড়বিড় করে বলল, ‘ভালোই তো বিপদে পড়া গেল। এট্টুকু মেয়ে সোমবৃষ্টির রাতে একা পথে, তেনারা তো যেকোনো সময় চলে আসবেন।’
কেউ আসবে এখানে? ভরসা পেয়ে বলল মুনিয়া, ‘কারা আসবে? নেবে আমাকে সঙ্গে?’
শিউরে উঠল ডাইনি।
‘সর্বনাশ, তাদের নাম নেওয়া যাবে না। আমি এখন যাচ্ছি বাছা, সোজা পথে হাঁটো। সামনে স্প্রাইট দলের বাস আছে একটা। ওটায় চড়ে বসো, ওরাও ভালেতে যাবে, তবে পথে তোমাকে মায়ের কাছে ছেড়ে দেবে।’
কথা শেষ করতে না করতেই ভোঁশ শব্দে উড়ে গেল ডাইনি।
আজ রাতে এরা সবাই যাচ্ছে কোথায়? বোগার্ট, বুড়ি—সবাই শুধু ভালে ভালে করছে, কিন্তু জিনিসটা কী? বৃষ্টির মধ্যেই সোজা পথে হাঁটতে শুরু করল মুনিয়া। মা বলে, স্প্রাইটরা খুবই ভালো আর মায়াবী। ওরা যদি সামনে থাকে, তাহলে আর চিন্তা নেই।
সোজা পথে ও ছুটতে শুরু করল। বৃষ্টি প্রায় নেই বললেই চলে। তবু ভেজা জামায় ঠান্ডা লাগছে ভয়ানক। একটু জিরিয়ে আবার হাঁটতে গিয়েই হোঁচট খেল মাটিতে। প্রচণ্ডভাবে কেঁপে উঠছে মাটি। থপ থপ করে এগিয়ে আসছে কিছু। ভয়ে মুনিয়া রীতিমতো আধমরা। নড়ার সাহসও হলো না ওর। চুপ করে বসে রইল রাস্তার পাশে। ধীরে ধীরে আরও বাড়তে লাগল থপ থপ শব্দটা। মনে হচ্ছে রাস্তাই ভেঙে যাবে। কিন্তু হঠাৎ থেমে গেল শব্দ। চারপাশে উঁকি দিল মুনিয়া। কী হলো এইমাত্র? রাস্তা ধরে আবার হাঁটার জন্য উঠে দাঁড়াতেই টের পেল, ঠিক পেছনে কী যেন দাঁড়িয়ে আছে। কানে আসছে জিনিসটার নিশ্বাসের শব্দ। ভয়ে ভয়ে মাথা ঘোরাল ও। দেখল, ভয়ানক এক দানব। ধারালো সাদা দাঁতগুলো চকচক করছে আলোয়। চোখ টকটকে লাল। ল্যাম্পপোস্টের চেয়েও দ্বিগুণ উঁচুতে থাকা প্রকাণ্ড শরীর আর হাত–পা দেখলেই রক্ত হিম হয়ে আসে। নিশ্বাসের গরম বাতাসে বের হয়ে আসছে দুর্গন্ধ। দানবটার চেহারা অনেকটা বানরের মতো। ‘ট্রল’। বিড়বিড় করল মুনিয়া। মা বলে, এরা বড় ভয়ানক মানুষখেকো। একবার এদের নজরে পড়লে রক্ষা নেই। এ জন্যই সবাই সোমবার বৃষ্টির কথা বলছিল। এই দিনই রাস্তায় নামে ট্রলরা। বজ্জাত বোগার্টগুলো ট্রলের সামনে পাঠাতেই বাসা থেকে বের হতে বলেছে ওকে।
ভয়ে মুনিয়া চিৎকার করে উঠল। দৌড় দিল সামনের দিকে। চিৎকার দেওয়াটাই ছিল মস্ত বড় ভুল। সঙ্গে সঙ্গে ট্রলটার চোখ গেল ওর দিকে। বিকট এক শব্দ করে মুনিয়ার পেছনে ছুটতে শুরু করল ওটা। দুবার হাত বাড়াল ট্রলটা। কিন্তু ভাগ্যক্রমে হাত ফসকে বেরিয়ে এল মুনিয়া। হাঁপিয়ে উঠেছে ও, আর দৌড়ানো সম্ভব নয়। দেখতে পেল, সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা বাস। সেটার জানালা থেকে অনেকগুলো আতঙ্কিত চোখ চেয়ে আছে ওর দিকে। ‘আর একটু!’ নিজেকে বোঝাল ও। তাহলেই দেখা হবে মায়ের সঙ্গে। প্রাণপণে ছুটতে শুরু করল। আবার ওকে ধরতে হাত বাড়াল ট্রল, মুনিয়াও প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে বাস!
