শঙ্কর ঘোষ জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘শুনিয়াছি যে সুন্দরবনে নদী-নালায় অনেক কুমির আছে। তোমার আবাদে কুমির কিরূপ?’
ডমরুধর বলিলেন, ‘কুমির! আমার আবাদের কাছে যে নদী আছে, কুমিরে তাহা পরিপূর্ণ। খেজুরগাছের মতো নদীতে তাহারা ভাসিয়া বেড়ায়, অথবা কিনারায় উঠিয়া পালে পালে তাহারা রৌদ্র পোহায়। গরুটা, মানুষটা, ভেড়াটা, ছাগলটা বাগে পাইলেই লইয়া যায়। কিন্তু এসব কুমিরকে আমরা গ্রাহ্য করি না। এবার আমার আবাদের নিকট এক বিষম কুমিরের আবির্ভাব হইয়াছিল। গন্ধমাদন পর্বতে কালনিমের পুকুরে যে কুম্ভীর হনুমানকে ধরিয়াছিল, ইহা তাহা অপেক্ষাও ভয়ানক, গঙ্গাদেবী যে মকরের পিঠে বসিয়া বায়ু সেবন করেন, সে মকরকে এ কুমির একগালে খাইতে পারে। পর্বতপ্রমাণ যে গজ সেকালে বহুকাল ধরিয়া কচ্ছপের সহিত যুদ্ধ করিয়াছিল, সে গজ-কচ্ছপকে এ কুমির নস্য করিতে পারে। ইহার দেহ বৃহৎ, তালগাছের ন্যায় বড়, ইহার উদর এই দালানটির মতো, অন্যান্য কুমির জীবজন্তুকে ছিঁড়িয়া ভক্ষণ করে। কিন্তু এ কুমিরটা আস্ত গরু, আস্ত মহিষ গিলিয়া ফেলিত। রাত্রিতে সে লোকের ঘরে ও গোয়ালে সিঁদ দিয়া মানুষ ও গরু-বাছুর লইয়া যাইত। লাঙ্গুলে জল আনিয়া দেয়াল ভিজাইয়া গর্ত করিত। ইহার জ্বালায় নিকটস্থ আবাদের লোক অস্থির হইয়া পড়িল। প্রজাগণ পাছে আবাদ ছাড়িয়া পলায়ন করে, আমাদের সেই ভয় হইল, তাহার পর লাঙ্গুলের আঘাতে নৌকা ডুবাইয়া আরোহীদিগকে ভক্ষণ করিতে লাগিল। সে নিমিত্ত এ পথ দিয়া নৌকায় যাতায়াত অনেক পরিমাণ বন্ধ হইয়া গেল।
এই ভয়ানক কুম্ভীরের হাত হইতে কিরূপে নিষ্কৃতি পাই, এইরূপ ভাবিতেছি, এমন সময় আমার আবাদের নিকট একখানি নৌকা ডুবাইয়া তাহার আরোহীদিগকে একে একে আমাদের সমক্ষে সে গিলিয়া ফেলিল। এই নৌকায় এক ভদ্রলোক কলিকাতা হইতে সপরিবারে পূর্বদেশে যাইতেছিলেন। নদীর তীরে দাঁড়াইয়া আমরা দেখিলাম যে তাঁহার গৃহিণীর সর্বাঙ্গ বহুমূল্য অলংকারে ভূষিত ছিল। তোমরা জানো যে কুমিরের পেটে মাংস হজম হয়, গহনা পরিপাক পায় না। কুমির যখন সেই স্ত্রীলোককে গিলিয়া ফেলিল, তখন আমার মনে এই চিন্তা উদয় হইল, চিরকাল আমি কপালে পুরুষ; যদি এই কুমিরটাকে আমি মারিতে পারি, তাহা হইলে ইহার পেট চিরিয়া এই গহনাগুলি বাহির করিব, অন্তত পাঁচ-ছয় হাজার টাকা আমার লাভ হইবে।
এইরূপ চিন্তা করিয়া আমি কলিকাতায় গমন করিলাম। বড় একটি জাহাজের নঙ্গর কিনিয়া উকো ঘষিয়া তাহাতে ধার করিলাম, তাহার পর যে কাছিতে মানোয়ারি জাহাজ বাঁধা থাকে, সেইরূপ এক কাছি ক্রয় করিলাম। এইরূপ আয়োজন করিয়া আমি আবাদে ফিরিয়া আসিলাম। আবাদে আসিয়া শুনিলাম যে কুমির আর একটি মানুষ খাইয়াছে। চারদিন পূর্বে এক সাঁওতালনী এক কুড়ি বেগুন মাথায় লইয়া হাটে বেচিতে যাইতেছিল। সে যেই নদীর ধারে গিয়াছে, আর কুমির তাহাকে ধরিয়া বেগুনের ঝুড়ির সহিত আস্ত গিলিয়া ফেলিয়াছে, তাহাতে সাঁওতাল প্রজাগণ ক্ষেপিয়া উঠিয়াছে। বলিতেছে যে আবাদ ছাড়িয়া তাহারা দেশে চলিয়া যাইবে।
