আজকে আমার পড়াতে ইচ্ছে করছে না। বলেই নায়লা মিস মিষ্টি করে হাসলেন।
ক্লাস সেভেনের গ শাখার ছেলেমেয়েরা কেউ কোনো কথা বলল না। সবাই চুপ। মুখ হাঁ। এটা কী করে হয়? আজীবন জেনে এসেছে, ছাত্রছাত্রীদের পড়তে ইচ্ছে করে না। কিন্তু টিচারের পড়াতে ইচ্ছে করছে না, এমন কথা কেউ কখনো শুনেছে? সবাই ধরেই নিল, নায়লা মিস মজা করছেন।
সত্যি বলছি। আজকে আমার সত্যিই পড়াতে ইচ্ছে করছে না। নায়লা মিসের হাসির দৈর্ঘ্য আরও বড় হলো। আজকে বই-টই থাক, আমরা অন্য কিছু নিয়ে কথা বলব।
ছেলেমেয়েরা সব হইহই করে উঠল! অতি উৎসাহে কেউ বেঞ্চের ওপর বাড়ি দিয়ে ফেলল।
আস্তে আস্তে! শব্দ কোরো না! হেড স্যার জানলে তোমাদের তো বকা দেবেনই, আমাকেও বকা দেবেন! মিস চাপা গলায় বললেন।
এই ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্টু ছেলেটার নাম বজলু। হেডস্যার কোনো টিচারকে বকা দিলে ব্যাপারটা কেমন হয়, সেটা বজলুর জানার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু মানুষটা নায়লা মিস বলেই ইচ্ছেটা দমন করতে হলো।
ক্লাসের আর সবার মতো বজলুও নায়লা মিসকে খুব পছন্দ করে।
মিস তখন বলছেন, আমরা আজকে এমন একটা বিষয় শিখব, যেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমরা আলোচনা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না।
ওরা সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। এটা কেমন কথা? স্কুলে শেখা যায় না, এমন কিছু আছে নাকি!
তাহলে মিস আমরা কি ক্লাসের বাইরে যাব?
সায়মার প্রশ্ন শুনে মিস হাসলেন, না। ক্লাসের বাইরে যেতে হবে না। যেটা জানার কথা বলছি, আমি আসলে তোমাদের সেটা ঠিক শেখাতে পারব না। তোমরা নিজেরাই শিখবে। আমি শুধু ধরিয়ে দেব।
আবির ক্লাসের ফার্স্ট বয়। সব সময় ক্লাসে টিচাররা কিছু বলার আগে থেকেই সে সব শিখে আসে। কিন্তু আজকে মিসের কথা তার কমন পড়ছে না। মাথা চুলকে সে বলল, ‘মিস, আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।’
নায়লা মিস চক দিয়ে বোর্ডে ১ নম্বর দিয়ে লিখলেন, জটিল চিন্তা করা। তারপর বললেন, প্রথমে আমাদের যেটা শিখতে হবে, সেটা হলো জটিল চিন্তা করা।
মিম লাফিয়ে উঠে বলল, মিস, আমার ভাই সঞ্জু আগে থেকেই এই জিনিসটা পারে। সে সব সময় জটিল চিন্তা করে।
শুনে মিস খুব খুশি হয়ে গেলেন। বললেন, তাই নাকি? কেমন?
মিম বলল, সেদিন দেখি সঞ্জু বিছানার ওপর ওর স্কুলের কেডস জুতো আর একটা হেডফোন নিয়ে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে কী যেন ভাবছে। আমি বললাম, ‘কিরে? কী ভাবিস?’ ও বলল, ‘আচ্ছা আপু, জুতার ফিতা সব সময় খুলে যায়। আর হেডফোনের তার সব সময় পেঁচিয়ে যায়। আমরা কেন জুতোর ফিতার বদলে তার আর তারের বদলে জুতোর ফিতা ব্যবহার করি না?’
মিমের কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে ফেলল। এমনকি নায়লা মিসও। তিনি বললেন, ‘বাহ্, খুব ভালো বুদ্ধি তো! কিন্তু আমি বলছি অন্য জটিল চিন্তার কথা। ধরো, একটা অপরিচিত লোক তোমাকে কোথাও নিয়ে যেতে চাইল। কিংবা কিছু খেতে দিল। তুমি কি খাবে?’