তবু শেষ রক্ষা হলো না। খপ করে ওকে ধরে ফেলল ট্রল। সব শেষ! ট্রল ওকে ধারালো দাঁতের নিচে নিয়ে যাচ্ছে। মুনিয়ার চোখের সামনে ভেসে উঠল মায়ের চোখ দুটো।
হঠাৎ প্রচণ্ড আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল। বিকট চিৎকার করে ট্রল মুনিয়াকে মাটিতে নামিয়ে দিল। তারপর উল্টো দিকে দিল ছুট। নিজের হাত–পায়ের দিকে তাকাল মুনিয়া। শরীর থেকে বের হচ্ছে নিবু নিবু আলো। এইমাত্র ঝলকানিটা কি ওর ভেতর থেকে হলো?
ছাড়া পেয়েই মুনিয়া সোজা বাসে ঢুকল। বাসভর্তি মেয়ে, অসম্ভব সুন্দর চেহারা। সবার পেছনেই উঁকি দিচ্ছে ডানা। একটু আগেই এদের সবার চোখে ছিল আতঙ্ক, আর এখন সেখানে জায়গা করে নিয়েছে গভীর বিস্ময়। এত কিছু ঘটে যাওয়ার পর একটা কথাই বের হলো মুনিয়ার মুখ থেকে, ‘আমাকে আমার মায়ের কাছে নিয়ে চলো।’
পেছন থেকে ডানায় ভর দিয়ে এগিয়ে এল একটি মেয়ে।
‘হ্যাঁ, আমরা তোমাকে তোমার মায়ের কাছে নিশ্চয়ই নিয়ে যাব। কী নাম তোমার মায়ের?’
‘আফিয়া!’ হাঁপাতে হাঁপাতে জবাব দিল মুনিয়া। ‘আমার আম্মুর নাম আফিয়া। হাসপাতালে আছে আম্মু।’
মুহূর্তে পুরো বাসে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। চমকে উঠল সবাই, স্প্রাইটদের চোখে থাকা বিস্ময় আরও ঘন হলো।
মুনিয়া দ্রুত বলে উঠল আবার, ‘তোমরাও ভালেতে যাচ্ছ? আমাকে আম্মুর কাছে আগে নিয়ে চলো, প্লিজ।’
‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই!’ সামনে থাকা স্প্রাইট সামলে নিল নিজেকে। ‘এসো আমার সঙ্গে।’
মুনিয়া বসল পেছনের একটা সিটে। পাশে সেই স্প্রাইট। চলতে শুরু করল বাস, মাটি থেকে অনেক অনেক ওপরে, মেঘের ভেতরে। চাঁদের আলোয় সব ভরে উঠেছে। চকচক করছে স্প্রাইটটার ডানা।
‘তুমি কি পরি?’
হেসে উঠল স্প্রাইট, ‘না না, সেই সৌভাগ্য কি আর আমার আছে।’
মুনিয়া আশপাশে দেখল, স্প্রাইটরা এখনো ওকে দেখছে।
‘ওরা আমার দিকে তাকিয়ে আছে কেন?’
একটু থেমে থেমে বলল স্প্রাইট, ‘আমরা কখনো কাউকে ট্রলের হাত থেকে বাঁচতে দেখিনি।’
‘কীভাবে বাঁচলাম আমি?’
মুনিয়ার প্রশ্নের কোনো জবাব এল না।
একটু থেমে আবার প্রশ্ন করল, ‘ভালে মানে কী? আজকে সবাই ওখানে যাচ্ছে কেন?’