আবাদে আসিয়া নঙ্গরটিকে আমি বঁড়শি করিলাম। তাহাতে জাহাজের কাছি বাঁধিয়া দিলাম, মাছ ধরিবার জন্য লোকে যে হাতসুতা ব্যবহার করে, বৃহৎ পরিমাণে এ-ও সেইরূপ হাতসুতার ন্যায় হইল। নঙ্গরের তীক্ষ অগ্রভাগে এক মহিষের বাছুর গাঁথিয়া নদীর জলের নিকট বাঁধিয়া দিলাম। কাছির অন্য দিক এক গাছে পাক দিয়া রাখিলাম, তাহার পর পঞ্চাশ জন লোককে নিকটে লুক্কায়িত রাখিলাম। বেলা তিনটার সময় আমাদের এই সমুদয় আয়োজন সমাপ্ত।
বঁড়শিতে মহিষের বাছুর বিঁধিয়া দিয়াছিলাম সত্য, কিন্তু তাহার প্রাণ আমরা একেবারে বধ করি নাই। নদীর ধারে দাঁড়াইয়া সে গাঁ গাঁ শব্দে ডাকিতে লাগিল, তাহার ডাক শুনিয়া সন্ধ্যার ঠিক পূর্বে সেই প্রকাণ্ড কুমির আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার লেজের ঝাপটে পর্বতপ্রমাণ এক ঢেউ উঠিল, সেই ঢেউয়ে বাছুরটি ডুবিয়া গেল, তখন আর আমরা কিছুই দেখিতে পাইলাম না, পরক্ষণে কাছিতে টান পড়িল। তখন আমরা বুঝিলাম যে নঙ্গরবিদ্ধ বাছুরটিকে কুমির গিলিয়াছে; বঁড়শির ন্যায় নঙ্গর কুমিরের মুখে বিঁধিয়া গিয়াছে। তাড়াতাড়ি সেই পঞ্চাশ জন লোক আসিয়া দড়ি ধরিয়া টানিতে লাগিল। ভাগ্যি গাছে পাক দিয়া রাখিয়াছিলাম, তা না হইলে কুমিরের বলে এই পঞ্চাশ জন লোককে নদীতে গিয়া পড়িতে হইত। আমরা সেই রাক্ষস কুমিরকে বঁড়শিতে গাঁথিয়াছি, ঐ কথা শুনিয়া চারদিকের আবাদ হইতে অনেক লোক দৌড়িয়া আসিল। প্রায় পাঁচ শত লোক সেই রশি ধরিয়া টানিতে লাগিল। দারুণ অসুরিক বলে কুমির সেই পাঁচ শত লোকের সহিত ঘোর সংগ্রাম করিতে লাগিল। কখনো আমাদের ভয় হইল যে তাহার বিপুল বলে নঙ্গর না ভাঙ্গিয়া যায়, কখনো ভয় হইল যে সে জাহাজের দড়া বা ছিঁড়িয়া যায়। কখনো ভয় হইল যে গাছ উৎপাটিত হইয়া নদীতে গিয়া বা পড়ে। নিশ্চয় একটা না-একটা বিভ্রাট ঘটিত, যদি না সাঁওতালগণ কুমিরের মস্তকে ক্রমাগত তীরবর্ষণ করিত, যদি না নিকটস্থ দুইটি আবাদের লোক বন্দুক আনিয়া কুমিরের মাথায় গুলি মারিত। তীর ও গুলি খাইয়া কুমির মাঝে মাঝে জলমগ্ন হইতে লাগিল। কিন্তু নিশ্বাস লইবার জন্য পুনরায় তাহাকে ভাসিয়া উঠিতে হইল। সেই সময় লোক তীর ও গুলিবর্ষণ করিতে লাগিল। কুমিরের রক্তে নদীর জল বহুদূর পর্যন্ত লোহিত বর্ণে রঞ্জিত হইয়া গেল। সমস্ত রাত্রি কুমিরের সহিত আমাদের এইরূপ যুদ্ধ চলিল। প্রাতঃকালে কুম্ভীর হীনবল হইয়া পড়িল। বেলা নয়টার সময় তাহার মৃতদেহ জলে ডুবিয়া গেল। তখন অতি কষ্টে তাহাকে আমরা টানিয়া ওপরে তুলিলাম। বড় বড় ছোরা, বড় বড় কাস্তে আনিয়া তাহার পেট চিরিতে চেষ্টা করিলাম। কিন্তু সে রাক্ষস কুমিরের পেট অতি কঠিন ছিল। আমাদের সমুদয় অস্ত্র ভাঙ্গিয়া গেল। অবশেষে করাত আনাইয়া করাতের দ্বারা তাহার উদর কাটাইলাম। কিন্তু পেট চিরিয়া তাহার পেটের ভেতর যাহা দেখিলাম, তাহা দেখিয়াই আমার চক্ষুস্থির।
লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কী দেখিলে?’