সবাই দুই দিকে মাথা নাড়ল।
ঠিক। চট করে কিছু করলেই হবে না। কোনো কাজ করার আগে তোমাকে আগে তার ফলাফল চিন্তা করতে হবে। লোকটা তোমাকে কোনো বিপদে ফেলছে না তো? তার সঙ্গে গেলে তোমার কি কোনো ক্ষতি হতে পারে? কেন সে তোমাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে? কীভাবে তুমি আশপাশের মানুষের সাহায্য নিয়ে এই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে পারো? তোমাকে বুদ্ধি খাটাতে হবে। জটিল চিন্তা করার অভ্যাস করতে হবে। আশপাশটা দেখে, পত্রিকা পড়ে, বই পড়ে, সিনেমা দেখে তুমি জটিল চিন্তার চর্চা করতে পারো।
মিস এবার বোর্ডে ২ নম্বর দিয়ে লিখলেন, সিদ্ধান্ত নেওয়া।
তারপর ছেলেমেয়েদের দিকে ফিরে বললেন, তোমাদের এখনকার বয়সটাকে বলে বয়ঃসন্ধিকাল। খুব দারুণ একটা সময়! এই সময়টাতে তুমি যেমন নতুন নতুন অনেক কিছু শিখবে, দেখবে, বুঝবে। তেমনি অনেক সময় তোমাকে অনেক সিদ্ধান্তও নিতে হবে। এই বয়সে মানুষের শরীরে একধরনের পরিবর্তন আসে। ছেলেদের, মেয়েদেরও। ধরো, তোমার কোনো শারীরিক সমস্যা হলো। এমন একটা সমস্যা, যেটার কথা মা-বাবা-বন্ধুদের বলতে তোমার সংকোচ হচ্ছে। কিন্তু সংকোচ করলে তো তোমার সমস্যাটার সমাধান হবে না। তোমার সমস্যা তুমি কাকে, কীভাবে বলবে সেই সিদ্ধান্ত তোমাকেই নিতে হবে। মেয়েরা হয়তো মাকে বা বড় বোনকে বলতে পারো। ছেলেরা বাবা বা বড় ভাইয়ের সঙ্গে শেয়ার করতে পারো।
মিস এত সুন্দর করে কথাগুলো বলছিলেন যে সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিল। এমনকি দুষ্টের শিরোমণি বজলুও।
মিস এবার বোর্ডে লিখলেন, সমঝোতা করা। তারপর লাস্ট বেঞ্চে বসা মুগ্ধর দিকে ফিরে বললেন, মুগ্ধ, সেদিন তুমি দীপ্তর হোমওয়ার্কের খাতা লুকিয়ে রেখেছিলে কেন?
মুগ্ধ লাফিয়ে উঠে বলল, মিস, আমার ছোট চাচা নিউইয়র্ক থেকে আমার জন্য একটা ক্যাপ কিনে এনেছেন। দীপ্ত সেটা আমার ব্যাগ থেকে চুরি করে স্কুলের পাশের জঙ্গলে লুকিয়ে রেখেছিল। তাই...
দীপ্ত লাফিয়ে উঠে বলল, না ম্যাডাম, মুগ্ধ এর আগে আমার শার্টে কলম দিয়ে দাগ দিয়েছিল।’
আর তুই যে আমাকে ‘মুগ্ধ তুই মুখ ধো’ বলে খেপাস?
আর তুই যে ‘দীপ্ত রে দীপ্ত, কলা লেবু চিপ তো’ ছড়া বলিস?
তোর ফুটবল দিয়ে খেলা হয় বলে তুই যে আমাকে খেলায় নিস না।
আর তুই যে আমাকে তোর সুকুমার সমগ্রটা পড়তে দিলি না?
দুজনের প্রায় হাতাহাতি হয়ে যাচ্ছিল। থামো থামো! মিস দুজনকে থামালেন। বললেন, এ জন্যই বলছি, তোমাদের সমঝোতা করা শিখতে হবে। তোমরা যদি নিজেদের ঝগড়াটা মিটিয়ে নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে নাও, তাহলে কিন্তু দুজনেরই লাভ। মুগ্ধও ফুটবল খেলতে পারবে, আবার দীপ্তও সুকুমার সমগ্র পড়তে পারবে। তাই বুদ্ধি খাটিয়ে তোমাদের সমঝোতা করাটাও শিখতে হবে। দীপ্ত আর মুগ্ধ, তোমরা এখন কোলাকুলি করো। করো বলছি!
দীপ্ত আর মুগ্ধ কোলাকুলি করতে গিয়ে দুজন দুজনকে এত জোরে চাপ দিল, যে সেটা দেখে সবাই হেসে ফেলল।
নায়লা মিস এবার বোর্ডে চার নম্বর দিয়ে লিখলেন, ‘না’ বলতে শেখা। তারপর বজলুর দিকে ফিরে বললেন, বজলু, তুমি দাঁড়াও।
বজলু মুখ গোল করে বলল, ‘আমি তো কিছু করি নাই মিস।’
মিস হেসে বললেন, তুমি গতকাল সন্ধ্যায় টিচার্স কমন রুমের পেছনের জঙ্গলে কী করছিলে?
বজলু আমতা-আমতা করে বলল, মিস! তখন আপনি স্কুলে ছিলেন!
হুঁ। ছিলাম।
বজলু মাথা নিচু করে ফেলল।
মিস কিছুক্ষণ কড়া চোখে তাকিয়ে থেকে ফিক করে হেসে ফেললেন। বললেন, বজলু, তোমাকে ধন্যবাদ।
বজলু অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, কেন?
কারণ, যত দুষ্টুমিই করো না কেন, চার নম্বর কাজটা তুমি পারো। ক্লাস টেনের মন্টু আর সালমানের সঙ্গে তোমার সব কথা আমি শুনেছি। ওরা তোমাকে সিগারেট খেতে বলছিল। তুমি বারবার ‘না’ বলছিলে। একবার ভাবছিলাম, গিয়ে ওদের ধমক দিয়ে তোমাকে বাঁচিয়ে দিই। পরে ভাবলাম, দেখি তুমি কীভাবে সামাল দাও। ওরা যখন তোমাকে ইন্টার স্কুল ক্রিকেটে নেবে না বলে ভয় দেখাল, তখন ভেবেছিলাম তুমি হার মানবে। তারপরও যে তুমি জোর গলায় ‘না’ বলতে পেরেছ, সে জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।
নায়লা মিস এবার পুরো ক্লাসের দিকে তাকিয়ে বললেন, সবাই বজলুর জন্য একটা জোরে হাততালি দাও দেখি।
সবাই হাততালির সঙ্গে বোনাস হিসেবে হোওওও করে চিৎকারও দিয়ে ফেলল।
বজলুর কেন যেন চোখে পানি এসে গেল।