‘ভালে মানে আমাদের ভাষায় বিদায়। একজনকে বিদায় জানাতে যাচ্ছি আমরা।’
‘কে সে?’
জবাব দিল না স্প্রাইট। জানালার বাইরে তাকিয়ে একমনে দেখছে চাঁদ।
একটু পরই থামল বাস। একে একে নামতে শুরু করল স্প্রাইটরা, মুনিয়াকেও নামানো হলো বাস থেকে। ছায়াঘেরা একটা পথে হেঁটে চলেছে ওরা। একটু এগোতেই আলোকিত হয়ে গেল পথ। আবার শুরু হয়েছে বৃষ্টি। মুনিয়া দেখল, সামনে অনেক ভিড়। স্প্রাইটরা সেই ভিড় ঠেলে তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগল সামনে। ভিড়ের মধ্যেই ও দেখতে পেল বোগার্টদের, ডাইনিদের, সেন্টর, নোমসহ আরও কতজনকে! যাদের কথা রাতের বেলা বলত মা। এটাই কি তবে ভালে? কিন্তু মুনিয়ার তো মায়ের কাছে যেতে হবে। স্প্রাইটকে ডাক দিতেই সামনে আঙুল তুলল ও। সামনে একটা নরম স্বচ্ছ পর্দা, যার উল্টো পাশে শুয়ে আছে মা। ডাক্তাররা ছোটাছুটি করছে তাকে ঘিরে। বাবা ধরে আছেন মায়ের দুর্বল হাতটা। বাঁ পাশে থাকা মনিটরে সংখ্যা উল্টো দিকে যাচ্ছে। যতই কমে আসছে সংখ্যা, ততই বেড়ে যাচ্ছে ছোটাছুটি। মুনিয়া ছুটে যেতে চাইল পর্দার ওপাশে, কিন্তু ওকে শক্ত করে ধরে রাখল স্প্রাইট, ‘ওই জগতে যাওয়া যাবে না।’
চিৎকার করে উঠল ও, ‘মা।’
মুনিয়ার দিকে মাথা কাত করল মা। নির্জীব হাতে জানাল আদর। ধীরে ধীরে দৃষ্টি ঘোলা হয়ে আসতে থাকল তার। পেছনে থাকা সবাই ডুকরে কেঁদে উঠল। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল মুনিয়া।
‘না না, এটা কীভাবে সম্ভব? মা তো…মা তো…’ একবার মনে হলো গোপন কথাটা জোরে বলে ওঠে সবাইকে। কিন্তু মা বলেছে, এটা কাউকে বলা যাবে না।
ভয়ংকর একটা সন্দেহ আঁকড়ে ধরে মুনিয়াকে। স্প্রাইটদের থেকে নিজেকে ছুটিয়ে নেয় সে। মায়ের চোখ বন্ধ হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। পেছনের ভিড় সমস্বরে বলছে, ‘ভালে! ভালে!’
ছুটে যায় মুনিয়া পর্দার দিকে। কিন্তু ওই জগৎ ভিন্ন, পৃথিবী ভিন্ন। সাদা আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যায় ওর। দূর থেকে ভেসে আসে, ‘লক্ষ্মী আমার দস্যি মেয়ে, আডুম বাডুম ফুস।’
...
মুনিয়ার মা স্টেশন থেকে চলে গেছে পৃথিবী ছেড়ে। তবে মুনিয়া প্রতিদিন রাতেই তাকে খুঁজে বের করে আকাশে। কখনো তারাদের মধ্যে, কখনো চাঁদের শরীরে। তারপর মাকে দেখে চলে সারা রাত। শুধু যেদিন মেঘ করে আকাশে, অনেক কষ্টেও তারাদের খুঁজে পাওয়া যায় না, তখন ও চলে যায় বাসার পেছনের শিউলিগাছের কাছে। ঝুম বৃষ্টির মধ্যে গাছকে ফিসফিস করে বলে, ‘একটা গোপন কথা শুনবে? মা কিন্তু বলতে বারণ করেছে। কাউকে বলবে না তো? আমি আর মা দুজনই পরি।’