শঙ্কর ঘোষ জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কী দেখিলে?’
অন্য শ্রোতৃগণ জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কী দেখিলে?’
ডমরুধর বলিলেন, ‘বলিব কী ভাই আর দুঃখের কথা, কুমিরের পেটের ভেতর দেখি না যে সেই সাঁওতালনী, চার দিন পূর্বে কুমির যাহাকে আস্ত ভক্ষণ করিয়াছিল, সে পূর্বদেশীয় সেই ভদ্রমহিলার সমুদয় গহনাগুলি আপনার সর্বাঙ্গে পরিয়াছে, তাহার পর নিজের বেগুনের ঝুড়িটি সে উপুড় করিয়াছে, সেই বেগুনগুলি সম্মুখে ডাঁই করিয়া রাখিয়াছে। ঝুড়ির ওপর বসিয়া বেগুন বেচিতেছে।’
শঙ্কর ঘোষ বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কুমিরের পেটের ভেতর ঝুড়ির ওপর বসিয়া সে বেগুন বেচিতেছিল?’
ডমরুধর বলিলেন, ‘হ্যাঁ ভাই! কুমিরের পেটের ভেতর সেই ঝুড়ির ওপর বসিয়া সে বেগুন বেচিতেছিল।
লম্বোধর জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কাহাকে সে বেগুন বেচিতেছিল? কুমিরের পেটের ভেতর সে খরিদ্দার পাইল কোথা?’
বিরক্ত হইয়া ডমরুধর বলিলেন, ‘তোমার এক কথা। কাহাকে সে বেগুন বেচিতেছিল, সে খোঁজ করিবার আমার সময় ছিল না। সমুদয় গহনাগুলি সে নিজের গায়ে পরিয়াছিল, তাহা দেখিয়াই আমার হাড় জ্বলিয়া গেল। আমি বলিলাম, ‘বুড়ি, ও গহনা আমার। অনেক টাকা খরচা করিয়া আমি কুমির ধরিয়াছি, ও গহনা খুলিয়া দে।’
কেঁউমেঁউ করিয়া সে আমার সহিত ঝগড়া করিতে লাগিল। তাহার পর তাহার পুত্রগণ ও তাহার জ্ঞাতি-ভাইগণ কাঁড়াবাঁশ ও লাঠিসোঁটা লইয়া আমাকে মারিতে দৌড়াল। আমার প্রজাগণ কেহই আমার পক্ষ হইল না। সুতরাং আমাকে চুপ করিয়া থাকিতে হইল। সাঁওতালগণ সে বুড়িকে ঘরে লইয়া গেল। দিন কয়েক শূকর মারিয়া ও মদ খাইয়া তাহারা আমোদ-প্রমোদ করিল। পূর্বদেশীয় সে ভদ্রমহিলার একখানি গহনাও আমি পাইলাম না। মনে মনে ভাবিলাম যে কপালে পুরুষের ভাগ্যও সকল সময় প্রসন্ন হয় না।
লম্বোদর বলিলেন, ‘এত আজগুবি গল্প তুমি কোথায় পাও বলো দেখি?’
ডমরুধর বলিলেন, ‘এতক্ষণ হাঁ করিয়া একমনে, একধ্যানে গল্পটি শুনিতেছিলে। যেই হইয়া গেল, তাই এখন বলিতেছ যে আজগুবি গল্প। কলির ধর্ম বটে।’
শঙ্কর ঘোষ জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘এ কুমিরের গল্প যে সত্য, তাহার কোনো প্রমাণ আছে?’
ডমরুধর উত্তর করিলেন, ‘প্রমাণ? নিশ্চয় প্রমাণ আছে। কোমরের ব্যথার জন্য এই দেখ সেই কুমিরের দাঁত আমি পরিয়া আছি।’
লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘সে কুমির যদি তালগাছ অপেক্ষা বৃহত্ ছিল, তবে তাহার দাঁত এত ছোট কেন?’
ডমরুধর উত্তর করিলেন, ‘অনেক মানুষ খাইয়া সে কুমিরের দাঁত ক্ষয় হইয়া গিয়াছিল।
ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়: ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যে এক নতুন রকমের উদ্ভট হাস্যরসের প্রবর্তক ছিলেন। তাঁর রচিত অজস্র গ্রন্থের মধ্যে ডমরু চরিত এবং কঙ্কাবতী খুবই বিখ্যাত। কঙ্কাবতী উপন্যাস সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘এইরূপ অদ্ভুত রূপকথা ভাল করিয়া লেখা বিশেষ ক্ষমতার কাজ।’ ১৮৪৭ সালে জন্মগ্রহণ করা এই লেখক ১৯১৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন।